ফৌজদারি অপরাধের তদন্তঃ বিদেশি পুলিশ কতটা পারঙ্গম?

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 25 Feb 2012, 03:21 PM
Updated : 25 Feb 2012, 03:21 PM

.

ফৌজদারি মামলার তদন্ত করা আর হৃদরোগীর ওপেন হার্ট সার্জারি করা এক জিনিস নয়। একজন রোগীর সার্জারি দেশে কিংবা বিদেশে হতে পারে। এই জন্য দেশী বা বিদেশী ডাক্তারগণ অংশগ্রহণ করতে পারেন। দেশী ডাক্তারদের চেয়ে বিদেশী ডাক্তারগণ এতে অনেক বেশি সফলও হতে পারেন। কারণ, রোগের চিকিৎসা সম্পূর্ণ রোগী ও ডাক্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পুলিশকে যদি ডাক্তারের সাথে তুলনা করি, তাহলে, ফৌজদারি অপরাধের প্রধানতম অনুসঙ্গটি অর্থাৎ অপরাধীগণই বাদ পড়ে যায়। রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসেন। আর রোগ রোগীর সাথেই থাকে। কিন্তু, পুলিশের কাছে রোগীরূপি ভিকটিম আসলেও রোগরূপী অপরাধীরা সচেতনভাবে পালিয়ে বেড়ায়। অনেক সময় পুলিশের কাছে ভিকটিমগণও আসতে পারেন না। কারণ, তারা নিহত হতে পারেন, কিংবা নিখোঁজ বা অপহৃত হয়ে অপরাধীদের দখলে থাকতে পারেন। তাই, ফৌজদারি মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বিদেশী ডাক্তাদের মতো বিদেশী পুলিশের সহায়তা কতটা প্রাসঙ্গিক?

অপরাধ সর্বতভাবে একটি স্থানীয় সামাজিক ক্রিয়া কিংবা ব্যক্তিগত আচরণ। কিছু কিছু অপরাধের বিস্তৃতি শহর-বন্দর, জাতি বা দৈশিক সীমানা পেরিয়ে গেলেও এসবের কুশিলবগণ একেবারেই স্থানীয়। তাই, ফৌজদারি মামলার তদন্ত সম্পূর্ণ স্থানীয় বিষয়। অপরাধ শুধু অপরাধী বা তার ভিকটিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এই অপরাধ সংঘটিত হতে পারে একাধিক সময়ে বা একাধিক স্থানে। এর সাথে জড়িত থাকতে পারে একাধিক ব্যক্তি, একাধিক গোষ্ঠী, এমনকি, একাধিক প্রতিষ্ঠান। এই সব ব্যক্তি, ঘটনা, বস্তু, সময় ও স্থানের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উদ্ঘাটন করাই হল তদন্ত। ফৌজদারি মামলার তদন্তে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু, আমাদের দেশী বিশেষজ্ঞদের চেয়ে বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এই ব্যপারে যে খুব বেশী পারঙ্গম হবেন, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।

অপরাধের ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনাস্থল থেকে আলামতসমূহ সাক্ষ্য আইনের চাহিদার নিরীখে সংগ্রহ, সেগুলোর সঠিক বিশ্লেষণ ও গবেষণাগারে সেগুলোর সঠিক পরীক্ষা করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতামত তদন্তকারি কর্মকর্তাদের ঘটনা উদ্ঘাটনে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। তবে, মনে রাখতে হবে, তদন্ত হল একাধারে একটি শিল্প ও একটি বিজ্ঞান। তদন্তকাজে তাই পুলিশকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও শৈল্পিক মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ঘটনাস্থলের বিগত পরিবেশ ও বর্তমান অবস্থানের পটভূমিতে বস্তুগত সাক্ষ্য ও উপস্থিত কিংবা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে একজন উপন্যাসিকের মানসিকতা ও দক্ষতা নিয়ে একটি বাস্তব কাহিনী তৈরির চেষ্টা করতে হয়।

কোন চাঞ্চল্যকর অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশি অভিজ্ঞতা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তথা গবেষণাগারের সুবিধা, বিশেষজ্ঞ মতামতের প্রাপ্যতা, প্রয়োজনীয় আর্থিক ব্যয় ইত্যাদি বিষয়কে ছাপিয়ে পুলিশের যা সবচেয়ে বেশী দরকার, তা হল, পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু, আমাদের দেশের জনগণ পুলিশকে অন্যান্য সুবিধাগুলোর সাথে সাথে বিনামূল্যে সময়টুকুও বরাদ্ধ করতে নারাজ। পুলিশ মামলা তদন্তে একটু সময় চাইলেই তারা পুলিশকে ব্যর্থ ভেবে তদন্তকাজে বিদেশী পুলিশ আমদানীর পরামর্শ দেন, এমনকি, এর জন্য আন্দোলনও করেন। আর বিদেশী পুলিশ আমদানী তালিকায় এখন পর্যন্ত দুইটিমাত্র নাম অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সেগুলো হল, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভিস্টিগেশন সংক্ষেপে, এফবিআই এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি যার বহুল পরিচিতি হল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিশ।

কিন্ত একটি সম্পূর্ণ স্থানীয় ও চিরাচরিত অপরাধের তদন্তকাজে কী করবেন এফবিআই বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পুলিশগণ? তারা কি আমাদের পুলিশের চেয়ে অনেক বেশী কিছু করতে পারেন? তারা কি আমাদের পুলিশের চেয়ে অনেক বেশি চৌকশ, দক্ষ ও করিতকর্মা? এই ব্যপারে কী বলে এই দুই পুলিশ সংগঠনের ইতিহাস ও আমাদের এ পর্যন্ত অর্জিত অভিজ্ঞতা?

আমরা জানি, ইতোপূর্বে কমপক্ষে তিনটি চাঞ্চল্যকর অপরাধ ঘটনার তদন্তকাজে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের এদেশের মাটিতে আনা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারীতে সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মামলা তদন্ত কাজে সহায়তার জন্য বিদেশী তদন্তকারীদের আনা হয়েছিল। এর আগে সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার জনাব আনোয়ার চৌধুরীর উপর ২০০৪ সালের ২১ মে তারিখে গ্রেনেড হামলার তদন্তকাজে সহায়তার জন্যও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিশ সদস্যরা এসেছিল। আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে তৎকালীন সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীর জনসভায় গ্রেনেড হামলার তদন্তকাজের সহায়তার জন্যও আনা হয়েছিল আমেরিকার এফবিআই এবং ইন্টারপোলের বিশেষজ্ঞদল।

কিন্তু, এফবিআই বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিশেষজ্ঞরা এসব ঘটনার তদন্তে কী অবদান রাখতে পেরেছিলেন? আমাদের ঢাকা মেট্রোপলিট পুলিশের ডিবি কিংবা তদন্ত সংস্থা সিআইডির কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত তদন্তের বাইরে তারা কী এমন দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অত্যন্ত সূচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে এবং তা আমাদের দেশের পুলিশ অফিসারগণই করেছেন। অন্যদিকে, জনাব আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলার মামলাটির তদন্ত ও তার বিচারের রায়ে তিনজনের ফাঁসির আদেশদান ছিল আমাদের সিআইডি অফিসারদেরই পরিশ্রমের ফসল।(1)

বিদেশী কারখানায় তৈরি বিলাশবহুল মোটর গাড়ি বাংলাদেশের রাস্তায় তার আভিজাত্য আর যান্ত্রিক দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে; বিদেশী ঔষধে বাংলাদেশের মানুষের রোগ সারতে পারে। বিদেশী সার্জনদের হাতে মুমূর্ষ রোগীর অস্ত্রপাচার হতে পারে। কিন্তু, বিদেশী পুলিশ দিয়ে বাংলাদেশের কোন হত্যাকাণ্ডের রহস্য রাতারাতি উদ্ঘাটিত হতে পারে না। অপরাধ-বিজ্ঞান এ কথা বলে না। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাও এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না।

আমরা জানি, আমেরিকার এফবিআই কিংবা ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পৃথিবীর সেরা তদন্তকারী সংস্থা। কিন্তু, তাদের পারঙ্গমতা শুধু তাদের দেশেই। বিদেশের মাটিতে তারা কী করতে পারে এবং কতটুকু করতে পারে? যে ঘটনার মূল শুধু তাদের দেশেই, সেই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তাদের উৎকর্ষ আমরা জানি। কিন্তু, যে ঘটনার মূল তাদের দেশের মাটিতে নয়, সেই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তারা আমাদের দেশের একজন পুলিশ কনস্টেবলের চেয়ে বড় বেশি মাপের পুলিশ অফিসার নন; হতে পারেন না।

