বাণিজ্যিক ওয়াজের প্রসার ও প্রভাব!

শেখ আকবর কাদেরী
Published : 8 Feb 2017, 07:03 PM
Updated : 8 Feb 2017, 07:03 PM

প্রসার

'চুক্তিতে ওয়াজ করা যদি অনৈতিক বা বিদাআত হত, তাহলে দেশে এত মাহফিলের আয়োজন হত না', হায়ারের বক্তাদের অনেককেই এমন মন্তব্য করতে শোনা যায়! তাদের এই মন্তব্যের জবাব দেয়ার আগে কিছু আলোচনা আবশ্যক।

উপমহাদেশে এক সময় হিন্দু ধর্মের (হিন্দু ধর্মেও বিভিন্ন ভাগ থাকতে পারে আমি মূর্তিপূজকদের কথাই বলছি, তার ধর্মের নাম যাই হোক না কেন) প্রাধান্য বেশি ছিল বলে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইসলামের পূর্বকাল পর্যন্ত আমাদের পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। তাই তো বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতিতে হিন্দুনীয় প্রভাব অনেক বেশি (ইসলামের আবির্ভাব, ইংরেজদের আগমন, অর্থনৈতিক ও উচ্চশিক্ষার প্রভাবে হিন্দু সংস্কৃতির অনেক কিছুই ধীরে ধীরে ম্লান হওয়ার পথে যদিও)। আমাদের মাঝে প্রচলিত অসংখ্য কুসংস্কারের উৎপত্তি এখান থেকেই। হিন্দুদের বার মাসে তের পূজা, আর পূজা মানেই উৎসব। উৎসব মানেই ভালো ভালো ভোজনের আয়োজন ও মেহমানদের যাতায়াত, আর মেহমানের যাতায়াত মানেই অথিতি আপ‍্যায়ণ। আর এখান থেকেই বাঙালির অতিথি পরায়ণতা এবং উৎসব মুখরতার উৎস হওয়ার সম্ভবনা খুব বেশি।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাবের পর আমাদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা মুসলমান হলেও সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাবের ফলে তাদের ভেতরেও সেই কুসংস্কার, অথিতি পরায়ণ ও উৎসব মুখর স্বভাবের খুব একটা চিড় ধরে নি। ইসলাম অথিতি পরাণয়তাকে উৎসাহীত করলেও উৎসবের অনুমোদন করে কদাচিৎ। কারণ ইসলামের প্রধান মূলনীতিই হল ত্যাগ। যেমন-নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, অর্থাৎ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের প্রায় সবগুলোই ত্যাগের নজির। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমি যা জানি তোমরা যদি জানতে তাহলে হাসতে কম, কাঁদতে বেশি(বুখারী)। এই হাদিস থেকেও বোঝা গেল, মুসলমানের জীবনে উৎসবের প্রাধান‍্য কম। তাই তো দুই ঈদ ব্যতীত ইসলামে উল্লেখযোগ্য বড় কোনো উৎসব নেই বললেই চলে। কিন্তু বাঙালী যে উৎসবপ্রিয় জাতি, মুসলমান হলেই কি, সেই চিরাচরিত অভ্যাস কি সহজে ভোলা যায়? ভোলা যায় না বলেই হয়ত আমাদের দেশে এত মেলা, ওরস, যাত্রাপালা, গান-বাজনার আসরের আয়োজন এবং সর্বত্রই মুসলমানদের নির্লিপ্ত পদাচরণা। অথচ এগুলোর কোনোটিই ইসলাম অনুমোদন করে না। তারপরও আমরা যাচ্ছি-তাহলে আমরা কেমন মুসলমান? ঐ যে বললাম, ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া চিরাচরিত স্বভাব। (শুধু তাই নয়, ইসলামে মূর্তির কোনো স্থান নেই। তারপরও লালনের মূর্তি ভাঙ্গার পর তথাকথিত কিছু মুসলমান তার প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিলও করেছে!) কিন্তু হঠাৎ করেই এসব উৎসবের গায়ে কুঠারের কোপ পড়ল-দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটল। বোমা বিস্ফরিত হল মেলায়, ওরসে, সিনেমাহলে, গান-বাজনা আসরে, কিছু মানুষ মরল আর বাকীদের মনে সৃষ্টি হল আতঙ্ক। বন্ধ হয়ে গেল গ্রাম এলাকার বহু বাৎসরিক মেলা, ওরস ও গানের আসর। কিন্তু আমাদের কী হবে? আমরা যে উৎসবপ্রিয় মানুষ?

