‘ইতিহাসের প্রয়োজনে কখনও তাদের প্রতিহত করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে’

শিউলী জাহান
Published : 20 Dec 2017, 01:54 PM
Updated : 20 Dec 2017, 01:54 PM

'একাত্তরের স্মৃতিকথা এবং তারপর' গ্রন্থটি মূলত মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা বাহাউদ্দিন এর হৃদয় নিংড়ানো সত্যকথন। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর দেশের পরিস্থিতি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্য দলিল। বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ নিয়ে লেখা তার আত্মকথামূলক লেখার শেষ অধ্যায়। খুব সংক্ষিপ্ত আকারে পুরো প্রেক্ষাপটের উপর আরেকটিবার চোখ বুলিয়ে ফিরে দেখা। বইটি পড়তে পড়তে দেখেছি একটি দেশপ্রেমিক মন কী ভীষণ আবেগ, নীতি ও নিষ্ঠা এবং চিত্তের দৃঢ়তা নিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রটি হৃদয়ে ধারণ করে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশে, প্রবাসে, সর্বত্র।

বাংলাসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে লেখা হয়েছে এবং লেখা হচ্ছে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। কিন্তু শুধু সাহিত্য থেকে প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। লেখক আহমদ ছফা এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে লেখা সাহিত্যে যুদ্ধের জীবন অনুপস্থিত।" তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, "একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যে ইতিহাসে আত্মপরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে সে জিনিসটিই উপেক্ষিত থেকে গেছে। সেই মহাবেদনা, মহাউল্লাস, মহাউত্থান- এই সকল রচনাতে পরিদৃশ্যমান নয়।" (আহমদ ছফা, মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সাহিত্য: অপূর্ণতার দিক, মানব জমিন)।

একটি যুদ্ধের যথার্থ ইতিহাস পাওয়া যাবে যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের সত্য বিবরণ ও সাক্ষ্য থেকে। আর তাই সঠিক ইতিহাস রচনার লক্ষ্যে ফরাসী বিপ্লবের পর অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই পন্থাকে বেছে নেয়া হয়েছিল। আমাদের দেশেও এ ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শী, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ইতিহাস রচনার লক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। কিন্তু সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি সেই সব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ।

একজন মুক্তিযোদ্ধার দায়বোধ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা বাহাউদ্দিন রচনা করেছেন তার আত্মজীবনী এবং আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসগুলো। খুব ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে একটা লেখা লিখার ইচ্ছা অনেকদিন থেকে। লিখব লিখব করে লেখা হয়নি। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধার কাজকর্ম স্বচক্ষে দেখেছি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, পাকিস্তান ফেরত পাকিপন্থিদের কর্মকান্ড এবং ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তির মুখোশের অন্তরালে ছিল পাকি মনোভাব। পাকবাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করে, স্বাধীন দেশে সেইসব মানুষের সাথে যুদ্ধ করে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে প্রবাসে পাড়ি দিতে বাধ্য হই।"

দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর প্রবাসে সুবিধাভোগী অমুক্তিযোদ্ধাদের আগ্রাসন দেখে তিনি "কখনও তাদের প্রতিহত করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, ইতিহাসের প্রয়োজনে"- এই চেতনায় জাগ্রত হয়ে লেখনী দিয়ে প্রতিবাদের পথ বেছে নেন। সচেষ্ট হন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে।

একাত্তরের স্মৃতিকথা এবং তারপর গ্রন্থটি তিনি শুরু করেছেন ৭১ এর ২৩ মার্চ থেকে। সেই ভয়াল কালো রাত বলে আখ্যায়িত ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের দু'দিন আগে তার ঢাকা ছেড়ে আসার স্মৃতিচারণ দিয়ে। তখন অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে। সারাদেশ জুড়ে খন্ড খন্ড আকারে চলছে সমাবেশ এবং মিছিল। সেই সাথে সমাবেশ, মিছিলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর আক্রমণ, গুলি ও ধরপাকর। বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র অসন্তোষ, পরস্পরকে হত্যা ও পাল্টা হত্যা।

কাহিনির শুরুতেই তিনি বলেন, তার কর্মস্থল তৎকালীন স্টেট ব্যাংক (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) অবাঙালি বিহারী অফিসারদের বাঙালি অফিসারদের প্রতি তাচ্ছিল্য মনোভাবের কথা। যেটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। "বাঙালির প্রতি তাদের দুর্ব্যবহারই আমাকে ঝগড়াটে করে তুলেছে। বিহারীদের প্রতি একটা বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে" – তাই দাগী ঝগড়াটে হিসেবে খ্যাত হন। এই কারণে অবাঙালি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সফিউল আলমের সাথে তার কথা কাটাকাটি এবং একপর্যায়ে চেয়ার ছুঁড়ে মারলে সে আহত হয়। যার রেশ তাকে পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে পেতে হয়েছে স্বাধীন দেশের অফিসারদের পাকিস্তানপ্রীতি এবং স্বজনপ্রীতির জন্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ জনসভায় যখন সবকিছু বন্ধ করে দেবার কথা ঘোষিত হলো, তখন তিনি ব্যাংক বন্ধ থাকবে জেনে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামের বাড়ি কসবা চলে যান। এরপর ঘটনার স্রোতে সময় বয়ে যায় খুব দ্রুত। সেখানে ২৬ মার্চ সকালে জানতে পারেন আগেরদিন রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যাযজ্ঞের কথা।

