পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগঃ বাছবিচার ছাড়াই পত্রিকায় খবর ছাপানো যায়

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 5 April 2012, 11:19 AM
Updated : 5 April 2012, 11:19 AM

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাদৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় বাগের হাট জেলার কচুয়া থানার এএসআই কুদ্দুসের বিরুদ্ধে একটি মারাত্মক অপরাধের খবর প্রকাশিত হয়।

খবরে বলা হয়, এই পুলিশ সদস্য তার দলবল সহ একজন গর্ভবতী মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। খবরটি যে কোন বিবেকমান মানুষকে নাড়া দিবেই। আমি নিজেকে একজন বিবেকবান মানুষ বলেই দাবী করি। অধিকন্তু, আমি নিজেও একজন পুলিশ সদস্য। তার চেয়েও বড় হল আমি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। পুলিশ সদস্য হিসেবে খবরটি আমাকে লজ্জিত করেছে এবং সিনিয়র পুলিশ অফিসার হিসেবে নিম্ন পদস্থ পুলিশ সদস্যদের সাধারণ শ্রেণির ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়া আমাকে একজন অযোগ্য পুলিশ ব্যবস্থাপক হিসেবে প্রমাণিত করে। তাই লজ্জিত, ব্যথিত ও কুপিত চিত্তে বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলাম। সব শেষে স্থানীয় পুলিশ ও কিছু বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে নিশ্চিত হলাম যে বিষয়টি একেবারে ভূয়া। এখানে পরিকল্পিতভাবে পুলিশকে হেয় করার জন্য স্থানীয় সাংবাদিকগণ ঢাকায় অসত্য খবর পাঠিয়েছেন। আর কেন্দ্রের সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরা বেমালুম সে খবর পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছেন। ঘটনাটির বর্ণনা নিম্নরূপ :

গত ২২/২/২০১২ তারিখে রাত অনুমান ৮.৩০ মিনিটে কচুয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মোবাইল ফোনে জনৈক কর্মচারি ডিউটি অফিসারকে জনান যে, একজন অপরিচিত মহিলা বিধিবহির্ভূতভাবে হাসপাতালের বেডে অবস্থান করছে। তার চলাফেরা সন্দেহজনক। সংবাদটি যাঁচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কচুয়া থানার জিডি নং- ৭৯৩ তারিখ-২২/০২/২০১২খ্রিঃ সময় ২১.৩৫ মূলে এএসআই কুদ্দুস কচুয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। ডিউটিরত নার্স ও অন্যান্যরা এএসআই কুদ্দুসকে উক্ত মহিলার নাম রেশমা বলে জানায়। এএসআই কুদ্দুস মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মহিলা তখন তার নাম জেবুন্নেছা বলে দাবী করেন। তিনি জানান, তার ফুফাতো বোন মনিকে দেখতে তিনি হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু হাসপাতালের ভর্তি রেজিষ্টার খুঁজে ঐ নামের কোন রোগী পাওয়ায় গেল না। তখন মহিলা অসংলগ্ন উত্তরে জানায়, পিকলু নামের এক কর্মচারি তাকে হাসপাতালে রাত্রীযাপন করতে বলেছে। কিন্তু, পিকলু দাবী করে সে মহিলাকে একদম চেনে না। বিষয়টি এএসআই কুদ্দুসের কাছে কিছুটা জটিল মনে হলে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনি মহিলা ও হাসপাতালের কর্মচারী পিকলুকে থানায় নিয়ে আসেন।

জিজ্ঞাসবাদের এক পর্যায়ে মহিলা জানান যে, তিনি নয় মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। তখন থানার অফিসারগণ মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু মহিলা এতে রাজি হয়নি। মহিলা দাবী করেন, তার বাবার বাড়ি থানা অঞ্চলের তেলিগাতি গ্রামে। থানার অফিসারদের তিনি তার বাবার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেন।

এদিকে হাসপাতালের কর্মচারী পিকলু শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে যে, মহিলা তার পূর্ব পরিচিত। তবে তার সঠিক নাম পরিচয় সে পুলিশকে জানাতে পারেনি। তার সাথে মহিলার বিকালে দেখা বা কথা হয়েছিল। মহিলার বাড়ী যেতে রাত হবে জেনে পিকলু তাকে হাসপাতালের রোগীদের খালী বেডে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল।