শিক্ষার মান যাই হোক না কেন একজন অন্ধও অস্বীকার করতে পারবে না যে, দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে সবক্ষেত্রেই। প্রাসঙ্গিক বলেই আমি মাদ্রাসা শিক্ষার কথা বলছি-যদি শুধু কওমি মাদ্রাসার কথাই বলি, তাহলে দেখা যায় ২০১৩সালে ৭টি শাখায় ৫৫,৬৫৪ জন কেন্দ্রীয় (বেফাক) পরীক্ষার্থী ছিলেন, যা ২০১৬তে এসে সালে ৮৬,১৭০ জনে দাড়িয়েছে। অর্থাৎ তিন বছরের ব‍্যবধানে কেবল কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩০,৫১৬ জন। অতএব আলেম বাড়ুক আর নাই বা বাড়ুক, কিন্তু দেশে যে মাওলানা ও মুফতি টাইটেলধারী বিপুল পরিমাণের ওয়াজেইরের (ওয়াজকারী) পডাকশন হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। 'উৎপাদন বাড়লে জিনিসের মূল্য কমে' এটি চির চেনা প্রবচণ হলেও, ওয়াজেরের বেলায় ঘটেছে উল্টোটি। ওয়াজেইরের সংখ্যা বাড়লেও তাদের হাদিয়ার (এখন আর হাদিয়া নেই, কারণ মাওলানা সাহেবরা এখন চুক্তিতে আসেন। তাই ফি বলাই সত্য) পরিমান কিন্তু কমে নি বরং বেড়েছে অনেকগুণে। কেন? কারণ হল, মাদ্রাসার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশে মৌসুমী মাহফিলের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণে। আগে শীতকাল এলেই গ্রাম এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় গান-বাজনার মঞ্চ বা প্যান্ডেল দেখা যেত, এখন আর ওসব তেমন নজরে পড়ে না। এখন শুধু দেখা যায় ওয়াজ মাহফিলের প্যান্ডেল। এগুলো নিরাপদ, এখানে জঙ্গিদের বোমা মারার আশঙ্কা নেই মোটেও। আমরাও খুব যাচ্ছি-শুনছি, জিলাপি-বাদাম খাচ্ছি, সময় কাটাচ্ছি। কারণ আমরা উৎসবপ্রিয় মানুষ!

আয়োজনের খরচ যেহেতু বেড়েছে এবং সেই খরচ সরকার কিংবা কোনো সংস্থাও যেহেতু বহন করে না, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে- এই বিপুল পরিমানের ওয়াজ মাহফিলের অর্থের উৎস কি? কোথায় থেকে আসে এই টাকা? এক বাক্যে উত্তর, সাধারণ মানুষের পকেট। কেউ যদি ভেবে নেয় এসব মাহফিল আয়োজনের নিতান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে হেদায়েত করা তাহলে সে ভীষণ ভুল করবে। কেবল পারবারিক ভাবে যেসব মাহফিলের আয়োজন করা হয়, ওগুলো বাদ দিয়ে বাকী সব মাহফিল আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, আয়োজকদের ইনকাম। এটা মসজিদের নামে হচ্ছে, মাদ্রাসার নামে হচ্ছে-মাহফিলের নাম করে এই হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাদের টাকা তোলার জন্যে বিভিন্ন লোকসমাগমে পাঠিয়ে দিচ্ছেন মাদ্রাসার শিক্ষক সাহেবেরা! বিশ্বাস না হলে, এখন শীতকাল চলছে-গ্রাম এলাকার যে কোনো বাজারে দেখুন-কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচটি টাকা কালেকশন গ্রুপ আপনার চোখে পড়বে! টাকার এক অংশ দিয়ে মাহফিলের আয়োজন করা(অর্থাৎ মাওলানা হায়ার করে এনে বাউলগানের মত পছন্দমত টপিক দিয়ে হাদিসের নামে কিছু কিচ্ছা-কাহিনী শোনা)। আর বাকীটা কমিটির ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করা।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল, মাহফিলের আয়োজন অত্যন্ত সহজ একটি ব্যাপার। যে বা যারা এর আয়োজন করে তাদেরকে না নিজের পকেট থেকে এক টাকা খরচ করতে হয়(উল্টো বোধ হয় কিছু পকেটে ওঠেই)। না কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। (ভুল-ভাল হাদিস, তফসির করলেও) না কারও কাছে জবাবদিহী করতে হচ্ছে। না বক্তাকে কোনো কর্তৃপক্ষের সনদ হাসিল করতে হয়! এমন সহজ লভ্য জিনিসের প্রসার ঘটবে না তো কি হবে? আশা করি উপরোক্ত মন্তব্যের সমুচিত জবাব হয়েছে। না হয়ে থাকলে বলুন তো, কুরানের এই আয়াত সম্পর্কে আপনার বক্তব‍্য কী?
اتَّبِعُوا مَن لاَّ يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُم مُّهْتَدُونَ

এমন আয়াত আরো ৬টি সূরায় আছে, ওগুলো থেকে কী শিক্ষা নিয়েছেন?