"আকাশবানী ঘুরাতেই অতি পরিচিত দেবদুলালের কন্ঠে ভেসে এল, 'বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে….' আমার হাতের পিঠা হাতেই রয়ে গেল। একি হল! তাহলে রুখে দাঁড়িয়েছে! আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ার থেকে উঠে পায়াচারি করছি। কি হল! কি হল!" ঢাকা পরিণত হয়েছে বধ্যভূমিতে! এই প্রথম দিকে পরিস্থিতি বুঝতে না পারায়, কোনো ঘোষণা ও পূর্ব পরিকল্পণা না থাকার দরুণ একটি অসহায় দোদুল্যমান অবস্থায় মানুষকে পড়তে হয়েছিল। কীভাবে, কোত্থেকে শুরু করবে! তাই তিনিও গ্রামের পরিচিতজনদের সাথে সিদ্ধান্ত নেন, কাছেই আগরতলা বর্ডার, সেখানে যেয়ে ইতিমধ্যে যারা সেখানে যুদ্ধের কাজ শুরু করেছে তাদের সাথে আলোচনা করে বুঝে নেয়া।

পরদিন ২৮ তারিখ সকালে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা মেজর জিয়াউর রহমানের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনেন। গ্রন্থটির এই খণ্ডে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে দেয়া তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা যা নিয়ে আজও বিতর্ক বিদ্যমান। "আমি খাচ্ছি আর রেডিওর নব ঘুরাচ্ছি। দেখি নতুন কিছু কোথাও পাওয়া যায় কি-না। ঘুরাচ্ছি আর কান পেতে আছি। হঠাৎ একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল, "এন এপীল টু দ্য ওয়ার্ল্ড…." রেডিওটা কানের কাছে নিলাম। এবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম, "এন এপীল টু দ্য ওয়ার্ল্ড, উই আর এট ওয়ার, প্লিজ হেলপ আস, দিস ইজ মেজর জিয়া, অন বিহাফ অফ শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ।" সাথে সাথে বাংলায় বলছে, "আমি মেজর জিয়া বলছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে…."।

তারা যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। চলে যান ভারতের আগরতলা। দেখেন সেখানকার পরিস্থিতি। প্রত্যক্ষ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও দলীয় নেতাদের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক কর্মকান্ড। আগরতলা শরণার্থী ক্যাম্পে মানুষের দুর্ভোগ। ভারতবাসীদের সহযোগিতা। – "তখন ভারতের মানুষগুলোও যেন বদলে গেল, কার বাঁশ কে নিচ্ছে, কার ছন কোথায় যাচ্ছে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করছে না। এ যেন সকলের এজমালি সম্পত্তি।" আসলে একটি যুদ্ধ জয় তো একক কিংবা কিছু মানুষের কৃতিত্ব হতে পারেনা। তার পিছনে থাকে হাজার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহযোগিতা ও অবদান। কোনো অবদানকেই অবহেলা করার নয়।

আবার দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও তিক্ততায় পরিলক্ষিত করেছেন নিজের দেশের কিছু সুবিধাবাদীর যুদ্ধের জন্য প্রাপ্ত ভারতের দেয়া অর্থ সাহায্য নিয়ে দুর্নীতি ও চুরি। ইয়ুথ ক্যাম্পে এবং যুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাৎ এবং প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থাপনায় চরম জালিয়াতি। এই সব সুবিধাভোগীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সেখানে আরাম আয়েশ করে যুদ্ধ পরবর্তিতে দেশে এসে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব নিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ এবং সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা করে বড় নেতা বনে যাওয়া। তিনি লিখেছেন, "সেই সময় বেশিরভাগ নেতারা হোটেলে থাকতেন না। তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন অনেক শান-শৌকতে।… স্বাধীনতা তাদের কাছে গৌণ। তাদের খাওয়া দাওয়া বাজার সদাই চালচলন দেখলে মনে করার কোন উপায় ছিল না তারা ভিনদেশে শরণার্থী, স্বল্পকালের জন্য। তারা রিলিফ খাচ্ছে, রিলিফের টাকা মারছে, যার রেশ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও চালু হলো।"

