আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাঃ কর্মক্ষেত্রে এর ভূমিকা

সোহেল আহমেদ পরান
Published : 4 July 2015, 07:51 PM
Updated : 4 July 2015, 07:51 PM

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence ) এর জনক হিসেবে ধরা হয় ড্যানিয়েল গোলম্যানকে। ১৯৯৫ সালে গোলম্যান কর্তৃক পরিচিতি লাভ করার পর সংশ্লিষ্ট মহলে এটি একটি জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত শব্দ হিসেবে বিবেচ্য হয়ে ওঠে। তুলনামূলকভাবে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এর ধারণাটি নূতন; কিন্তু তা শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা হলো নিজের আবেগকে বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করা।

একেবারে সংক্ষেপে, একলাইনে বলতে গেলে- আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বলতে নিজের ও অন্যদের আবেগকে বুঝা এবং তা ম্যানেজ করার ক্ষমতাকে বুঝায়। অন্যকথায় বলা যায়, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে একজন ব্যক্তির সেই মানসিক সামর্থ্য, যার মাধ্যমে সেই ব্যক্তি নিজেকে সুন্দরভাবে ম্যানেজ করতে পারে, আশপাশের অন্যান্যদের সাথে সলফলতার সাথে আচরণ করতে পারে, অন্যকে মোটিভেট করতে পারে এবং স্বীয় অনুভূতির সঠিক বিচার করে প্রতিদিনের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যথার্থভাবে সাড়া দিতে সমর্থ হয়।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার উপাদানঃ
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence) পাঁচটি উপাদান নিয়ে গঠিত। এগুলো সবই মানসিক উপাদানঃ
স্ব-সচেতনতা (Self Awareness): স্ব-সচেতনতা বলতে নিজেকে জানা বুঝানো হয়। ব্যক্তি তার নিজের মনন, মানসিকতা, মানসিক সাহস/সামর্থ্য, ভয়, অসামর্থ্য, দক্ষতা-অদক্ষতা সম্পর্কে সমূহ ধারণা থাকতে হবে। বিশেষকরে নিজের আবেগ ও অনুভূতির প্রকৃতি জানা থাকতে হবে। নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার ক্ষমতাকে আমরা বলতে পারি স্ব-সচেতনতা বা Self Awareness. এক কথায়- Self Awareness means self understanding.

স্ব-ব্যবস্থাপনা/আত্মনিয়ন্ত্রণ(Self-Management/Self-Control): স্ব-ব্যবস্থাপনা/আত্মনিয়ন্ত্রণ মাধ্যমে নিজের আবেগ ও অনুভূতির নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনাকে বুঝায়। নিজের চারপাশের পরিবেশ জেনে নিজের দক্ষতা বিচার করে আচরণ করার ক্ষমতা এটি। এক কথায়- Self Management means handling self emotion.

স্ব-উদ্যম (Self-Motivation): স্ব-উদ্যম বা Self Self-Motivation আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কোনো কিছু করার জন্য নিজের মন থেকে যে তাগিদ অনুভূত হয়, তাকে বলা যেতে পারে স্ব-উদ্যম। সেলফ-মোটিভেশন না থাকলে ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট হওয়া সম্ভব না। নেতিবাচক মনোভাব ঝেড়ে ফেলে নিজে উদ্যমী না হলে অন্যদের সাথেও আচরণ ঠিক কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা অসম্ভব। স্ব-উদ্যমকে এককথায় বলা যায় – Self Motivation means remain toward desired goals/overcome negative emotions

অন্যকে উপলব্ধি করা(Empathy): এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অন্যকে, অন্যের আবেগ-অনুভূতিকে উপলব্ধির মানে সাধারণভাবে সিম্প্যাথি বলতে যা বুঝায় তার চেয়ে বেশি কিছু। Sympathy কে আমরা সমবেদনা হিসেবে বর্ণনা করি। আর Empathy?– কেউ যখন কারো সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করে, তা উপলব্ধি করে কোনো পদক্ষেপ নেয়, তখন তাকে আমরা Empathy হিসেবে আখ্যা দিতে পারি। মানুষ Sympathy চায় না; চায় কেউ তাকে সত্যিকার অর্থেই বুঝুক। তাই Empathy আর Sympathy এর মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য আছে। আর Sympathy বিষয়টি আবেগীয় বুদ্ধিমত্তায় খুব প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। এককথায় বলা যায়- Empathy means understand and be sensitive to feelings of other.

সামাজিক দক্ষতা (Social Skills): সামাজিক দক্ষতা একটি ব্যাপক বিষয়। অনেক ক'টি গুণের সম্মীলন ঘটলেই তাকে সামাজিক দক্ষতা হিসেবে অভিহিত করা যায়। সামাজিক দক্ষতার জন্য সমাজের পরিস্থিতি বুঝতে পারা, অর্থবহ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, দক্ষ নেটওয়ার্কিং আর অন্যের আবেগকে গাইড করার মতো গুণ থাকা আবশ্যক। অন্যকে প্রভাবিত করার মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব পরিহার করে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ্য কিন্তু সামাজিক দক্ষতার অন্তর্ভুক্ত। এক কথায় বলা যায়- Social Skills means the ability to read social situations, smooth in interaction and forming networks, able to guide other's emotions.