প্রভাব
গত বছর বেশ কয়েকটা মাহফিলে ওয়াজ শুনেছি। আমার সঙ্গি ছিল আমার দুই বাল্যবন্ধু। আফসোসের বিষয় আমার ঐ বন্ধুদ্বয় মাহফিল শেষে বাড়ি ফিরে ফজরের নামাজ না পড়েই শুয়েছে রোজ (আল্লাহ ওদেরকে হেদায়েত দিন)। শ্রোতা বাড়ি ফিরে ফজরের নামাজ পড়ুক আর না পড়ুক, মাহফিলে লোকসমাগম যে আগের তুলনায় অনেক বেশি ঘটে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেন ঘটে? তাহলে কি আগতরা সবাই হেদায়তের আশায় আসছে? যারা আসছে, শুনছে, তারা সবাই কি হেদায়েত হচ্ছে? হেদায়তের মূল ভাবার্থ হল, অন্তরে আল্লাহর ভয় ঢুকে যাওয়া। যখন কোনো মানুষের হৃদয়ে সর্বক্ষণ আল্লাহর ভয় থাকবে তখন ঐ লোকটি কিছুতেই অন্যায় করতে পারবে না। অর্থাৎ হেদায়েত প্রাপ্ত কখনো অন্যাকারী হতে পারে না-এটা হল হেদায়েতের সবচেয়ে বড় লক্ষণ। এছাড়া দ্বীন-ই বিধি-বিধান তো মেনে চলবেই। সবাই নয়, যদি মাহফিলে আগতদের একটা অংশও হেদায়েত প্রাপ্ত হত তাহলে আমাদের সমাজের চিত্রটা সত্যি বদলে যেত। কিন্তু বদলেছে কি? আমি আমার এলাকার কথা বলছি, মানুষে মানুষে প্রতিহিংসা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আপনার এলাকার খবর কি? যে হারে মাহফিলের সংখ্যা বেড়েছে সেই হারে যদি হেদায়েতপ্রাপ্তের সংখ্যা বাড়ছেই তাহলে দেশে চুরি, নেশা, গুম, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা এত বেশি ঘটছে কেন? ১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জন (এদের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে)।

বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জন(যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে)। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে। (তথ‍্য প্রথম আলো'২৯মার্চ২০১৬)। উপরের পরিসংখ‍্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে, দেশে দিন দিন অপরাধের সংখ‍্যা বাড়ছে! এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে আপনার বাণিজ‍্যিক হেদায়তের চিত্রটি কোথায় গেলে দেখতে পাব?
এত ধর্ষণ আর হত‍্যা কারা করছে? ইসলামে তো এদের স্থান নেই। হেদায়েত গেল কোথায়?

আসল কথা হল, আমরা যারা ওয়াজ শুনতে যাচ্ছি আর আমাদেরকে যারা ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কারোর মূল উদ্দেশ্য দ্বীন প্রচার, প্রসার তথা মানুষের হেদায়ত নয়। বক্তার লক্ষ্য হল- এক থেকে দেড়ঘন্টা ওয়াজের বিনিময়ে চল্লিশ হাজার টাকা (বক্তাভেদে কম বেশিও আছে), আয়োজক কমিটি যদি মাদ্রাসাওয়ালা হয়-তাহলে তাদের লক্ষ্য মাদ্রাসার জন্য কিছু সঞ্চয় করা। মসজিদের পক্ষ থেকে হলে, মসজিদের জন্য সঞ্চয় করা। আর আমরা যারা শুনতে যাই তাদের উদ্দেশ্য আরও ভ্যারাইটিজ। কেউ কেউ যাই কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া রাতের বিনোদনের কিঞ্চিত স্বাদ নিতে, কেউ যাই সময় কাটাতে, আর মুষ্টিমেয় কিছু লোক যায় দ্বীনি আলোচনা শুনতে (এদের ইচ্ছা কতটুকু পূরণ হয় তা আল্লাহই ভালো জানেন)। এতসবের পরও আমরা বলছি-আমরা দ্বীন প্রচার করছি? এক থেকে দেড়ঘন্টা ওয়াজ করে চল্লিশ হাজার টাকা গুনে নিচ্ছেন (কেউ কেউ বিকাশের মাধ্যমে অগ্রিমও নেয়), এটা কোন ধরনের দ্বীন প্রচারের নমুনা? রাসূল (সাঃ) ও সাহাবী কেরাম (রাঃ) কি এভাবে দ্বীন প্রচার করতেন (আপনি রাসূলের নীতির বাইরে গিয়ে তার আনিত দ্বীন কিভাবে প্রচার করছেন নিজের খেয়াল খুশিমত)? তারা তো পেটে পাথর বেঁধে দ্বীনের জন্যে খেটেছেন! আর আপনি সেই দ্বীনকে পূঁজি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছেন আর প্রাইভেটকার হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!