আমেরিকার এফবিআই তদন্তকর্মে দক্ষ হলেও তারা রূপকথার যাদুকর নন। তারা সব ঘটনারই রহস্য উদ্ঘটান করতে পারেন এমন দাবী নিজেরাও করেন না। আর যা পারেন তাও রাতারাতি সম্পন্ন করতে পারেন না। এ জন্য তারা পর্যাপ্ত সহায়, সম্পদ ও সময় দাবী করেন। আমেরিকায় প্রতিদিন যে সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তাদের মধ্যে কতগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে সেদেশের পুলিশ? খোদ এফবিআইয়ের দেওয়া পরিসংখ্যানই বলে তারা ১০০ টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মাত্র ৬৩ টি ঘটনার কুল কিনারা করতে পারেন । বাকী ৩৭ টি হত্যা ঘটনার ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি, অর্থ-সম্পদ কোন কাজেই আসে না। সে দেশের অপরাধ উদ্ঘাটনের সামগ্রিক হার মাত্র ১২%-১৪% ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উনা-বোম্বার ছদ্মনামের একজনমাত্র নৈরাজ্যবাদী অপরাধীকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে এফবিআইসহ সারা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের সময় লেগেছিল, ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর । এর কৃতিত্বও আবার এফবিআই এর একার প্রাপ্য নয়। নিউইয়র্ক টাইম ও ওয়াসিনটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত উনা-বোম্বারের একটি রচনার সূত্র ধরে অপরাধীর আপন ভাই-ই তাকে গ্রেফতার করিয়েছিল। এ জন্য উনা-বোম্বারের ভাইকে দিতে হয়েছিল প্রায় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পুরস্কার। এই জাতীয় হাজার হাজার ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা আছে যেগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ও নগর পুলিশগুলো প্রতিনিয়ত হিমসিম খাচ্ছে। অহরহ মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দিচ্ছে কিংবা বছরের পর বছর সে সব মামলার তদন্ত মূলতবী রাখছে। কিন্তু, আমাদের বাংগালী মনের রূপকথার পুলিশরা তাদের কতটুকু সহায়তা দিতে পারছেন?

অন্যদিকে, ২০০ মিলিয়ন বৃটিশ পাউন্ড বাজেটের একটি প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাজ্যের মাত্র ১,৫৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকার লন্ডন শহরকে প্রায় ১০,০০০ সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে সয়লাব করে দেওয়া হয়েছে। এই শহরের অপরাধীদের অপরাধকর্ম মূলত পুলিশের ক্যামেরার নিচেই সম্পাদন করতে হয়। তারপরও লন্ডন পুলিশ কয়টি অপরাধের সুরাহা করতে পারে? লন্ডনের 'ইভিনিং স্টান্ডার্ড' পত্রিকার খরব অনুসারে লন্ডন শহরের শতকরা ৮০ টি অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনে সেদেশের পুলিশ সর্বতভাবেই ব্যর্থতার পরিচয় দেয় ।

সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশের কথিত উন্নত তদন্ত ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে ততোটা উন্নত নয়। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, উন্নত গবেষণাগারের সুবিধা ও ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণের পরেও আমেরিকা ও ইউরোপের তদন্তকারী সংস্থাগুলো আদালতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিচারের জন্য উপস্থাপন করে। আবার বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা পুলিশের ভুল তদন্তের সাথে একীভূত হয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের সাজা দিয়ে থাকে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ৫% মামলায় নিরপরাধ বা ভুল ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয় এবং এই হিসাব মতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছর প্রায় ১৪,০০০ নাগরিককে অপরাধ না করেও সাজা ভোগ করতে হচ্ছে । আরো মজার বিষয় হচ্ছে, এই নিরপরাধ লোকগুলোর মধ্যে প্রায় ২৫% পুলিশের কাছে বা আদালতে নিজেদের জড়িত করে স্কীকারোক্তি দিয়ে থাকে । প্রিয় পাঠক, আমাদের পুলিশ তো কদাচিৎ জজ মিয়ার জন্ম দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ অহরহই জজ মিয়া উৎপাদন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের জজ মিয়া তো পুলিশের পরবর্তী তদন্তেই ছাড়া পাচ্ছে। কিন্তু, পাশ্চাত্যের জজ মিয়ারা বছরের পর বছর জেলের ঘানি টানছে বা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে জীবনিপাত করছে।

