পাটগ্রামে বাংলাদেশের বীভৎস অবয়ব

হাসান তারিক চৌধুরী
Published : 4 Nov 2020, 07:12 AM
Updated : 4 Nov 2020, 07:12 AM

পাটগ্রামে মানুষ হত্যার পৈচাশিক উল্লাস বাংলাদেশের এক বীভৎস অবয়ব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। ফেইসবুক কিংবা ইউটিউবের এই যুগে মুহূর্তেই এই ভয়ানক খবর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে নিরীহ সহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কারণ, এটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল যে, বাংলাদেশ অনেক আগেই এমনই এক অন্ধকারের দিকে রওয়ানা করেছে। গুলশানের হলি আর্টিজানের পৈচাশিক হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে দেখুন? আসলে সবই আমাদের সয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম, জর্দানো ব্রুনোর কথা। যিনি ছিলেন পঞ্চদশ শতকের বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, ধর্মযাজক, বিশ্বতত্ত্ব বিশারদ। ইতালির যাজকরা শুধু ভিন্নমতের কারণে রাজধানী রোমের কেন্দ্রে ফিওরি নামের এক বাজারে ব্রুনোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। সেদিন সেখানকার হাজারো অধিবাসী ব্রুনোর আর্তচিৎকার নীরবে তাকিয়ে দেখেছে। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। সংখ্যালঘু রোমান যাজকশ্রেণির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি সংখ্যাগুরু সাধারণ জনতা।

পাটগ্রামের বুড়িমারিতে শুধু একটা গুজবের ওপর ভর করে ধার্মিক জুয়েলকে দিনে দুপুরে সবার সামনে পিটিয়ে মারল! পৈচাশিক উল্লাসে তার মৃতদেহ পোড়াল তারই ধর্মের, তারই এলাকার লোকেরা। তখন কোনো মানুষ প্রতিবাদ করল না। আজ থেকে কয়েক যুগ পরে কোনো সভ্য মানুষ যদি প্রশ্ন করে- জুয়েলকে হত্যার মুহূর্তে সে এলাকায় কি কোনো শিক্ষিত মানুষ ছিল না? কোনো ইমানদার, বিবেকবান মানুষ কি ছিল না? কেউ যদি প্রশ্ন করে, একদা শিক্ষক, গ্রন্থাগারিক, নিরীহ এবং কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জুয়েলকে হত্যা করে উন্মত্ত জনতা সৃষ্টিকর্তার কতটা নৈকট্য হাসিল করতে পেরেছে? বিধাতাকে আদৌ খুশি করতে পেরেছে কি না? অথবা এভাবে মানুষ হত্যা ইসলাম কিংবা দেশের প্রচলিত আইন সমর্থন করে কি না? এ সব প্রশ্নের উত্তর স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক হবে। তাহলে কেন এই বর্বরতা? কেন এই মানসিক বৈকল্য?

