বেশ কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যম আর সোশাল মিডিয়ায় কৃষকের দুর্গতির অবস্থা তুলে ধরা হচ্ছে। বোরো ধানে কৃষকের যে ক্ষতি গুণতে হচ্ছে সেটা নিয়ে মানুষের আলোচনার শেষ নেই।
একজন প্রান্তিক পর্যায়ের চাষী হিসেবে আমি মোটামুটি ধারণা রাখি এসব বিষয়ে। খরচ কেমন হচ্ছে, লাভ কেমন হচ্ছে তার একটা গড় হিসাবও দিতে পারি। মণ প্রতি ধানের উৎপাদন খরচ বের করতে না পারলেও ৩৩ শতাংশের এক বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করতে আমাদের যশোর অঞ্চলে কত খরচ হয় তার একটা হিসাব দেওয়া হলো এখানে।
এক বিঘা জমি রোপনের জন্য আমরা এক কাঠা জমিতে পাঁচ কেজি ধানের বীজ ফেলি পাতার (ধানের চারা) জন্য। মোটামুটি বেশি প্রচলিত আঠাশ ধানের হিসাব যদি করি তাহলে খরচটা নিচের মত হবে।
বীজ ধান ৫ কেজি = ২০০ টাকা
পাতাখোলা চাষ = ১৫০ টাকা
পাতার জন্য সার = ১০০ টাকা
সেচ খরচ = ২০০ টাকা
জমি চাষ = ৯০০ টাকা
মই দেয়া = ২০০ টাকা
ধান রোপন = ১৩০০ টাকা
ঘাসের ওষুধ = ৫০ টাকা
নিড়ানি (সর্বনিম্ন) = ১২০০ টাকা
সেচ খরচ = ২৫০০ টাকা
টিএসপি ২০ কেজি = ৪৬০ টাকা
পটাশ ২০ কেজি = ৩০০ টাকা
ইউরিয়া ৪০ কেজি = ৭০০ টাকা
দস্তা ২ কেজি = ৫৫০ টাকা
থিয়েভিট ১ কেজি = ২০০ টাকা
কীটনাশক = ৩০০ টাকা
ধান কাটা+বাধা = ৩০০০ টাকা
বাড়িতে আনা = ৮০০ টাকা
ধান ঝাড়া মেশিন ভাড়া = ২০০ টাকা
ধান ঝাড়া মজুর = ১৮০০ টাকা
————————————————–
মোট খরচ = ১৫,১৫০ টাকা
যারা গভীর নলকুপ ছাড়া ডিজেল চালিত সেলো মেশিনে সেচ নিয়ে থাকেন তাদের সেচ খরচ ৫ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এই হিসাবে নিড়ানি খরচ মজুর প্রতি ৩০০ ধরা হয়েছে এবং মাড়াই এর সময় ৬০০ ধরা হয়েছে। এছাড়া কৃষকের নিজস্ব শ্রমের কোনো মূল্য ধরা হয়নি। যেমন জমির আইল বাধা, সার ছিটানো, কীটনাশক স্প্রে করা ইত্যাদি।
এক বিঘা জমিতে আমাদের এদিকে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ মণ ধান জন্মায়। আমি গড়ে ২২ মণ ধরলাম। এবার আমি আঠাশ ধান বিক্রি করেছি ৬৩০ টাকা মণ প্রতি। তাহলে ২২ মণ ধানের মূল্য দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৬০ টাকা। এছাড়া বিঘাপ্রতি দেড় কাউন বিচুলি (খড়) বিক্রি করেছি ১২০০ টাকা।
তাহলে মোট বিক্রি হচ্ছে (১৩৮৬০+১২০০= ১৫০৬০) ১৫ হাজার ৬০ টাকা।
তাহলে নিট লস দাঁড়ালো ৯০ টাকা। এই আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে আরো যোগ হবে নিজের শ্রম এবং জমির নগদ মূল্য হিসেবে যে টাকা ইন্টারেস্ট আসার কথা। আর যারা জমি বর্গাচাষ করে তাদের ক্ষতির হিসাবটা বোধহয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমার কিছু জিরে মিনিকেট ধানও ছিল। যা বিক্রি করেছি ৮১০ টাকা মণ। ফলন একটু কম হলেও দামে পুষিয়ে গেছে। আর এই ধানে লাভও হয়েছে। তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।
এবার আরেক হিসেব করে নেওয়া যাক। এক মণ আঠাশ ধান থেকে সাধারণত ২৭ থেকে ২৮ কেজি চাল আসে। আর ধান থেকে চাল বানানোর খরচটা কুড়ো এবং খুদ থেকেই উসুল হয়ে যায়।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে আর্থিক ভাবে ক্ষতি হওয়ার পরও কৃষকরা কেন বোরো ধান আবাদ করছে?
কোনো কাজে এমন ক্ষতির মুখে পড়া মানে এই না যে কাজটা ছেড়ে দিতে হবে। বরং আমাদের সেই ক্ষতির কারণ উদঘাটন করে কীভাবে লাভ করা যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ।
ধানের মূল্য নিয়ে আমরা অনেকেই সরকারের সমালোচনা করি, কেন ধানের দাম বাড়ছে না তা নিয়ে সরকারকে দোষারোপ করি। এই সমালোচনা কিংবা দোষারোপের আগে আমাদের ভাবতে হবে এই সরকার কৃষকের জন্য কী করছে?
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খুব কম মানুষেরই আয় এবং ব্যায়ের সামঞ্জস্য আছে। আমাদের দেশে এমনিতেই চালের মূল্য বেশি, এখন আবার কৃষকের ধানের মূল্য বেশি দিতে গিয়ে যদি চালের দাম বেড়ে যায় তাহলে চাল কিনে খাওয়া গরীব-মধ্যবিত্ত মানুষগুলো বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। যেহেতু ধানের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না সেহেতু কৃষক বাঁচাতে উৎপাদন খরচটা যদি কমানো সম্ভব হয় তাহলে হয়তো কৃষক কোনো মতে বাঁচবে।
এছাড়া কৃষকদের জন্য সরকার থেকে যেসব প্রণোদনা, ভর্তুকি প্রদান করা হয় সেগুলোর যেন সুষ্ঠু বন্টন হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
উৎপাদন খরচ কমাতে তিনটা বিষয় চিহ্নিত করা যেতে পারে- সার, শ্রমিক এবং সেচ।
আমরা কৃষকরা যে দামে সার কিনছি সেটা কিন্তু ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভর্তুকি দেওয়ার পরেই। আর সেচের জন্য বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি মাইনাস করে দেওয়া হয়। আর বাকি থাকলো শ্রমিক। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকের মূল্য কমানোর কোনো উপায়ই নেই, তবে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
শ্রমিক মজুরি বাড়ানোতে আমাদের যে ক্ষতি হচ্ছে সেটারও স করার ব্যবস্থা করেছে সরকার। ধান লাগানো মেশিন, ধান কাটা মেশিন, মাড়াই করা মেশিন, কিংবা কম্বাইন্ড হারভেস্টার (কাদায়/শুকনায়) ক্রয়ে হাওড় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে; যেসব এলাকা হাওড় এলাকা নয় সেখানে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
উৎপাদন কাজে যদি এইসব মেশিনের ব্যবহার সুনিশ্চিত করা যায় তাহলে কিন্তু বোরো ধানে শ্রমিকের মজুরি ব্যায় কমানো যাবে এবং ক্ষতি কাটিয়ে লাভের মুখ দেখা সম্ভব।