গ্রন্থটিতে যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনার বর্ণনায় তিনি কিছু তিক্ত সত্য উল্লেখ করেছেন। যখন দেশ গড়ার সময় তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা, পাতি নেতা, যারা যুদ্ধ করেছেন আর যারা করেননি তাদের অনেকেই খেতাব এবং স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে শুরু হয় তাদের চরম উত্তেজনা ও ভাগাভাগি। অরাজকতা, লুটতরাজ। পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র চলে যায় বেহাতে। অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা নাম ধারণ করা থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে সব ধরনের ফায়দা লোটা শুরু হয়। তারাই বর্তমানে কোটিপতি হাজী হয়ে সমাজের মুরুব্বি হিসেবে পরিচিত। এমনি অনেক মুখোশের আড়ালের কিছু অজানা তথ্য তিনি উন্মোচন করেছেন। সেইসাথে পাকিস্তান প্রত্যাগত বাংলাদেশি যারা যুদ্ধের পুরো সময়টি পাকিস্তানে কাটিয়ে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ নিয়ে লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থে যে বিষয়টির অবতারণা খুব একটা দেখা যায়নি। বস্তুত যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে যেন শুরু হয় নতুন জেগে উঠা চর দখলের প্রতিযোগিতা।

লেখক মোল্লা বাহাউদ্দিন একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে সংক্ষেপে হলেও এ বিষয়গুলোর একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তিনি নিজেও তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন এবং তার অজ্ঞাতে তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি নিয়ে পরিচিত অনেকেই তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির কাজে লাগিয়েছে। লেখকের ভাষায় – "মানুষের নৈতিক চরিত্রের স্খলন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই। আজ যার ফলাফল দেখতে পাই একজন মেথর কোটি কোটি কোটি টাকার মালিক। একজন পিয়ন হয়ে যায় ডজনখানেক বাড়ির মালিক। একজন কাজের লোক হয়ে যায় কয়েকটা টেলিভিশন কোম্পানির মালিক, চায়ের দোকানের ছেলেটা হয়ে যায় দেশের বড় নেতা, কোটি কোটি টাকা এবং বিপুল সম্পদের মালিক।"

একজন দেশপ্রেমী, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই দুষ্কর্ম ও শঠতা তার পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তাই নিজের ভিতরের একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার আদর্শ, সততা ও নীতিকে বিসর্জন দিতে না পারায় এবং তার কর্মস্থল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মিথ্যা মামলায় হেনস্থার শিকার হলে দুঃসহ অবস্থায় প্রিয় দেশটির চৌকাঠ পেরোতে বাধ্য হোন। অনেক কষ্ট, আত্মত্যাগ এবং প্রাণের বিনিময়ে যুদ্ধ করে দেশটিকে স্বাধীন করার পর, সেই দেশকে ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা যে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কতটা অসহনীয় তা শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই উপলব্ধি করতে পারবে।

পরবর্তীতে তিনি আমেরিকা এবং তারপর কানাডার মাটিতে পা রাখেন। এখানেও প্রত্যক্ষ করেন মুক্তিযোদ্ধা নাম ধারণ করে এবং বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের নামে অমুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের প্রবাসী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠা। যার পর নাই বিস্মিত হন কানাডায় 'মহা মুক্তিযোদ্ধা' খেতাবে ভূষিত চল্লিশোর্ধ মুক্তিযোদ্ধা দেখে। পর্যবেক্ষণ করেন এতোসব মেকি মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের লুপ্ত অস্তিত্ব। নিজের মনের সাথে নিরন্তর যুদ্ধ, অসত্যের দহন এবং যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুটা হলেও প্রতিবাদ করা। উদ্যোগী হলেন প্রবাসে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় প্রকাশ এবং দেশ ও মাটির স্বার্থে তাদের স্বীকৃতি প্রদান। একে একে লিখেন উপন্যাস 'সীমান্ত সংবাদ', 'কালোরক্ত'। 'কালোরক্ত' উপন্যাসটিতে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থানকালীন সময় এবং সেখানে রাজাকারদের কার্যকলাপকে তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ ছয় বছর গবেষণা করে লিখেন 'স্বপ্ননগরী নিউইয়র্ক'।

কানাডায় জীবনের শেষ দিনগুলোতে কিছুটা নিভৃতচারী হয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল। 'একাত্তরের স্মৃতিকথা এবং তারপর' গ্রন্থটি লেখার আগে লেখক মোল্লা বাহাউদ্দিন স্ট্রোক আক্রান্ত হলে তিনি দৃষ্টিশক্তি এবং স্মরণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেও স্মরণশক্তি তাকে আর সহায়তা করছিল না। কিন্তু সত্যটুকু জানিয়ে যাবার অদম্য আকাঙ্ক্ষা থেকে অসুস্থতার মাঝেও তার এই প্রয়াস। তাই কিছু তথ্যের ঘাটতি বইটিতে লক্ষিত হয়েছে এবং তিনি নিজেই ভূমিকাতে সেটি উল্লেখ করেছেন। মূলত গ্রন্থটিতে তিনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের গঠন, দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী পরিণতি এবং মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী শক্তির উত্থানের বিষয়টিকেই প্রাধাণ্য দিতে চেয়েছেন।