দুর্নীতির তৃণমূল

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 20 March 2012, 02:14 AM
Updated : 20 March 2012, 02:14 AM

গতকাল আমার গ্রাম থেকে দু'জন লোক আমার অতিথি হয়েছিলেন। তাদের একজন স্বুল শিক্ষক; অন্যজন একটি মাদ্রাসার অন্যতম দাতা। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে তারা একটা দরখাস্ত নিয়ে এসেছিলেন। আমার বাসা যেহেতু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের পাশেই, তাই এই সুযোগে আমার বাসায় বেড়িয়ে গেলেন তারা।

মাদ্রাসার দাতা লোকটি তার মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত নিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তার অভিযোগ মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের ভোটে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচিত হয়। কিন্তু বর্তমান এড-হক পরিচালনা পর্ষদ প্রতারণামূলকভাবে ভূয়া দলিলপত্র তৈরি করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে দাবী করছেন। কিন্তু মাদ্রাসার কোন ছাত্র-ছাত্রী বা অভিভাবকদের কেউই জানে না কবে সেই নির্বাচন হয়েছিল। এই জন্য তারা রংপুরে সিভিল আদালতে একটি মামলা করেছেন। কিন্তু খবর পেয়েছেন, মামলার বাইরেও প্রতারক পরিচালনা পর্ষদ বোর্ড থেকে পাকাপোক্ত একটা অর্ডার বের করবে।

একটি মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে এত লুকোচুরি, প্রতারণা, মামলা-মোকদ্দমা, বোর্ড-আদালত আমার মাথায় ঢুকছিল না। ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বা সভাপতি — এইসব পদের জন্য কেন এই প্রতিযোগিতা ও প্রতারণা?

আমার দেশীরা ঘটনাটা বুঝিয়ে বললেন, এই মাদ্রাসায় বিভিন্ন কারনে ৭টি শিক্ষকের পদ খালি হয়েছে। এদের নিয়োগে পরিচালনা পর্ষদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এই নিয়োগে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার লেন-দেন হবে। এটা হবে মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য ডোনেশনের আড়ালে ঘুষ। ৫০ লাখ টাকার মধ্যে সামান্য কিছু টাকা মাদ্রাসার ফান্ডে জমা পড়বে। বাকী টাকা ভাগ হয়ে যাবে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে।

এই সম্ভাব্য অবৈধ লেন-দেন নিয়ে আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। রংপুর অঞ্চলের মানুষ স্বভাবতই গরিব। চাকরিপ্রার্থী একজন যুবক বা যুবতী একটি বেসরকারি মাদ্রাসা বা স্কুলের শিক্ষকতার পদের চাকরির জন্য ৭/৮ লাখ টাকা দিবেন কিভাবে? অন্যদিকে টাকার অংকই বা এত বড় হবে কিভাবে?

সূত্রটি বড়ই সহজ, নিতান্তই সরল, জানালেন আমার অতিথিগণ। সারা দেশেই এখন টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। সবকিছুর মূল্য বেড়ে গিয়েছে। তাই, ঘুষ বা ডোনেশনের অংক তো বাড়বেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে গ্রামে এখন ৫০ শতক জমির মূল্যও ৭/৮ লাখ টাকা। চাকরিপ্রার্থী যুবক ৫০ শতক জমি বিক্রয় করলেই প্রয়োজনীয় ঘুষের টাকা সংগ্রহ করতে পারবেন। আমার অতিথিরা বললেন, সম্প্রতি তাদের পাশের গ্রামের একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিয়ন পদের নিয়োগে সাড়ে তিন লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। বলাবাহুল্য, পিয়নের বেতন মাসে মাত্র ১,৪০০ টাকা।

আর লাভ ক্ষতি? ৫০ শতক জমিতে চাষ-বাস করে বড় জোর বছরে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় হবে। কিন্তু বেসরকারি স্কুল মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষকের বেতন মাসে ৮ হাজার টাকা। সব কিছু মিলে বছরে এক লাখের উপরে। আবার ৮ বছর পরে পাবেন ইনক্রিমেন্ট। তখন মাসে হবে ১২ হাজার টাকার বেশি। তাই, বেকার যুবকগণ চাকুরির জন্য উৎকোচ প্রদানকে একটা বিনিয়োগ হিসেবেই দেখছেন। এটা ক্ষেতখামারে গতর খাটার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক।

কিন্তু, যারা উৎকোচ নিচ্ছেন? হ্যাঁ, জনগণ তাদের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বানিয়েছেন। তাদের মাদ্রাসা বা স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের নিয়োগদানের বা বরখাস্তকরণের ক্ষমতা রয়েছে। তাই, তারা তা প্রয়োগ করবেন না। আর যারা দায়িত্ব পালন করেন বা ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, তারা তো সবাই এসব করেন। খুব ভাল যুক্তি। বড় যুক্তি এবং অকাট্য যুক্তি।

মনে পড়ে, যখন হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের স্কুলে দুই জন নতুন শিক্ষক যোগদান করেছিলেন- একজন বিজ্ঞানের, অন্যজন বাংলার। নতুন শিক্ষকদের কী ধার! যেমন ভাল পড়ান, তেমনি ভাল শাস্তিও দেন। তারা ছিল মেধাবী। তখন আমরা বুঝতামই না যে শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে স্কুলের চাকরি নিয়ে ক্লাসে পড়াতে আসেন।

কিন্ত এখন? নতুন শিক্ষক মানেই ৭/৮ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া । এখন প্রতিটি ছাত্রই জানে, তার নুতন শিক্ষকটি ঘুষের বিনিময়ে চাকরি নিয়েছে। আর এই টাকা স্কুল বা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক, প্রিন্সিপাল, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরগণ ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

ভাল, এখন গণিতের শিক্ষক সুদকষা আর লাভক্ষতির অংক ভাল পড়াতে পারবেন। তিনি ছাত্রদের বুঝিয়ে দিতে পারবেন চাকরি নেওয়ার জন্য ৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে কত বছরে তা মূলধন সহ উসুল হবে। অন্যদিকে বাংলার শিক্ষক ছাত্রদের ষ-ত্ব বিধান আর ণ-ত্ব বিধানের পাশাপাশি উৎকোচ-বিধানও পড়াতে পারবেন।

এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হবে। এদের কেউ হবেন ডাক্তার, কেউ ইন্জিনিয়ার, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ জজ-বারিস্টার হবেন। কেউ হবেন কেরানি, কেউ বা পুলিশের কনস্টেবল, এসআই বা এএসপি। কেউ ডিসি হবেন একদিন, কেউ এসপি হবেন। কেউ রাষ্ট্রপরিচালনার ভারও নিবেন। তারা নিশ্চয়ই তৃণমূলের আদর্শ গ্রহণ করবেন।