ফতোয়াবাজি প্রতিরোধ: পুলিশের দায়-দায়িত্ব

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 17 March 2012, 06:13 AM
Updated : 17 March 2012, 06:13 AM

২০০৯ সালের জুলাই মাস। নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ থানার নিভৃত একটি গ্রাম। গ্রামের একটি তথাকথিত নষ্টা মেয়ের নষ্টামির বিচার করতে বসলেন কয়েকজন ভ্রষ্ট মাতাব্বর। মেয়েটির দোষ ছিল, 'সে পাশের বাড়ির বিবাহিত একটি যুবককে নষ্ট করে নিজেও গর্ভবতী হয়েছিল'। লোক চক্ষুর অন্তরালে মেয়েটি তার গর্ভের ভ্রুণটি কোন জায়গায় নষ্ট করে নিজের পেটটি স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে এসেছিল। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে মেয়েটি দাবী করে, যুবকটি তাকে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে সহবাস করেছিল। এখন সে তার ওয়াদা রক্ষা করছে না।

যদিও ছেলেটি ছিল লা-পাত্তা, মেয়েটিকে গ্রামের মোড়লগণ সহজেই হাতের কাছে পেয়েছিল। সালিসকারীদের মধ্যে সরকারি দলের স্থানীয় নেতারাই ছিল অগ্রণী। একজন ছিল রীতিমত পরিচিত, প্রভাবশালী এবং পরিকল্পনাকারী।

যেহেতু মেয়েটি ছিল 'নষ্টা', তার পরিবার তাকে 'নিয়ন্ত্রণ' করতে পারে নাই এবং তার এহেন অপকর্ম সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাই সমাজে একটা নজির তৈরি করার মতো শাস্তিই মেয়েটির প্রাপ্য ছিল।

হুকুম হল, তাকে ৮০ টি দোররা মারতে হবে। যে হুকুম সেই কাজ। কিন্তু, কয়েকটি দোররা মারার পর মেয়েটি জ্ঞানশূন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এখন বাকী দোররাগুলোর কি হবে? গল্পে রয়েছে, উমরপত্র আবু সাহমার জন্য হুকুমকৃত ১০০ টি দোররার মধ্যে ৮০ টি খেয়েই তার প্রাণপাত হয়েছিল। বাকী ২০ টি দোররা তাকে সমাহিত করার পর তার কবরের উপর মারা হয়েছিল।

আমাদের ফতোয়াবাজরা সিদ্ধান্ত দিলেন, বাকী দোররা মারতে হবে তার মাকে। কারণ, এই মহিলা তার মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাই। বেচারী স্বামীহারা বৃদ্ধা! সেও কয়েকটি দোররা খেয়ে মৃতপ্রায়। ফতোয়াবাজদের বিবেচনা ছিল বটে! মেয়েটির নাবালক একটা ভাই ছিল। তারা বাকী দোররাগুলো তার উপর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত দেন নাই। তবে বোন ও মায়ের জন্য ভাইটি ফতোয়াবাজদের হাতে-পায়ে ধরেছিল। কিন্তু, নাবালকের আকুতি তাদের এই 'পবিত্র দায়িত্ব' থেকে বিরত রাখতে পারে নাই।

দোররার আঘাতে অসুস্থ মা ও মেয়ে কোম্পনীগঞ্জ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হলে খবরটি চারিদিকে চাউর হল। সাংবাদিকগণ তৎপর হন। কিন্তু, এ ব্যাপারে থানায় কোন অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। তবু পুলিশের কানে খবর আসলে ফতোয়াবাজদের কয়েকজনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। এলাকায় একটি সাড়া পড়ে যায়। কিন', গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি দলের নেতারা চাপ দিতে থাকে। একজন থানা পর্যায়ের নেতা এসে বলেন, আমিই তো এই ফতোয়ার আদেশ দিয়েছি। মেয়েটি ও তার পরিবার এলাকার ছেলেপেলেদের নষ্ট করে ফেলছে। আমাদের কি দায়িত্ব নেই? আমাকেও তা হলে গ্রেফতার করেন। তাদের বোঝাতে দারুণ বেগ পেতে হয়েছে পুলিশকে।

হাসপাতালে মেয়েটির কাছে গিয়ে পুলিশ একটি নিয়মিত অভিযোগ করতে বলে। কিন' মজার ব্যাপার হল, ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। তার অভিযোগ হল সেই যুবকটির বিরুদ্ধে যে তাকে গর্ভবতী করেছিল। তবে সে নিয়মিত মামলা করে কোন প্রতিকার পেতে চায় না। যুবককে ধরে নিয়ে এসে বিয়ের ব্যবস্থা করলেই সে খুশি। পুলিশ কোন রকমে কৌশলে নিজেদের তৈরি করা একটি এজাহারে মেয়ের মায়ের দসতখত নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি নিয়মিত মামলা রুজু করে। কিন্তু, ফতোয়াবাজদের তো এই ধর্ষণ মামলায় আসামি করা যায় না। তাদের ৫৪ ধারায় কোর্টে পাঠানো হল।

মজার ব্যাপার হল, ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে মেয়েটি মামলা করতে নারাজ। তাকে অনেক বোঝানো হল। কিন্তু সে কোন ক্রমেই রাজি হল না। এর পিছনে মাতাব্বরদের প্রতিশোধ নেওয়ার ভয়েই শুধু নয়, মেয়েটি মনে করত, মাতাব্বরগণকে চাপে রাখলে ছেলেটিকে দিয়ে তারা তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে। হায়রে ধর্ষিতা নারী! এত কিছুর পরও সে আশাহত হয় নি।

পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তা জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিবিধ প্রতিবন্ধকতা ছিল। এক দিকে ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে যেমন সুনির্দিষ্ট আইনের বিধান নেই, অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে বাদি পক্ষ মামলাও করতে চায় না। আমাদের দণ্ড বিধি থেকে শুরু করে হাল আমলের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের কোথাও ফতোয়াবাজির সংজ্ঞা দেওয়া হয় নাই, শাস্তিরও বিধান নাই। তাই দণ্ড বিধির ৩৫৪ ধারাটিতে সংজ্ঞায়িত স্ত্রীলোকদের শ্লীলতাহানীর অপরাধ দেখিয়ে সারাদেশের পুলিশ অফিসারগণ ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে যেনতেন একটা মামলা দাঁড় করান। উল্লেখ্য, দণ্ডবিধির এই ধারাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে কোন ধারার চেয়ে দুর্বল।

ঘটনাটি অনেক মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনকে কোম্পানীগঞ্জে নিয়ে এসেছিল। এদের অনেকেই পুলিশের সমালোচনায় মুখর ছিল। ঘটনার এত দিন পরেও পুলিশ ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে কোন নিয়মিত মামলা নিতে পারে নি। ক্ষমতাসীন দলের চাপে পুলিশ নতি স্বীকার করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

অবশেষে কি আর করা! যে অপরাধের কোন বাদি নেই, পুলিশকেই তার বাদি হতে হয়। থানার অফিসার-ইন-চার্জ অবশেষে এক এসআইকে বাদি বানিয়ে দণ্ড বিধির ধারায় ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা রুজু করেন। মামলা রুজু নিয়ে থানা-পুলিশ-বাদি-সাংবাদিক-মানবাধিকার সংগঠন-স্থানীয় সরকার দলীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যা হয়েছিল তা বিস্তারিত সংগত কারণেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মামলাটি এখনও বিচারাধীন। কিন্তু এর ফলাফল যে শূন্য হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফতোয়াবাজদের ছায়া ছাড়া ভিকটিমের আর থাকার জায়গা নেই। যে যুবকের সাথে ভিকটিমের দৈহিক মিলনের ফলে তার গর্ভসঞ্চার এবং পরবর্তীতে দোররার আঘাতে বিক্ষত হওয়া, সেই যুবকের কোন দোষ ছিল বলে সমাজ বিশ্বাস করে না। মেয়েটি এই সমাজ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেও পারে না।

পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল। মেয়েটির সামাজিক অবস্থান, পূর্বে স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়া এবং কিছুটা চরিত্রস্খলন আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস মেয়েটি আত্মহত্যা করেনি!

ফতোয়াবাজির নামে গ্রামে-গঞ্জে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই ইদানিং মহামান্য আদালতের নজরে নিয়ে আসা হচ্ছে। আবার অনেক ঘটনায় আদালত স্বপ্রণোদিত হয়েও রুল বা আদেশ জারি করছেন। অনেক ঘটনা নিবারণে ব্যর্থতা কিংবা ঘটনার পরম্পরায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করা বা ব্যর্থতার জন্য স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটির গোড়ায় হাত দেওয়ার মতো তেমন কোন নির্দেশনাও পাওয়া যাচ্ছে না এবং তেমন কোন পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

ফতোয়াবাজির মতো ঘটনাগুলো ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার, অশিক্ষা ও এক শ্রেণির স্থানীয় প্রভাবশালী মাতাব্বরদের অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে উদ্ভব হয়। অন্যদিকে নারীদের দুর্বল অবস্থান, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে তা টিকে থাকে। আমাদের মেয়েদের সামাজিক অবস্থান যতক্ষণ পর্যন্ত না উন্নত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফতোয়াবাজির মতো নির্যাতনমূলক ঘটনার তারা শিকার হতেই থাকবেন। দুর্বলদের অনেককেই (সবাইকে নয়) আইন দিয়ে ক্ষতির প্রতিকার দেয়া যায়; কিন্তু আইন দিয়ে তাদের সবাইকে রক্ষা করা যায় না। আইনের হাত অনেক লম্বা হলেও, এর চোখ কিন্তু খুব ছোট এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন চোখেই দেখে না। আমাদের গাঁও-গ্রামে হাজারো অপরাধমূলক ঘটনার কয়টি আইনের দৃষ্টিতে আসে? তাই দুর্বলকে সবল করার মধ্য দিয়েই কুসংস্কারকে সহজেই মোকাবেলা করা যাবে। মেয়েটির সামাজিক অবস্থান উন্নত হলে এবং সে আর্থিকভাবে সক্ষম হলে নিশ্চয় তাকে দোররা মারা সম্ভব হত না।

সমাজ একটি সামষ্টিক ধারণার নাম। সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়। সমাজের অবহেলা বা অনাচারের জন্যই নারীদের প্রতি অত্যাচার প্রলম্বিত হয়। কিন্তু সামাজিক সমস্যা সমাধানের ভার পুলিশের উপর অর্পিত হয়নি। অথচ পুলিশকেই এর জন্য দোষারোপ করা হয়। আর এ কথাও সঠিক যে রাষ্ট্র বা সমাজ কোন সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বা ক্ষমতা পুলিশকে অর্পণ না করলেও সেই সমস্যার জন্য যদি জনগণ পুলিশের দ্বারস্থ হয়, তবে পুলিশকে তা সমাধানের ভার গ্রহণ করতেই হয়। ফতোয়াবাজির ঘটনাগুলো তাই নিছক সামাজিক বা ধর্মীয় সমস্যা বা আচার বলে এড়িয়ে যাওয়া পুলিশের পক্ষে উচিত না; সম্ভবও না।