টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্রায় তলিয়ে গেছে। সিলেট শহরের বিভিন্ন স্থানেও পানি জমে আছে। পানিবন্দী মানুষের জনজীবন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্থ হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারছে না। জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবার জন্যে সবার নৌকাও নেই। এতে লোকজন জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। অনেকেরই ঘরের ভেতরে পানি উঠে যাওয়ায় চুলায় রান্না বসাতে পারছে না। ফলে সময়মত খাবার খেতে পারছে না। এমনকি বিশুদ্ধ খাবার পানিও পাচ্ছে না। খুবই কষ্টে মানুষজন দিনাতিপাত করছেন।
বন্যার পানি দেখতে গতকাল সিলেট শহরের নিকটবর্তী বাদাঘাট নামক স্থানে গিয়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে অনেক জায়গা ঘুরে দেখলাম। পানিবন্দী মানুষের দু:খ-কষ্ট না দেখলে হয়ত বোঝা যাবে না মানুষ কী যে কষ্টে আছে।
সুতরাং বন্যার্ত মানুষের পাশে যান। তাদের সাহায্যার্থে সবাই এগিয়ে আসুন।
বন্যার পানিতে যেসব স্থান ডুবে গেছে সেখানে আবার শৌখিন অনেকেই মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়েছেন। একেকজন একেক পদ্ধতিতে মাছ ধরছেন। কেউ মাছ ধরতে পারছেন আবার কেউবা আবার ঘন্টার পর ঘন্টা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ নৌকায় পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন। চারিদিকের এসব দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগছে। আবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কষ্ট দেখে নিজেরও কষ্ট লাগছে।
সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডয় ব্যাপারটা শেয়ার করলাম। বললাম, আজ বন্যার পানি দেখতে বাদাঘাট ও এর আশপোশের এলাকায় গিয়েছিলাম। সেখানকার মানুষের দু:খ-দুর্দশা দেখে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অন্যদিকে মাছ ধরার দৃশ্য এবং নৌকা নিয়ে লোকজনের ঘোরাঘুরির দৃশ্যও দেখলাম। দৃশ্যটা বেশ ভালো লেগেছে। আমার আফসোস হচ্ছিল, তাঁদের সাথে আমি মাছ ধরি অথবা নৌকা নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু আমার সে সুযোগ ছিল না।
ফরিদ এবং রফিক আমার এ গল্প শুনে বলল, আজ রাতে আমরাও মাছ ধরব। ফরিদ যেকোন ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে তার প্রিয় ভাবীদের সাথে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলাপ করে। যথারীতি সে তার এক ভাবীর কাছে ফোন দিল। বলল, আজ রাতে মাছ ধরব। ওপাশ থেকে ভাবী বললেন, কী মাছ ধরবে? ফরিদ বলল, যা পাই তা-ই ধরব। তবে এই পানিতে বোয়াল মাছ পাবার সম্ভাবনাই বেশী। ভাবী বললেন, ওসব তোমাকে দিয়ে হবে না, বোয়াল মাছটাছ আমরাই ভালো ধরতে পারি। ফরিদ ভাবীর কাছে জানতে চাইল, কী বললেন- বুঝলাম না। ভাবী বললেন, ওতো বোঝার দরকার নেই, এই বলে ভাবী প্রসঙ্গটি এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। ফরিদ বলল, আমি আজ মাছ ধরবই। ধরে আপনাকে দেখাব, বলে লাইন কেটে দিল।
ভাবীর সাথে ফোনে কথা বলা শেষে ফরিদ রফিককে বলল, আজ যেভাবেই হোক আমাদেরকে মাছ ধরতেই হবে। মাছ ধরতে না পারলে ভাবীর কাছে মূখ দেখাতে পারবো না। রফিক বলল, ভাবীকে এতো মূখ দেখানোর দরকার কী? ফরিদ নিশ্চুপ থাকল।
এদিকে ফরিদ এবং রফিক শাহ আলীর সহযোগিতায় মাছ ধরার সব আয়োজন করল। রাত বারটার দিকে মাছ ধরতে তাঁরা সিলেট নগরীর তপোবন নামক স্থানে বেরিয়ে পড়ল। যেখানে সবসময় গাড়ী চলাচল করে সেখানেই এখন তাঁরা মাছ ধরবে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আকস্মিক বন্যার পানিতে এরকম বহু স্থানই এখন পানির নীচে। আর সেসব স্থানে শৌখিন অনেক মাছ শিকারীই মাছ ধরছেন, বিভিন্ন পদ্ধতিতে। আমাকেও তারা বলেছিল তাঁদের সাথে মাছ ধরতে যাবার জন্যে। আমি সাপ ভীষণ ভয় পাই। বললাম, অন্ধকারে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। তাই আমি যাবো না।
প্রস্তুতি অনুযায়ী সবাই চুপিচুপি টর্চলাইট জ্বালিয়ে মাছ শিকার শুরু করল। সবাই পাশাপাশিই ছিল। একপর্যায়ে অন্য সবাই ফরিদকে হারিয়ে ফেলল। ডাকাডাকি করে ফরিদের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সঙ্গে আসা অন্য সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। ফরিদের কোন বিপদ হলো নাকি? না, ফরিদ নির্জনে মাছ শিকার করতে চেয়েছিল এবং সুযোগ বুঝে সে অন্য সবার কাছ থেকে সরে গিয়ে একা একা শিকারের সন্ধান করছিল। এতে সে সফলও হলো। অন্য কেউ কোন ধরণের মাছ ধরতে না পারলেও ফরিদ ঠিকই মোটাসোটা একটা মাছ ধরল। মাছ ধরেই খুশীতে সে লাফালাফি করে হইচই শুরু করে দিল। ফরিদের সঙ্গে আসা অন্য শিকারীর কাছে এসে সে বলল, আমি পেরেছি………..! রফিকসহ অন্যরা জিজ্ঞেস করল, কী পেরেছ? জবাবে ফরিদ বলল, কেন? মাছ ধরতে পেরেছি। রফিক জিজ্ঞেস করল, কী মাছ ধরেছ? ফরিদ বলল, ওটা তো বলব না! সমস্বরে অন্য সবাই বলল, থাক- বলতে হবে না। রাত গভীর হয়ে এলে সবাই নিজ নিজ বাসায় ফিরে গেল। আর সঙ্গে নিয়ে গেল যতসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
নগরীর ওলিতে-গলিতে মাছ শিকার করতে গিয়ে তাঁরা মানুষের দু:খ-দুর্দশা দেখতে পেল। ভাগ্যিস নিজেরা এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি। নিজেরা না পড়লেও অন্যের কষ্ট দেখে তাঁদের নিজেদেরও কষ্ট হচ্ছে।
নগরীতে আসলে এই আকস্মিক বন্যা হয়েছে নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিকঠাকভাবে না থাকার কারণে। যাঁরা খাল ভরাট করে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছেন তারাও এজন্যে দায়ী। নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক আছে কী-না এসব দেখার দায়িত্ব কার? যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা কি ঠিকঠাকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না? নাকি পানিবন্দী মানুষের এই দু:খ দুর্দশা দেখতে তাঁদের ভালো লাগে? নগরীর পানিবন্দী অবস্থার জন্যে শুধু কি প্রকৃতিই দায়ী? নাকি আমরা, দেশের জনপ্রতিনিধিরাও দায়ী? খতিয়ে দেখুন।
আপাতত: বন্যার্ত মানুষের পাশে সবাই দাঁড়ান। যে যেভাবে পারেন তাঁদেরকে সহযোগিতা করুন।