আমাদের বাংগালী পাঠকগণ কী অবগত আছেন, আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ( ৯/১১) বিভিন্ন বিমান বন্দর থেকে বিমান ছিনতাই করা ও সেই বিমানগুলো ব্যবহার করে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারসহ সেদেশের প্রতিরক্ষা দফতরে (পেন্টাগণ ভবনে) হামলা চালানোর ঘটনায় রুজুকৃত মামলাগুলোর তদন্তের ভারও এফবিআই এর উপর অর্পিত হয়েছে? আর কঠিন বাস্তবতা হল, আমেরিকার এফবিআই এই মামলাগুলোর তদন্ত এখনও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি।

আমাদের দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য হল, তারা আমাদের দেশীয় সব কিছুকেই নিম্নমানের বলে পূর্বসংস্কারজাত ধারণা পোষণ করেন। তাদের কাছে যা কিছু বিদেশী, তার সবই উৎকৃষ্ট। আর দেশী হলেই তা নিকৃষ্ট। বাংলাদেশের চকলেট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গাড়ি-বাড়ি-শাড়ি, এমনকি, বাংলাদেশের পুলিশও নিকৃষ্ট। পত্র-পত্রিকা বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে বিদেশী পণ্য বা সেবার চটকদার বিজ্ঞাপনে তারা অতি সহজেই আকৃষ্ট হন। বিজ্ঞাপনের মেকিত্ব আর বাস্তবের পণ্যের মধ্যে তারা পার্থক্য করতে তারা অপারগ।

আমাদের দেশের পুলিশের কোন সাফল্যই মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। পৃথিবীর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসের সর্ববৃহৎ হত্যাকাণ্ড পীলখানা মামলার চুলচেরা ও নিখুঁত তদন্ত যে আমাদের দেশের পুলিশরাই সম্পন্ন করেছেন, আমাদের দেশের মানুষ এই সাফল্য মূল্যায়নে বড়ই কুণ্ঠিত। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ হাজার হাজার চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত যে আমাদের দেশের পুলিশকে দিয়েই সম্ভব হয়েছে, তার খতিয়ান আমাদের দেশের মানুষ শুনতে চায় না। এই সব মামলার তদন্তকাজে অনেক সময় লোক দেখানোর জন্য আবার অনেকটা বিশেষজ্ঞ সহায়তার জন্য এফবিআই বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিশ সদস্যদের আনা হলেও তাদের সহায়তা বা উপস্থিতি আমাদের দেশী পুলিশের কতটুকু কাজে এসেছিল তা পরিষ্কার নয়।

কী অদ্ভূত আমাদের বাংগালী মানসিকতা! আমরা আমাদের দেশের পুলিশের শুধু ব্যর্থতাই জানি। আমাদের চোখে পুলিশের শুধু ব্যর্থতাই ধরা পড়ে। পুলিশের সাফল্যের খবরগুলো আমরা জানিও না, জানতেও চাই না। হাজারো ব্যর্থতাকে পাশকাটিয়ে আমরা শুধু বিদেশী বলেই এফবিআই বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিশের সাফল্যকেই টেনে আনি। অথচ তারা আমাদের দেশের পুলিশের মতোই ব্যর্থ; আমাদের দেশের ঢাল-তলোয়ারহীন পুলিশের মতোই সফল।

পরিশেষে বলব, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসের তদন্ত অধ্যয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের পাল্লাই ভারী। কোন হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে বাংলাদেশ পুলিশ পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নাই। অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের আসামীকে পুলিশ ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কয়েক মাস বা কয়েক বছরও লেগেছে। ফৌজদারি মামলার তদন্তের বিষয়টি যতটা না অভিজ্ঞার তার চেয়েও বেশী সুযোগের (চাঞ্চ)। প্রত্যেকটি ঘটনাই পৃথক। এর সাথে জড়িত ভিকটিম থেকে শুরু করে অপরাধী, অপরাধের সহায়তাকারী ও অপরাধের সুবিধাভোগী — সবাই পৃথক ও অনন্য। তাই পাটি গণিতের ঐকিক নিয়মে কোন তদন্তকার্য পরিচালিত হতে পারে না।

পাদটীকা/সূত্রাবলী:
1. পরবর্তীতে মহামান্য হাইকোর্টও সেই ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে দেয়া এ রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলেন, হলেন মুফতি আবদুল হান্নান, হুজির সিলেট অঞ্চলের সংগঠক শরীফ শাহেদুল আলম (বিপুল) ও দেলোয়ার হোসেন (রিপন)। মামলার অপর দুই আসামি মুফতি হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান (অভি) এবং মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। (দৈনিক প্রথম আলো ২৮ এপ্রিল, ২০১৬)