সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি

শিপা সুলতানা
Published : 12 May 2015, 07:36 PM
Updated : 12 May 2015, 07:36 PM

আমাদের বড়বোন একজন সনাতন বাড়ির বউ। আমাদের বড়মা তাকে মেয়ে বানিয়েছিলেন,মহাজন বাড়ির বউ হয়ে আসার পর। আগে খুব চল ছিল নতুন বউ বাড়ি আসার পর ধর্মের মা,বাবা,ভাই,বোন,এটা ওটা ডাকানো। বাপের বাড়ি বহুদূর ফেলে এসে একটা মেয়ে যেন সম্পূর্ণ আথারে না পড়ে তাই ডাকানুর হিড়িক পড়ে যেত! সেই সুত্রে আমরা তারও বোন হই। কী নাম ছিল এখন জানিনা, সবাই ডাকে উষার মা,আমরা দিদি।  বাড়িতে যখনই মেহমানদারি হত,আমাদের হাতে মিষ্টি মিঠাই দিয়ে বিকালে পাটিয়ে দেয়া হত তাদের বাড়ি, আশুদ্দাকে দাদা ডাকলেও উনি শালিকা ভেবেই রসিকতা করতেন। অনেকদিনতো ভয়েই তাদের বাড়ি যাইনি। অনিলদার কারণে। ভাইয়ের শালীকে নাকি বিয়ে করার নিয়ম আছে সমাজে…।

তাদের বাড়িতেও প্রচুর ফলের গাছ। তবু আমকাঁঠালি পাঠানো হত। রমজানে সব মেয়ে সম্পর্কীয়দের বাড়ির সাথে সাথে তার বাড়িতেও খেজুর,মিষ্টি,জিলাপি পাঠাতেন বাবা। ঈদ এর সময় গ্রাম বেড়ানোর তালিকায় অবশ্যই মহাজন বাড়ি থাকতো। আমাদের সব দাদিদের বৈকালিক বেড়ানুতে সেই সব বাড়িও রুটিনে ছিল। চাচাতো বোনদের বিয়ের পর জামাই নিয়ে দাওয়াতে যেতে হত তাদের বাড়ি। আসাম থেকে এসেছিলেন মিন্টুদ্দা, এসেই মরণপন প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের।

সন্ধ্যার সময় মা-চাচীরা মাছ কুটছেন,সবজি কাটছেন আর তাদের পাশে বসে তরুণ মিন্টুদ্দা দুনিয়ার গপ ঝাড়ছেন। আসামের বন ভর্তি মায়াবী ডাকিনিতে…ভুলেও যেন আমাদের বাবা-চাচারা সেদিকে না যায়। গেলে আর শুকিয়ে কাঠ না হয়ে ফিরছে না। আমরা কাছে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। বাপের বাড়িতে কোনো গোপন সংবাদ পাটাতে মিন্টুদ্দাই ছিল মা-চাচীদের ভরসা। নান্টুদদার সাথে পালিয়ে আসছেন সন্ধাবৌদি। বিয়ের পর আমার চাচাত বোন তাকে বোন ডেকেছে। তাই ভোটের সময় সবাই তাকে দাঁড় করিয়ে দিল, এবং পাশ করিয়ে আনলো নিজেদের মেয়ে হিসাবে। বাবার গদিতে বসে নরক গোলজার করা। লন্ডন-আমেরিকার সংসদে নাক গলানো, টিভিতে কিংবা পত্রিকায় কোনো একটা খবর পড়ে তর্ক-বিতর্ক করে কাস্টমার ভাগিয়ে দেয়া। দিনশেষে হোটেলের বিল তোলা ৯০/৯৫( তখন চা'র কাপ ১ টাকা), বাবার সেইসব বন্ধুদের মাঝে সেন কাকা, কল্যাণ কাকা,ধলা কাকারাও ছিল,নিয়ম করে দূর্গা পূজাতে চাঁদা দিতেন বাবা, সফেদ চাচা, রহমান চাচারা, একবার কেঁদেকেটে পূজায় পরবো বলে একটা ফ্রক ও আদায় করে ছিলাম বাবার কাছ থেকে, সেই বাবা, যিনি ৮ বছর বয়সে নামাজ ধরে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত মাত্র দুই ওয়াক্তের নামাজ কাজা করেছেন।

যতোবার দেশে যাই,হয়ত রক্ত সম্পর্কীয়দের সাথে দেখা করার সময় হয়ে উঠেনা, তবু বাবা-মার কাছে সন্তানদের রেখে একদিন হলেও দেখতে যাই শৈশবের কাকি পিসি কাকা দাদাদের, কেউ জড়িয়ে ধরেন,কেউ পাশ ফিরে চলে যান…কারো কারো চোখে বিতৃসনা… কান্না গোপন করে ফিরে আসি..ব্যর্থতা উপলব্ধি করি..  সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি,কী করে হারিয়ে ফেললাম সব…।