যাহোক, মহিলার অনুরোধে থানার অফিসার-ইন-চার্জ এএসআই কুদ্দুসকে তার কথিত বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেন। এএসআই কুদ্দুসের সাথে দেওয়া হয় অন্য এক এএসআই সফিকুল ও কনস্টেবল /৯২১ মেহেদী হাসানকে। তারা কচুয়া থানার জিডি নং-৭৯৭ তারিখ-১২/০২/২০১২খ্রিঃ মূলে প্রায় রাত সাড়ে দশটায়ি একটি টেম্পুযোগে তেলীগাতী গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

পুলিশ দলটি বহু কষ্টে রাতের বেলা মহিলাকে নিয়ে তেলীগাতী ইউনিয়নের মলমগাছা গ্রামে উপস্থিত হয়। কিন্ত, মহিলা তার বাবার বাড়ি সঠিকভাবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন সময় সে পুলিশদলকে বিভিন্ন ধরণের লোকেশন দেখায়। শেষ পর্যন্ত পুলিশদলটি মহিলার দেখানো মতে একটি বাড়ীতে গিয়ে বাড়ির লোকজনদের ডেকে তোলেন। গভীর রাতে কোন গৃহস্থ তার বাড়িতে পুলিশদলকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানোর কথা নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরক্তিসহ বাড়ির দরোজা খুলে লোকজন বাড়ির বাইরে বের হলে এক বৃদ্ধ লোককে দেখিয়ে মহিলা পুলিশকে তার বাবা বলে দাবী করেন। কিন্তু, বাড়ির মালিক মহিলাকে চেনেন না বলে দাবী করেনে। এইভাবে বাড়ির একাধীক পুরুষ ও মহিলাকে দেখিয়ে জেবুন্নেছা তার বাবা-মা দাবী করেন ও যথারীতি তারা সবাই জেবুন্নেছাকে চিনেন না বলে দাবী করেন।

এই অবস্থায়, পুলিশ দলটি গভীর রাতে মহিলাকে নিয়ে বড় অসহায় বোধ করে। একটি পুলিশদলে একটি মাত্র মহিলা অথচ তাদের সাথে কোন মহিলা পুলিশ সদস্য না থাকায় অনেকে বিষয়টি ভালভাবেও নিতে পারেন নি। অন্য দিকে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির ফলে মহিলাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় পুলিশদলটি এলাকার ইউপি সদস্য মোঃ আবুল কালাম আজাদের শরণাপন্ন হয়। আবুল কালামসহ অন্যান্য গ্রামবাসির পরামর্শে পুলিশদলটি মহিলাকে জনৈক চাঁন মিয়ার বাড়িতে রেখে থানায় ফিরে আসে। পুলিশদলটি থানায় আসার পর জনৈক কালাম শেখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এএসআই কুদ্দুসকে জানান, মহিলাটি চাঁন মিয়ার বাড়িতে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছে এবং মা ও মেয়ে সুস্থ আছে।

পরদিন কচুয়া থানার অফিসারগণ তেলিগাতি ইউনিয়নে গিয়ে জেবুন্নেছার বাবার বাড়ি খুঁজে বের করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে। কিন্তু, তারা তা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। অবশেষে তারা মহিলাকে তার সদ্যজাত সন্তানসহ থানায় নিয়ে আসে এবং বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।

ইতিমধ্যে মহিলার প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলে। মহিলা জানায় যে বাগেরহাট সদর থানার জনৈক দারোগাকে সে চেনে। সেই দারোগার সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় যে মহিলা প্রকৃতপক্ষে ভবঘুরে ও কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। কিছুদিন আগে তাকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে দণ্ড বিধির ১৯০ ধারায় অসামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রসিকিউশনের রেকর্ড থেকে তার সঠিক নাম ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেল।