এই মানসিক বৈকল্য একদিনে তৈরি হয়নি। ধর্মকে ভোটের এবং রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর যে বিশ্রী চর্চা যুগ যুগ ধরে চলছে এ তারই ফল। লালমনিরহাটের এই আগুনের হলকা শুধু বাংলাদেশেই নয়। গোটা ইসলামি জাহানকে দোজখের আগুনে পোড়াচ্ছে। সেই আগুনে ঘি ঢালছে খ্রিস্টিয় মৌলবাদের রচিত 'ইসলামোফোবিয়ার তত্ত্ব'। আজ থেকে ছয় বছর আগে জুয়েলের মতোই ভাগ্য বরণ করেছিল পাকিস্তানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান দম্পতি শামা বিবি এবং শাহজাদ মসীহ। পবিত্র কোরান অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে লাহোরের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের গ্রাম কোট রাধাকিষানের উন্মত্ত জনতা প্রথমে পদদলিত করে এবং পরে আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে এই নিরীহ দম্পত্তিকে। এই অসহায় খ্রিস্টান দম্পত্তির দশ বছর বয়সি পুত্র সুলেমান এবং দুই বছরের কন্যাসন্তান পুনমকে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের নির্মম চিত্র দেখতে হয়েছে। তখন সরব হয়েছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। যার ফলে ঘটনার পর তখনকার পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, খুনিদের রেহাই দেয়া হবে না। ২০০৬ সালে সেই মামলা লাহোরের অ্যান্টি টেররিজম কোর্টে নেয়া হয়। ১০৩ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। ৯৯ জনকে খালাস দেয়া হয়। সেদিন লাহোরে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামীদের মধ্যে ছিলেন এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এক চাতাল মালিক ইউসুফ গুজ্জর। যে কিনা তার সঙ্গে খ্রিস্টান দম্পত্তির আর্থিক লেনদেনের দ্বন্দের বিষয়কে এরকম এক ধর্মীয় উন্মাদনার রূপ দেয়। তদন্তে বের হয়ে আসে চাতাল মালিক ইউসুফ গুজ্জর তার পাওনাদার সংখ্যালঘু খ্রিস্টান দম্পত্তির মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তাই সে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ এনে গ্রামবাসীকে খেপিয়ে তোলে। এক চরম ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে এবং নিরীহ খ্রিস্টান দম্পত্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ শতাব্দীর অন্যতম এক জঘন্য নরহত্যা পাকিস্তানের যে গ্রামে ঘটেছিল, সে গ্রামটির নামাকরণ হয়েছিল প্রেমের অমর প্রতীক রাধা-কৃষ্ণের নামে। আমি জানি না এ হত্যাকাণ্ডের পর সে গ্রামের নামটি পালটে গেছে কি না। লাহোরের সেই গ্রামে কেউ মানব প্রেমের কথা উচ্চারণ করে কি না! কেউ প্রেমের কবিতা পড়ে কি না!

শামা বিবি এবং শাহজাদ মসিহের রক্তঝরা আর্তনাদ পাকিস্তানে ধর্মের উন্মত্ততায় মানুষ হত্যা বন্ধ করতে পারেনি। কোট রাধাকিষান গ্রামের বর্বরতার ঠিক একমাস বারো দিন পর এই ধর্মের নামেই পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি স্কুলে জঙ্গি হামলা চালানো হয়। জঙ্গিদের বুলেট একশ বত্রিশজন নিরীহ স্কুলছাত্রসহ একশ ঊনপঞ্চাশ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড দুনিয়ার চতুর্থ ভয়াবহ স্কুলহত্যাকাণ্ড বলে চিহ্নিত হয়। অনেকে সেদিন প্রশ্ন করেছিল, স্কুলের এই নিরীহ বাচ্চাদের কি অপরাধ ছিল? তারা কি কোনো ধর্মের অবমাননা করেছিল?

লালমনিরহাটে নিরীহ জুয়েলকে পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে মারা পাকিস্তানের ঘটনাগুলোর চেয়ে আলাদা কোনো কিছু নয়। এই বর্বরতা বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য এক বিরাট সতর্ক সংকেত। পাকিস্তানেও সেদিন কেউ পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করেনি। কিন্তু বিনাদোষে তাদের মরতে হয়েছে। লালমনিরহাটের নিরীহ জুয়েলও পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করেনি, কিন্তু বিনাদোষে তাকেও মরতে হয়েছে। ব্রুনোর দেহভস্ম যেমন ইতালির তিবের নদীকে অভিশপ্ত করেছে। তেমনি জুয়েলের মৃতদেহ পোড়ানো ছাই লালমনিরহাটের তিস্তা নদীকে বিচারহীনতার জন্য সাক্ষী রেখে গেছে।

গণমাধ্যমগুলোর খবরে দেখলাম, লালমনিরহাটে সহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও মরদেহ পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মোহন্ত বলেছেন, গুজব ছড়িয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা ও লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে এবং প্রাথমিক তদন্তে আসামিদের শনাক্ত করা হচ্ছে। এসব মামলায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশের গণমাধ্যমসমূহের সংবাদ পরিবেশনের স্টাইল কিংবা উপস্থাপনা থেকে জুয়েলকে পিটিয়ে মারার ঘটনাটিকে কেউ জনতার ভুল বোঝাবুঝি অথবা গণপিটুনি বলেও চালিয়ে দিতে পারেন! কেউ কেউ একে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত জনগণের জীবন রক্ষার অধিকারের কিংবা ৩১, ৩৩ এবং ৩৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের চরম লংঘন বলে হা-হুতাশ করতে পারেন। এসব হা-হুতাশ দিয়ে এ সমস্যার গভীরে যাওয়া যাবে না। শুধু গুজব কিংবা গণপিটুনির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে ঘটনার আসল বিবৃতি শেষ হয়ে যায় না। কারণ, যেকোনো ধরনের গুজবেই মানুষ উন্মত্ত হয়ে নরহত্যা করে না। যে ধরনের গুজবে জনতা নরহত্যা কিংবা পৈচাশিকতায় লিপ্ত হয়, সে ধরনের গুজবের একটা ভিন্নরকম শক্তি থাকে। সে শক্তি ধর্মান্ধতার, পশ্চাদপদতার এবং রাজনৈতিক উগ্রতার। এ অপশক্তির বলেই মানুষগুলো খুনি এবং রক্তলোলুপ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি সমাজের মধ্যে জমতে থাকা বিচারহীনতা, অজ্ঞানতা আর মেধার অবমূল্যায়ন এ অপশক্তির বাড়তি টনিক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং মানুষ হত্যার গুজবের এক সামাজিক মনস্তত্ত্ব আছে। রাজনীতি আছে। আমরা অনেক সময় এই সামাজিক মনস্তত্ত্ব, এই রাজনীতিকে টার্গেট না করে প্রচণ্ড ক্ষতের ওপর রেশমী মলম লাগাই। শেকড় ছেড়ে ঝরা পাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তাই অন্ধকারের দিকে এই ভয়ানক আত্মঘাতী যাত্রা এখনই থামাতে হবে। এজন্য চাই, উপযুক্ত দর্শন, উপযুক্ত রাজনীতি। শুধু আইন জারি করে পশ্চাদপদতার সামজিক মনস্তত্ত্ব পুরোপুরি বদল করা যায় না। কারণ, আইনকে এবং আইনের শাসনকে দাঁড়াতে হয় অগ্রসর সামজিক মনস্তত্ত্বের ওপর ভর করে। এরপরও আমি বলব, পাটগ্রামে জুয়েলকে হত্যা এক ধরনের মানবতা বিরোধী অপরাধ। যার দায় আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। তবে সবচেয়ে বেশি দায় নিতে হবে পাটগ্রামের সাংসদ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে। সহিংসতার ভিত্তিভূমি নির্মূলে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা, রাতারাতি পাটগ্রামের মানুষ ধর্মান্ধ কিংবা রক্তখেকো হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে খানিকটা শেখার আছে। কারণ, ভারতের রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ এই বিপদের বার্তাটি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে গণপিটুনি রোধে নতুন বিল পাস করা হয়েছে। গতবছর ৩০ অগাস্ট রাজ্য বিধানসভায় 'দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রিভেনশন অব লিঞ্চিং) বিল, ২০১৯' নামের বিলটি পাস করা হয়েছে। মূলত, ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত বিভেদ ও বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে ভারতে যেভাবে পিটিয়ে মারার প্রবণতা বাড়ছে, তা রোধ করার জন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বিল পাস করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে গণপিটুনিতে কারও মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে এই বিলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে দোষী ব্যক্তিকে দিতে হবে এক লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা। আর জখম হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ রুপি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। গুরুতর জখম করা হলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ তিন লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ফেইসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে মানুষ হত্যা বা গণপিটুনির মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হলে এর জন্য নেপথ্য ব্যক্তিরও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সাক্ষী বা আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানো হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। এ ক্ষেত্রে হামলায় আহত ও গুরুতর জখম ব্যক্তিদের পক্ষে বিনামূল্যে আইনি সাহায্য দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে। তাদের সরকারি এবং পৌরসভা ও করপোরেশনের হাসপাতালে বিনা খরচে চিকিৎসা দেওয়ার কথাও এই আইনে বলা হয়েছে। লালমনিরহাটের এই বর্বর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশেও একই ধরনের আইন প্রণয়নকে অনিবার্য করে তুলেছে। এতে কিছুটা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কারণ, আমরা কিছুতেই আমাদের আগামী প্রজন্মেকে পেছনের শতাব্দীতে ঠেলে দিতে পারি না। তাই কবি কাহলিল জিব্রানের কথাতেই বলি,

"…………… তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু

তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা কোরো না।

কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না। "