কর্মক্ষেত্রে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা (EI at Workplace):

লক্ষ্যণীয় যে, মাত্র ২৪টির মতো আবেগীয় দক্ষতা কর্মক্ষেত্রের সকল বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলে থাকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক'টি হলোঃ

> সঠিকভাবে নিজেকে মূল্যায়ন;
> আত্ম-নিয়ন্ত্রণ
> সুস্থ বিবেক বিবেচনা
> খাপ-খাওয়ানো বা অভিযোজন ক্ষমতা
> উদ্ভাবনী বা সৃষ্টিশীল চিন্তা চেতনা
> অঙ্গীকার- সচেতনতা
> কর্ম-উদ্যোগ বা প্রত্যুপক্রম
> রাজনৈতিক সচেতনতা
> আশাবাদী থাকা
> অন্যকে বুঝার ক্ষমতা
> বিরোধ বা সংঘাত ব্যবস্থাপনা
> দলীয় কাজের প্রেরণা
> যোগাযোগ
> পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা … ইত্যাদি ।

আমরা Intelligence Quotient বা IQ এর কথা জানি। ধরে নেয়া হতো- যাদের আইকিউ যতো বেশি তারা জীবনে তত বেশি সফল হয়। সফলতা যেনো আইকিউ-এর হাত ধরেই আসে। কিন্তু এ ধারণার পরিবর্তন এসেছে ব্যাপকভাবে। বৈজ্ঞানিক ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় আজ প্রথাগত আইকিউ ধারণা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। প্রমাণিত হচ্ছে IQ নয়; EQ (EI) এখন বেশি কার্যকর এসব ক্ষেত্রে। গোলম্যানের ভাষায়, "আইকিউ সাধারণত সারাজীবন ধরে স্থিতিশীল থাকে কিন্তু আবেগীয় দক্ষতার (ইকিউ) এর অনেক কিছুই শেখা যায়।" মনোবিজ্ঞানীদের জন্য অনেক সুযোগ রয়েছে কোচ হিসেবে কর্মক্ষেত্রের মানবসম্পদের মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে।
একজন উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কর্মী তার নিজের তাড়না ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারেন, সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিগণের সাথে কার্যকর যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন, যে কোনো পরিবর্তনকে সহজভাবে মানিয়ে নিতে পারেন, উদ্ভূত সমস্যাসমূহের যৌক্তিক সমাধান করতে পারেন এবং সুস্থ রসবোধ কাজে লাগিয়ে চাপা বা উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিকে সহজ করে পারষ্পারিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কর্মীগণের অন্যকে বুঝার, অন্যের অনুভূতি উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকে, তারা বিপদ-আপদ ও প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও সবসময় আশাবাদী মনোভাব পোষন করে থাকেন। তাঁরা অন্যকে শেখাতে ও প্রভাবিত করতে পারদর্শী হয়ে থাকেন এবং যে কোনো অভিযোগের কাঙ্ক্ষিত সমাধানে দক্ষ হয়ে থাকেন।

উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কর্মীগণের "চিন্তার স্বচ্ছতা" এবং প্রতিকুল ও স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিতে স্থিরতা তাঁদেরকে কর্মক্ষেত্রে top performer এর স্বীকৃতি এনে দেয়। কর্মক্ষেত্রের অনেক বিষয়ে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence) high performance এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার উন্নতি করে একজন নির্বাহী বা কর্মী কর্মক্ষেত্রে অনেক অন্যদের থেকে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারেন নিন্মলিখিত উপায়েঃ

• কাস্টমারের প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্বানুমান, শনাক্তকরণ ও তা মেটানোর ক্ষমতা;
• অন্যের অনুভূতি সম্পর্কে স্বজ্ঞামূলক চেতনা এবং তা বুঝার ক্ষমতা;
• অন্যদের বেড়ে উঠা আর পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা;
• কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে প্রত্যয়ী কৌশল ও উপায়সমূহের কার্যকর ব্যবহার;
• অন্যদের বুঝার জন্য পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য বার্তা বিনিময়;
• আপস-আলোচনা এবং দ্বন্দ্ব নিরসনকরণ;
• ব্যবসা সাফল্যের জন্য সহায়ক সম্পর্কের লালন;
• সম্মীলিত লক্ষ্য অর্জনে দলীয় বোধে কাজ করা।

বিশেষভাবে, ঊর্ধ্বতন নির্বাহীগণের উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা থাকা প্রয়োজন বেশি। কারণ তাঁরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, নানা জনের সাথে মেলামেশা করতে হয়, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বাইরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে থাকেন এবং কর্মীদের মনোবল উঁচুতে রাখার ব্যাপারে দায়িত্বশীল। অন্যদের বুঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতাসম্পন্ন ঊর্ধ্বতন নির্বাহীগণ তাঁদের সহকর্মীদের প্রয়োজন বুঝতে পারেন এবং সেমতে যথার্থ ফিডব্যাক দিতে পারেন। একইভাবে, কাজের ধরন ও পর্যায় ভেদে বিভিন্ন ধরনের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজন হয়ে থাকে।

ছবিঃ ইন্টারনেট