তার প্রকৃত নাম জেবুন্নেছা লাকী (২৫), পিতা-আনোয়ার আকন্দ, গ্রাম-দক্ষিণ সন্যাসী (মল্লিকের বেড়) থানা- রামপাল, জেলা- বাগেরহাট। সে ২০০৬ সালে এইচ.এস.সি পাশ করে। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসের ৩০ তারিখ বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর জনৈক সদস্য পলাশ হাওলাদার, পিতা-শাহজাহান হাওলাদার সাং-বেতমোড়, থানা-মঠবাড়ীয়া, জেলা-পিরোজপুর-এর সাথে পিতা-মাতার অজ্ঞাতে জেবুন্নেছা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তার স্বামী বর্তমানে সাভার সেনানিবাস, ঢাকাতে কর্মরত আছেন। কিন্তু, জেবুন্নেছার অস্বাভাবিক আচরণের কারণে সে আজ স্বামী ও পিতা উভয় পরিবারে অচ্ছুত। হারিয়েছে।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মহিলাকে পুলিশ তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, অন্তঃস্বত্ত্বা হওয়ার কারণে তার বাবা মা তাকে পরিত্যাগ করেছে। কয়েক মাস থেকে কেউই তার খোঁজ রাখে নাই। এমনিতেই উচ্ছৃঙ্খলতা ও অস্বাভাবিকতায় জেবুন্নেছার পরিবার তার উপর যৎপরোনাস্তি বিরোক্ত, এর অতিরিক্ত একটি সন্তানসহ তার বাবা-মা তাকে গ্রহণ করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু, জেবুন্নেছার আচরণ যাই হোক না কেন তার পিতামাতা তাকে সন্তান হিসেবে অস্বীকার করতে পারল না। স্থানীয় মাতব্বর ও থানা পুলিশের চাপে তারা শেষ পর্যন্ত জেবুন্নেছাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হল। বাগেরহাট জেলা পুলিশ আপাতত একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেল।

উল্লেখ্য, তেলিগাতি গ্রামে চাঁন মিয়ার বাড়ি থেকে মেয়েটিকে আনতে গেলে স্থানীয় কয়েকজন মস্তান শ্রেণির লোক পুলিশকে তাদের উপর অযথা বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য গালাগালি করতে থাকে। এই নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন লোকের সাথে পুলিশের কথা কাটাকাটি হয়। এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে জনৈক সাংবাদিক কোন প্রকার খোঁজ খবর না নিয়েই পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠায়। অন্যদিকে দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক কালের কন্ঠের কেন্দ্রীয় সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিগণ কোন প্রকার বাছবিচার ছাড়াই পত্রিকায় খবরটি ছাপিয়ে দেয়।

একজন অসহায়, অন্তঃস্বত্ত্বা ও অপ্রকৃতিস্ত মহিলাকে সাহায্য করতে গিয়ে কচুয়া থানা পুলিশ একটি অস্বস্তিকর অবস্থায় জড়িয়ে পড়ে। থানায় কোন মহিলা পুলিশ না থাকায় তারা মহিলাকে তার বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছিল। কিন্তু, মহিলার অপ্রকৃতিস্থতা তারা প্রথমে উপলব্ধি করতে পারে নাই। মহিলার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে তারা নিজরাও অনিরাপদ হয়ে পড়ে।
পুলিশের দায়িত্ব পালনকালে এমন হাজার হাজার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে। এগুলোকে যেভাবেই মোকাবেলার চেষ্টা করা হোক না কেন পুলিশকে একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেই হবে। পাশ্চাত্য দেশের পুলিশ গবেষকগণ এইসব পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন, ' পুলিশী কাজের হেঁয়ালী' (Paradoxes of Police Works).

আলোচ্য ঘটনাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার ফলে জনগণের কাছে কচুয়া থানা পুলিশ বিশেষ করে এএসআই কুদ্দুস একজন ধর্ষণকারী পুলিশ অফিসার হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। যেহেতু এই বিষয়ে পত্রিকায় আর কোন ফলো-আপ প্রতিবেদন বা সংশোধনী প্রকাশিত হয়নি এবং পুলিশের কোন স্তর থেকেই এর প্রতিবাদ করা হয়নি, তাই একজন গর্ভবতী মহিলাকে ধর্ষণ করার মতো জঘণ্য অপরাধের মিথ্যা অভিযোগ থেকে পুলিশ আর কোন দিনই মুক্ত হতে পারবে না।

ব্যথিত চিত্তে তাই প্রশ্ন করি, আমাদের সাংবাদিকতার শরীর থেকে হলুদাভ রঙটি কি কোন দিনই মুছে যাবে না?

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলেই কী তা সত্য হতেই হবে?