পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা পোড়ামন-২ প্রমাণ করে দিয়েছে, আমাদের সিনেমার ভাল সময় চলছে।
মুক্তির প্রায় তিন মাস পরে সহকর্মীদের সঙ্গে সিনেমাটি দেখে ফেললাম।
২০০৮ সালে কলকাতায় নির্মিত রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত প্রেমনির্ভর 'চিরদিনই তুমি যে আমার' সিনেমাটি মুক্তি পায়। এটি একটি তামিল সিনেমার অনুকরণ বলে গুঞ্জন উঠলেও দর্শক মহলে বেশ সমাদৃত হয় সিনেমাটি। এই সিনেমার মুক্তির কয়েক বছর পরে নাগরাজ মনজুলে পরিচালিত মারাঠি সিনেমা সাইরাত মুক্তি পায়। মারাঠি ভাষায় নির্মিত এই সিনেমাটি ভারতে বেশ ব্যবসাসফল হয়। সাইরাতের কাহিনি নিয়ে বলিউডে রিমেক হয়েছে শ্রীদেবি কন্যা জাহ্নবি কাপুর অভিনীত 'ধড়ক' সিনেমাটি।
পোড়ামন-২ নিয়ে লিখতে গিয়ে অন্য সিনেমার কথা কেন বলছি? আসলে এই সব সিনেমার কাহিনী একই এবং কোনো ভিন্নতা নেই। তাই যখন পোড়ামন-২ সিনেমাটি দেখতে বসি তখন আমিও কিছু মিল খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিছু মিল পেয়েছি, আবার পাইনি।
লাল শাড়ি পড়ে একটি মেয়ের আত্মহত্যার দৃশ্য আর পিতার আহাজারিতে সিনেমার শুরু। প্রথম দৃশ্যের করুণ আবহ সঙ্গীতের মূর্ছনা দর্শকদের মনে দাগ কাটে।
মেহেরপুর গ্রামের সুজন শাহ প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহের ভক্ত। সুজন আর প্রভাবশালী তালুকদার বাড়ির মেয়ে পরীর ভালোবাসা নিয়ে সিনেমাটির কাহিনী গড়ায় ধর্ম-অধর্ম এবং সামাজিক টানাপোড়নে।
তবে দর্শকের মনের পুরোটাই পুড়ে যাবে সিনেমার শেষ দৃশ্যের কিছু দৃশ্যায়নে। সিনেমার গল্প যেখান থেকে শুরু, ঠিক সেখানেই এর পরিণতি গড়ায়। এক্ষেত্রে পরিচালক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।
রায়হান রাফি পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা পোড়ামন-২। প্রথম সিনেমাতেই নিজেকে বেশ ভালোভাবেই যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন এই পরিচালক। কিছু অসঙ্গতি থাকলেও ভালো কাজের জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি রায়হান রাফি।
সিনেমায় সুজন শাহ চরিত্রে আছেন ছোট পর্দার অভিনেতা সিয়াম। সিনেমার কাহিনী অনুযায়ী সিয়ামকে মানিয়ে গেছে। অভিনয়ও ভাল করেছেন। নাচের দিকটা বোধহয় আরও একটু ভালো করা যেতো; তবে প্রথম সিনেমা হওয়াতে এটুকু মেনে নেয়া যেতেই পারে।
তালুকদার বাড়ির মেয়ে পরী চরিত্রে দেখা যায় অভিনেত্রী পূজা চেরিকে। দর্শকনন্দিত রিন ওয়াশিং পাউডারের একটি বিজ্ঞাপনে অভিনয় করা পূজা সিনেমায় ছিলেন পরিপক্ক ও সাবলীল। অভিনয় গুণে যদি টিকে থাকতে পারেন তবে বাংলা সিনেমায় পূজা চেরির ভবিষ্যত বেশ আলোকিতই হবে।
সিনেমার পরীর দাদীর চরিত্রে দেখা গেছে বর্ষীয়ান অভিনেত্রী আনোয়ারাকে। পরীর বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাদের চৌধুরী ও মায়ের চরিত্রে অভিনেত্রী রেবেকা। খলচরিত্রে পরীর ভাইয়ের ভূমিকায় ছিলেন অভিনেতা বাবু। সিনেমাটিতে একটি বিশেষ চরিত্রে বরাবরের মতোই চমৎকার অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু।
সুজন শাহের বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রোমান্টিক বাংলা সিনেমার ব্যর্থ নায়ক হিসাবে পরিচিত বাপ্পারাজ। অনেক সিনেমার বিয়োগান্তক দৃশ্যে এই নায়কের সঙ্গে কেঁদেছেন অনেক দর্শক। অথচ সিনেমা হলে পাশের আসনে বসা এক দর্শক বলছিলেন, অমনোযোগী একটি ভাব ধরা দিয়েছে তার চরিত্রে; তার বলা সংলাপগুলোর ধরনেও ছিল খাপছাড়া একটি ভাব।
বাংলাদেশের সিনেমার বর্ষীয়ান কমেডি অভিনেতা দিলদারের শুন্য জায়গাটা কেউ পূরণ করতে পারেনি এখনও। কমেডিয়ান অভিনেতা ববি কিছুটা হাসির খোরাক যোগালেও একেবারেই বাজে অভিনয় করেছেন বস্তা ও কাঠির চরিত্রে অভিনয় করা চিকন আলী ও পিয়াল। অনেকটা সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর চেষ্টা। মজার এই চরিত্র দুটিতে অন্য কাউকে ভাবা যেতো। ভবিষ্যতে কমেডি চরিত্রে অভিনেতা নির্বাচনে সকল পরিচালকই সচেতন থাকবেন বলে আশা করি।
দৃশ্যায়নসহ সিনেমার ছয়টি গানই চমৎকার হয়েছে। গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য এখনও হারিয়ে যায়নি সেটা খুব প্রতীয়মান। সিনেমার টাইটেল গান 'পোড়ামন' ও 'সুতো কাটা ঘুড়ি' বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
সিনেমাতে বেশ কিছু ড্রোন ক্যামেরার কাজ ছিল। এই ড্রোন ক্যামেরার শটগুলো সিনেমাতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।
বাংলাদেশে সিনেমার পোস্টার ডিজাইনে খুব একটা শৈল্পিকতা দেখা যায় না। কিন্তু পোড়ামন-২ মুক্তির আগেই এই সিনেমার পোস্টার বেশ আলোচিত হয়। পোস্টার দেখে সিনেমার কাহিনী আন্দাজ করে ফেইসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি চলে। সিনেমাতে একটি ধর্মীয় বিষয় তুলে ধরা হলেও পোস্টারের দৃশ্যের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি পুরো সিনেমায়।
তামিল সিনেমার রিমেক যুগে পোড়ামন-২ একটি ভালো বিনোদন প্রচেষ্টা। আমার যে সহকর্মী বাংলা সিনেমা দেখবেন না বলে জানিয়েছিলেন, উনিও পুরো সিনেমা দেখে 'বেশ ভালো' বলে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন।