চোখে তখনো লেপ্টে আছে ঘুম। কিন্তু মনের মাঝে চলছে সাদা পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা। এ হঠাতই এক পাওয়া। অথচ একদিন আগেও নিশ্চিত ছিলাম না আসলে আসা হচ্ছে কিনা। তাই নিজেকে চিমটি দিয়ে দেখছিলাম, সত্যিই এখানে তো?
তিন ভবঘুরের উদ্দেশ্যের কুল কিনারা নেই। এই ধরুন-ত্রিভুবন বিমানবন্দর নেমেই নেপাল পর্যটন গেলাম অন্নপূর্ণা বেইজক্যাম্পের অনুমতির জন্য। ফরম পূরণ করা অবস্থায় দ্বিধায় পড়ে গেলাম সার্কিট ট্রেক নাকি বেইজক্যাম্প?
'তিনের এক' টুটুল ভাই আবার গম্ভীর প্রকৃতির সহজ-সরল ও সিরিয়াস মানুষ, তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন হবে-শীঘ্রই আবার হবে। ইমরান ভাই-সহমত বলে দিলেন। আমিও সহমত বলে দিলাম, কারণ ইমরান ভাই-এর অভিধানে নেই শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
বলা রাখা ভালো যে- বেইজক্যাম্পে যাবো তা নিয়ে আগে একমিনিটও ভাবতে পারিনি। তাই ইমরান ভাই হাতে একটি আঁকাবাঁকা ম্যাপ ধরিয়ে বলল- ভ্রমণসঙ্গীকে সঙ্গে রাখুন।
হোটেল আল-মদিনা। সবাই সবার দিকে কানি চোখে তাকিয়ে দেখছে। এখানে বাঙালিদের ভিড় হয় বেশ। একারণেই বোধহয় একজন অনেকটা নিশ্চিত কণ্ঠেই জানতে চাইলো, ঢাকা থেকে?
ভোজন রসিক ইমরান ভাই অর্ডার দিলেন, বাফেলো আর গরুর সঙ্গে ভাত। একেবারে অমৃত! আল মদিনা হোটেলের বিশেষত্ব হচ্ছে মুসলিম হোটেল সঙ্গে দামও কম।
হোটেল সাঙ্কারা। দেখা হলো পোর্টেবল হার্ডডিস্ক খ্যাত সামসু ভাইয়ের সঙ্গে। তার পরামর্শে আমাদের বস্তার ন্যায় ট্রেকিং ব্যাগগুলো থেকে কাপড় কমিয়ে ট্রেকিং উপযুক্ত ব্যাগ বানালাম। আসলে কাঁধের ব্যাগ ছোট রাখা অনেক কষ্টকর বিষয়।
এর মাঝে ডলারকে নেপালি রুপিতে ভাঙানোসহ কাঠমান্ডু-পোখারা বাসের টিকেট রেডি। বাইরে ট্যাক্সি অপেক্ষায়। বাসস্ট্যান্ডে চেকইন করা মাত্র দালালের দোড়ঝাঁপ। বিপত্তি ঘটল চা খেতে গিয়ে- এককাপ চায়ের দাম ২০ রুপি? তখনো জানা ছিল না সামনে এই এককাপ চায়ের দাম ৩০০ রুপির উপরেও হতে পারে।
পোখারা। অন্নপূর্ণা আর মাছাপুছারে পাশেই স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে। আন্দাজ করলাম বাসস্ট্যান্ড এর উল্টো পাশেই। দূরত্বও বেশি নয়। কিন্তু ভাবতে পারিনি এই দুটোর নিচে যেতে পাঁচ দিন হাঁটতে হবে।
পথে বাংলাদেশি ভাই-ব্রাদারদের সঙ্গে দেখা। টিম এলটিটিউড নামের ১০ জনের এই গ্রুপ বেইজক্যাম্প থেকেই ফিরছে। টাটকা কিছু টিপস সমেত অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। আর হাতে তুলে দিল ঝাঁকড়া-লম্বা চুলের এক গাইডকে। নাম অন্তিম, প্রফেশনাল ভলিবল প্লেয়ার।
ঘান্দ্রুক বাসস্ট্যান্ড। ব্যাপক দরকষাকষি করে মনোজ গুরুং-এর যাত্রীবাহী জিপে চড়ে বসলাম। সঙ্গে আছে নেপালি এক পরিবার ও জাপানি দম্পতি যাদের বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। ইমরান ভাই 'আরিগাতো' বলে সম্বোধন করায় অবাক হয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে কথা বিনিময় শুরু। ভাবলাম আশেপাশে কোথাও যাবে। কিন্তু গন্তব্য কোথায় জানতে চাইলে বেইজক্যাম্প বলে উঠল। শুনে আমাদের চোখ কপালে। ওরা আমাদের আরো অবাক করে বলল, এ নিয়ে চারবার।
দুপুর ১টা। ঘান্দ্রুক। খুব উঁচু স্থান ও সর্বশেষ বাসস্ট্যান্ড। ইতোমধ্যে বিরথাটিতে ট্রেকিং রুটের কাগজাদি চেক হয়েছে আর অন্তিমের সঙ্গে খোশগল্পও জমে গেছে। অন্তিম জানালো হোটেল সামনেই। মিনিট পাঁচেক হেঁটে গিয়ে ঘান্দ্রুকের সবচেয়ে উঁচু হোটেল হ্যাভেন লজ ভিউতে উঠলাম। অন্যান্য ঘরগুলোও ছিল অসাধারণ। দেখতে ছবির মত। রুমে ঢুকে এক স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করলাম। বাহিরে বিশাল খোলা বারান্দা আর সামনে দেখি চকচক করছে মাছাপুছারে আর অন্নপূর্ণা; একেবারে স্বর্গ।
বিকেল ৪টা। ঘান্দ্রুকের সৌন্দর্য দর্শনে বাড়িগুলোর আশপাশ হয়ে হেলিপ্যাডে পোঁছালাম। এখান থেকে পুরো ঘান্দ্রুককে একফ্রেমে দেখা যায়। হঠাতই বৃষ্টির হানা। এক পশলা মেঘ আকাশ থেকে ঝরে পড়ে ঘান্দ্রুককে ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
বিভিন্ন আলাপের ফাঁকে ইন্টারভিউ দিতে হলো হিন্দি ভাষায়। সন্ধ্যা নেমে আসছে। অন্নপূর্ণা আর মাছাপুছারে পাহাড় দুটো আরো চমৎকার রূপ সেজে উঠেছে ততক্ষণে।
একদল বিদেশির সঙ্গেও আলাপ হল। তাদের মধ্যে একজন ঝিলস। সুইজারল্যান্ড ও ইতালির যৌথ নাগরিক। অভিজ্ঞতা শেয়ার হলো। রাত আবার ছিল পূর্ণিমার। লাখো তারায় জ্বলজ্বল করছে চারদিক। সে রাতে সবার সঙ্গে গান-বাজনায় মেতে ওঠা আর খাবারে বাংলাদেশি চিড়া খাওয়ার মজা কখনো ভোলার নয়।
সকাল ৬.৩০। টোস্ট ডিম খেয়ে ট্রেকিং শুরু। উদ্দেশ্য চমরং। আগে থেকে জানা ছিল বেশ কিছু সিঁড়ি পড়বে; তবে সমস্যা হবেনা। কিন্তু এ সিঁড়ি যে কতটা ভয়ঙ্কর ও কখনো শেষ হবেনা তা প্রতি কদমে কদমে টের পেয়েছি। সারা রাস্তায় একটি জিনিস ভেবেছি তা হলো এ জন্যই কি 'শিরি-ফরহাদের' মিল হয়নি!
পাহাড়ে উপরে উঠা ও নিচে নামা দুটোই সমান কষ্টকর ব্যাপার। তবে উপরে উঠতে দম বের হয়ে যাবার উপক্রম হয় আর ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে যায় শরীর।
হঠাৎ চোখে পড়ল বিশাল এক ঝুলন্ত ব্রিজ আর তার তলদেশে প্রবাহিত বিশাল নদী। যদিও পানি শুকিয়ে ছোট আকৃতির হয়ে গেছে। উপরে কিছু ঘর দেখা যাচ্ছে। পেটের টানে দ্রুত উঠলাম।
আকাশ তলে পাহাড়ের ঘা ঘেঁষে কিমরুখোলা আর তার গা ঘেঁষে নদী। সব মিলে সৌন্দর্যে ভরপুর। যদিও দুপুর হয়নি কিন্তু মধ্যাহ্ন ভোজ এখানেই সারলাম। টুটুল ভাই আবার খাবারের আগে-পড়ে ৩০ মিনিট ঘুমিয়ে নিল। কারণ ভাইয়ের ঘুম আসতে সময় লাগে ১০ সেকেন্ডের মত। ইমরান ভাই বিভিন্ন ফ্রেমে ঘুম ও নাক ঢাকার চিত্র ধারণ করছিলেন এমন সময় খাবার সামনে দিয়ে গেল।
খাবার পর্ব শেষ করে রওয়ানা হলাম চমরং এর উদ্দেশ্যে। শুনলাম তিন ঘন্টার রাস্তা বাকি। হাঁটা শুরু, কিন্তু একি! হাজার সিঁড়ি এবার লাখো সিঁড়িতে রূপ নিয়েছে। অল্প একটু উঠেই শুয়ে পড়ি মাটিতে। এক কথায় শুয়ে-বসে-কাত হয়ে, চিত হয়ে, গল্প-আড্ডা-মন খারাপকে সঙ্গী করে এক পর্যায়ে অনেক উঁচু একটি স্থানে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে চমরং দেখা যায়। এজন্য আবার নামতে হবে ঘন্টা খানেক। এই রাস্তা সহজেই পাড়ি দেয়া গেল।
বিকেল ৪.৪৫ মিনিট। ১৯.৫ কিলোমিটার হেঁটে কাঙ্ক্ষিত চমরং। হোটেল প্যানারোমা পয়েন্ট লজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে চেকইন করে কোনোভাবে অল্প করে ফ্রেশ হয়ে রুমে গিয়ে ঘুম দিলাম।
ঘুম ছুটে গেল গাইডের 'খানা রেডি হ্যায়' ডাকে। ক্যান্টিন রুমে দেখি সবাই কম্বল মুড়ি দিয়ে খাচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে ফ্রাইড রাইস, সুপ খেয়ে নিলাম। রুমে এসে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম বুঝিনি।
সকাল ৬টা। খোলা বারান্দা থেকে মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে মাছাপুছারে আর অন্নপূর্ণাকে ছুঁয়ে দেয়া যাবে। আবারো টোস্ট আর ডিম খেয়ে শুরু হল ট্রেকিং। উদ্দেশ্য আজ দোবানে রাত্রিযাপন। অন্নপূর্ণা কনজার্ভেশন এরিয়া (এসিসি) চেকপোস্ট থেকে নাম লেখিয়ে সিঁড়ি নামা শুরু।
টানা ৩০ মিনিট নামা শেষে এবার ওঠা শুরু। দম এখানেই শেষ মনে হলো। যাত্রাপথে বিরতি হলো সিনুয়াতে। এত অল্প সময় হেঁটেই সিনুয়ায় চলে আসায় খুব খুশি হলাম। চা-আড্ডা আর গান বাজনা চলল। কোরিয়ান গায়কের গিটারে বাজল 'কান্ট্রি রোডস, টেইক মি হোম' কণ্ঠ মিলিয়ে গাইলাম।
আরো এক ঘন্টা উপরের দিকে শুয়ে-বসে আগালাম। অদূরে কিছু ঘর দেখে খুশি হয়ে ভাবলাম হয়ত ব্যাম্বু চলে এসেছি। কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা আপার সিনুয়া। তারমানে নিচেরটা ছিল লোয়ার সিনুয়া।
বিষন্ন মনে আবার হাঁটা শুরু। কাত-চিত হয়ে, উপর-নিচ যেতে যেতে দুপুর গড়িয়েছে। পেটের অবস্থা নাজেহাল। কথা ছিল ব্যাম্বুতে লাঞ্চ হবে। কিন্তু কোথায় সে ব্যাম্বু?
দুপুর ২টা। দূরে কিছু ঘর দেখে ছুটে যাই। কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যাম্বু। উচ্চতা ২১৪৫ মিটার। ব্যাগ ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত খাবারের মেনুতে নজর ইমরান ও টুটুল ভাইয়ের। একটা আইটেম বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে গেল। বিশ মিনিটের মধ্যে হাজির। সামনে দেখি প্লেটে ভাত, ডাল, সবজি, ভর্তা আর ডিমভাজা। আহা, এ যেন অমৃত।
টুটুল ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। বললেন, যেতে হবে এবার। ট্রেকিং শুরু। আমার মনে হল কাঁধে একটা ব্যাগ আর পেটে ভাতের একটা ব্যাগ। এই দুই ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আগাচ্ছি। এক সময় দেখি দোবান। গাইড বলে, আরো মিনিট বিশেক সামনে আমাদের কটেজ। ইতোমধ্যে আমাদের ১৮ কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটা হয়ে গেছে।
নতুন কটেজ, এখনো নাম দেয়া হয়নি। রুম নম্বর পাঁচে চেকইন করে সোলার চালিত ওয়াটার হিটার ছেড়ে দ্রুত গোসল সেরে নেই। অন্তিম মেনু নিয়ে হাজির; রাত ও সকালের খাবারের অর্ডার নিতে। সন্ধ্যা নামতেই আড্ডা জুড়ে দিলাম আমেরিকান এক ট্রাভেলারের সঙ্গে।
ফরেইনার ট্রাভেলারদের অধিকাংশের গল্প হচ্ছে ছয় মাস কাজ করে বাকি ছয় মাস পৃথিবী ভ্রমণে বের হয়ে যায়। এখানে নেপালি এক যুগলও ছিল। যাদের দেখলে সিনেমার হিরো-হিরোইন মনে হয়। গল্প চলতে চলতে খাবার টেবিল থেকে ডাক আসে। ভাতের প্লেটের সঙ্গে পিৎজার আইটেমও সাজানো।
সকাল ৭টা। ট্রেকিং শুরু। মূল দোবান থেকে মিনিট বিশেক এগিয়ে থাকায় ধীরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত। উদ্দেশ্য আজ হিমালয়া-দিউরালি হয়ে এমবিসিতে রাত্রী যাপন।
অন্নপূর্ণা রুটের প্রেমে পড়ে গেছি। চারদিকে জঙ্গল কোথাও কোথাও ঝরনা, আবার তার পানি রাস্তা বেয়েই নিচে গড়িয়ে পড়ছে। চোখে পড়ল হনুমান সাইজ এক বানরের। এই এলাকা পুরোপুরি তাদের দখলে। ওদের বিরক্ত না করে খুব সতর্কতার সঙ্গে পাড়ি দিতে হল।
হিমালয়া পার হয়ে দেউরালি উদ্দেশ্য। দূর থেকে দেখা গেলেও পথ যেন শেষ হচ্ছিল না। চারদিকে অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি আর ঝুঁকি ঘোষণা করে পাহাড় দাঁড়িয়ে।দেউরালি। উচ্চতা ৩২০০ মিটার। পরিবেশ জানান দিচ্ছে, গন্তব্য আর বেশি দূরে না।
প্রিয় খাবার ভাত, ডাল, ডিম ও সবজির অর্ডার হলো। ট্রেকাররা কেউ ঘুমে, কেউ আড্ডা আর একদল পিয়ানোর পাগল করা সুরে গানের আসর জমিয়েছে। আমি এ দলেই। যারা এবিসি মিশন কমপ্লিট করে ফিরছে. 'নামাস্তে নেপাল' বলে মিস্টি হাসি দিয়ে এগুচ্ছে।
অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। আকাশের মেঘগুলোর তখন ঝরে পড়ার অবস্থা। পাশের বরফের পাহাড়গুলো ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলাচ্ছে। স্নোফল হচ্ছে ওদিকটাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
বিকেল ৪টা। সাড়ে ১৪ কিলোমিটার হেঁটে কাঙ্ক্ষিত সেই এমবিসি (মাউন্ট মাছাপুছারে বেইজক্যাম্প)। অন্নপূর্ণা আর মাছাপুছারের ঠিক ঘা ঘেঁষে এর অবস্থান। অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য এ বেইজক্যাম্পের।
হোটেল ফিশটেইল গেস্টহাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে চেকইন করলাম। সবাই একে একে আসতে শুরু করল, যাদের সঙ্গে পথিমধ্যে দেখা হয়েছিল। এ যেন এক মিলনমেলা। গান আড্ডায় মশগুল হলাম। আমাদের (ট্যুর সময়কালীন) জাতীয় সঙ্গীত, নেপালি গান রেশাম ফিরিরি ও ইংরেজি গান 'কান্ট্রি রোডস' দীপ্ত কণ্ঠে গাইলাম।
এমবিসিতে শীতের যত কাপড় ছিল সব পড়তে হল।বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছিল আরো দুরুহ ব্যাপার। তাপমাত্রা মাইনাস হওয়ায় পরিবেশের সঙ্গে আমাদেরও বরফের মত জমে যাবার অবস্থা।
সন্ধ্যা নামার আগে সূর্য মাছুপুছারের গায়ে লেপ্টে গেল যেন। সে কি এক ভয়াবহ সৌন্দর্য। মনে হল সোনার চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছে।
ডাইনিং রুমটি খুব মজবুত ভাবে তৈরি মনে হলো। শীত প্রবেশের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখানেই রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বিশাল মেনু আজ- ফ্রাইড রাইস, রুটি, ডিম মামলেট, ডিম পোস, কফি, আপেল।
অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু অনেকক্ষণ আগ থেকেই অপেক্ষা করছিলাম ৩টা বাজবার। আর কতক্ষণ? দ্রুত রেডি হয়ে গেলাম। অন্তিম এই প্রথম আমাদের সম্পূর্ণ রেডি অবস্থায় পেল।
ইমরান ভাইয়ের মাথায় হেডল্যাম্প, টুটুল ভাইয়ের হাতে টর্চ আর আমার হাতে মোবাইলের আলো। শীতের সকল প্রস্তুতি নিয়ে যখন হাঁটা শুরু, ঘড়িতে তখন বাজে ৪.১০।
অন্ধকারে ট্রেকিং এই প্রথম। প্রথমে একটু সমস্যা হলেও দ্রুত ওভারকাম করি। চারদিকে সাদা বরফের আবরণের কারণে অন্ধকারেও প্রাকৃতিক আলো পাওয়া যাচ্ছিল। আগাতে আগাতে একসময় কিছু আলো দেখা যাচ্ছিল অনেক দূর থেকে। এক সময় কিছু ঘরও দেখা যাচ্ছিল। অথচ চারপাশে তখনো অন্ধকারের আভা সরেনি। দৌড়ে পৌঁছে গেলাম।
৫.৪২ মিনিট। অন্ধকারে দেখলাম একটি সাইনবোর্ডে লেখা – 'Congratulation! We achieved. Annapurna Base Camp 4130 meter'। আরেকটি বোর্ডে লেখা – 'NAMASTE Annapurna Base Camp'।
চারদিকে অন্ধকার সরে আলো ছড়াচ্ছে। একে একে সবাই ঝড়ো হচ্ছে। সবাই সবাইকে বুকে জড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। ট্রেকারদের অনেকের চোখে হাসির আনন্দের সঙ্গে চোখের কোনে জলও দেখা যাচ্ছিল। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানায় সবাই। বাংলাদেশের পতাকা মাথায় নিয়ে, বুকে জুড়িয়ে প্রিয় মুহূর্তকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করি।
চারপাশের সাদা পর্বত অন্নপূর্ণা সাউথ, অন্নপূর্না-১, গঙ্গাপূর্ণা, আর উল্টোদিকে মাছাপুছার সূর্য ছটায় তখন একেকটা স্বর্ণখণ্ডের রূপ নিয়েছে।
বেইজক্যাম্প অংশটায় কয়েকটা কটেজ আছে। কিন্তু এই মাইনাস ৮ তাপমাত্রায় না থাকাই শ্রেয় মনে করলাম। নাকের পানি গড়িয়ে নিচে পড়ার আগেই বরফ হয়ে যাচ্ছে। ইমরান ভাই বাংলাদেশ থেকে একটা কোকের ক্যান নিয়ে গিয়েছিলেন, বেইজক্যাম্পে খাবেন বলে। আমাদের কারো মাথায় ছিলনা সেটি যে বরফ হয়ে যাবে।
আমরা বরফের মাঝে হারিয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হল। কটেজের ডাইনিং রুমের একটি দেয়ালে বেইজক্যাম্পে আসা লোকদের পাসপোর্ট সাইজের লাখখানেক ছবি আটকানো। পাশে একটি হেলিপ্যাড আছে যাতে পোখারা থেকে অনেকে সরাসরি হেলিকপ্টারে আসতে পারে।
বেশিক্ষণ এ জায়গায় থাকলে জমে যেতে হবে তাই ফিরতে হবে। তবে তার আগে অসংখ্য ছবি-ভিডিও বার্তার মুহূর্তের স্মৃতি সাথে নিয়ে ফিরতে শুরু করলাম আমরা।
কলকাতার দাদাদের একটি অংশ এখানেই থাকবেন। তাদের বিদায় দেয়ার মুহূর্তটা অনেক আবেগঘন ছিল। চারপাশ অবাক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে মাত্র ৪০ মিনিটেই এমবিসিতে পৌঁছে যাই।
সকাল ১০টা। বিদায় এমবিসি। ব্যাম্বুতে রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। খানিক আগাতেই সেই ৮০ ছুঁই ছুঁই জাপানি যুগলের সঙ্গে দেখা। আবারো আবেগি মুহূর্ত। সত্যি এ কয়েকটি দিনে খুব আপন হয়ে গিয়েছিল ওরাও।
আবার যেহেতু নামার পথ বেশি তাই কষ্ট কম হলেও হাঁটুতে চাপ পড়ছিল। তাও যেখানে দুই ঘন্টা লাগার কথা সেসব রাস্তা আমরা এক ঘণ্টাতেই পার হচ্ছিলাম।
দেওরালি- হিমালয়া-দোবান হয়ে ব্যাম্বুতে গিয়ে যখন পৌঁছি তখন সময় ৪.৩০টা। চাইলে সিনুয়া যাওয়া সম্ভব। তবে ট্রেকিংসহ জীবনের প্রতিটি স্তরের জন্য একটি বাক্য আছে-'থামতে জানতে হয়, থেমে যেতে হয়'। এ কথা স্মরণ করে ব্যাম্বুতেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে কিন্তু ২৯.৫০ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে।
সবচেয়ে কঠিন রাস্তার মুখোমুখি হব আজ। তাই ব্রেকফাস্ট নিয়ে একটু সকাল সকাল রওয়ানা দেই। যদিও পারব বলে বিশ্বাস সকলের কিন্তু অনেক কষ্টসাধ্য হবে এটিও জানা কথা।
নির্ভেজাল প্রকৃতির ছায়ায় ছায়ায় এগোচ্ছি আমরা। অনেক উপরে উঠতে হচ্ছে। সিঁড়িতে ওঠার এক অভিনব কৌশল আবিষ্কার করলেন ইমরান ভাই। তার মতে সিঁড়ির এক কর্নার দিয়ে একটু বাঁকা করে উপরের দিকে উঠলে কষ্ট কম হবে। এভাবে আপার সিনুয়া তারপর লোয়ার সিনুয়াতে গিয়ে বিশ্রাম। এখান থেকেই একবুক সাহস আর প্রচণ্ড দম নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যে যেতে হবে। কারণ মাঝখানে আছে কয়েক হাজার সিঁড়ি।
লোয়ার সিনুয়াতে মোবাইলের নেটওয়ার্ক ভালোভাবে পাওয়া যায়। ইমরান ভাই আর টুটুল ভাই ফরজ (আবশ্যকীয় কথা বলতেই হবে) কাজগুলো সেরে নেয়। আমি আবার একদম নেটওয়ার্কের বাহিরে থাকি যখন ঘুরতে যাই।
হট লেমন, ডিম মামলেট, জুস, মধুসহ যার যা আছে সব খেয়ে আবার হাঁটা শুরু হলো আমাদের। মন্ত্র একটাই। শুরু করলে শেষ হবেই।
হাজার সিঁড়ি পার হবার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবেনা। শুধু বলব-শুয়ে কাত-চিত হয়ে, কখনো কখনো জিহবা বের করে সামনের দিকে ঝুঁকে নিঃশ্বাস ছেড়েছি। সিঁড়ি শেষ করে যে বিজয় চিহ্ন দিয়ে ছবি উঠিয়েছি তার সাথে বেইজক্যাম্প জয়ের আনন্দের কোনো কমতি নেই।
চমরং। আতঙ্ক আর আনন্দ মিশে আছে যে নামের সাথে। কারণ এখান থেকেই কঠিন ট্রেক শুরু আর এখান থেকেই বলা যায় কষ্টের ট্রেক শেষ। আর এই চমরং ছাড়া অন্নপূর্ণা বেইজক্যাম্পের দিকে যাওয়া সম্ভব না।
এসিসি চেকপোস্টে মিশন কমপ্লিটের কাগজাদি সই করিয়ে লাঞ্চের জন্য সেই প্যানারোমা হোটেল গন্তব্য এবার। এখানে ফেলে রেখে যাওয়া কিছু কাপড় ছিল সেগুলো বুঝে নিয়ে লাঞ্চ সেরে দ্রুততার সঙ্গে চমরং বিদায় দিয়ে গন্তব্য এবার ঝিনু ডান্ডা।
যদিও চমরং থেকে ঝিনু দেখা যাচ্ছিল একটু নিচেই। কিন্তু হাজার হাজার খাড়া সিঁড়ি নামতে হাঁটুর অবস্থা নাজুক। একটু পা পস্কালেই কত বড় বিপদ হতে পারে তা বলা দুরূহ বিষয়।
অবশেষে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার হাঁটার পরিসমাপ্তি ঘটে দুপুর ২.৩৫ মিনিটে ঝিনু ডাণ্ডার তিব্বত রেস্টুরেন্টে চেকইনের মধ্য দিয়ে।
হট স্প্রিং। তাও আবার ন্যাচারাল? পাহাড় বেয়ে দুটি চৌবাচ্চায় গরম পানির ব্যবস্থা রয়েছে যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। দ্রুত হোটেলে ব্যাগ রেখে হটস্প্রিং এর উদ্দেশ্যে ছুটলাম। প্রতিজন ১০০ রুপিতে টিকেট করে আরো আধা ঘন্টা হেঁটে উপস্থিত মদী খোলা নদীর পাশে অবস্থিত উন্মুক্ত হটস্প্রিং এর প্রান্তে।
উষ্ণ পানি যেন দীর্ঘ ট্রেকের ক্লান্তি সারাতে উষ্ণ অভিবাদন জানালো। চারদিকে শীতের মধ্যেও এ জলের গরম থাকা সত্যিই প্রকৃতির বিস্ময়। বিদেশিরা দলে দলে আসছে। টানা দুই ঘন্টা পানিতে লুটোপুটি খেয়েছি।
রাতে এক অপরিচিত লোক রুমে এসে বললেন, আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? দীর্ঘ নয় দিন পর দেশি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েই গল্প জমে উঠল। ওয়াহিদ ভাই পেশায় চিকিৎসক। বসেন এ্যাপোলোতে। একাই এসেছেন। আড্ডার মাঝে দরজায় করাঘাত- 'খানা রেডি হ্যায়'। টেবিলে দেখি খাসির গোস্ত, সাদা ভাত আর রুটি। পরে আবার ডিম মামলেট।
সকাল ৭টা। নাস্তার টেবিল থেকে ডাক আসল। সাজানো আছে বম্বে রুটি আর হানি উইথ ডিম আইটেম। দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রাথমিক উদ্দেশ্য বাসস্ট্যান্ড। খানিক নেমেই ১৫ মিনিটের মত দীর্ঘ ঝুলন্ত ব্রিজ পার হতে হল, যার নাম নিউ ব্রিজ। এটি মূলত কিউমি-সিউয়া এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে।
আবার ট্রেক। ঘন্টা খানেক পরে কাঙ্ক্ষিত সিউয়া বাসস্ট্যান্ড। ছোট একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে সরাসরি পোখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। পথিমধ্যে অন্তিমকে বিদায় জানাতে হলো।
পোখারা। দুপুর ১২টায় পৌঁছে গেলাম। ট্যুরিস্ট বাসস্ট্যান্ডে নেমেই মাছ-মুরগী দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম।
ইমরান ভাই ড্রাইভারের পেছনের চারটি আসনের তিনটি কিনে নিলেন। সে কি গল্প শোনালের এ কৃতিত্বের। আমরাও বাহবা দিয়ে গেলাম। কিন্তু তখনো বোঝার বাকি ছিল যে কি ঘটতে যাচ্ছে আগামী কয়েকটি ঘন্টা। এ যাত্রা ছিল না ভোলার মত ভয়ঙ্কর। একে তো চার জনের আসনে ছয় জন বসা, তার উপর বিদেশি বলে বাড়তি ভাড়া চাওয়া। তৃতীয়ত, টানা পাঁচ ঘন্টা অট্টহাসি আর উচ্চস্বরের বকবকানি শোনা হয়ে উঠেছিল অসহনীয়। রাত সাড়ে নয়টায় কাঠমান্ডুতে নেমে রেহাই পেলাম।
অক্টোবর ৩১। হলউইন নাইট। রাতের থামেল এক অসাধারণ রূপ ধারণ করেছে। ওয়েও এ্যাপসের মাধ্যমে ইতিমধ্যে হোটেল ফেলসিটিতে রুম বুক দেয়া হয়ে গেছে। তার আগে পেটকে সান্তনা দিতে হবে। গন্তব্য সোজা আল মদিনা হোটেল। ব্যুফে স্টাইলে খাওয়া-দাওয়া চলল। সাথে আছে বাংলা ভাষায় আলাপ। ট্যুরের চমক হিসেবে আবির্ভূত হলো কায়সার সজীব ভাই। চলল সারারাত থামেল ঘুরে বেড়ানো। হলউইন উৎসব উদযাপন।
পরের দিন নেপাল-তিব্বর বর্ডারে বাঞ্জি ও ক্যানিয়ন সুইং অ্যাক্টিভিটিতে সারাদিন কেটে যায়। কাঠমান্ডু যখন ফিরি তখন রাত প্রায় ১০টা। থামেল নেমেই গন্তব্য আল মদিনা হোটেল। সেখানে দেখা হল 'ইয়ালা পিক' জয়ীদের সঙ্গে। বাংলাদেশের সুজন ও সাদিয়া রোপ-৪ এর পরিচালক মাহী ভাইয়ের নেতৃত্বে গিয়েছিল এ অভিযানে।
হোটেলেই দেখা মিলল কায়সার সজীবের সঙ্গে। ইমরান ভাইসহ হালকা ভাবে রাতের ডিনার খেয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা শুরু। এদিকে টুটুল ভাই ব্যস্ত আসাদ ভাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষায়। দেখা হলো লিজেন্ড ভাই ও মামুন ভাইয়ের সঙ্গে। রাত ২টা পর্যন্ত চলে থামেলের বিভিন্ন স্পটে ঘোরাঘুরি।
সকাল ৮টা। থামেলের দোকানপাট মাত্রই খুলছে। ছুটোছুটি করে শপিং শুরু। গণহারে কয়েকটা আইটেম কিনে ভোঁদৌড়। নাস্তাও করা হয়নি। বাংলাদেশ বিমানের ০০৭২ এর ফ্লাইট টাইম দুপুর ১.০০টা।
বিমানবন্দরের ওয়াইফাই থাকায় অনলাইনে আসার সুযোগ হল। বিদায় 'নামাস্তে নেপাল'। বিদায় ত্রিভূবন – ছোট্ট একটি স্ট্যাটাসে জানিয়ে দিলাম সবাইকে। বেইজক্যাম্পের স্মৃতি নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, আসছি তোমার তরে।