মে দিবসের অঙ্গীকার: শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের মূল্য দিতে হবে

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 2 May 2019, 04:16 PM
Updated : 2 May 2019, 04:16 PM

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিবস পয়লা মে চলে গেল আবার দেশ ও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে। প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর সুদূর পরাহত। কিছুতেই ভুলতে পারছিনা রানা প্লাজার সেই চরম ট্রাজেডিকে। সাভারের রানা প্লাজার বহুতল ভবন ধ্বসে সেদিন মারা গিয়েছিলো শত শত শ্রমিক। পঙ্গু ও নিখোঁজ ছিল অসংখ্য জন। যা দগদগে ঘার মতো আমাদের সকলের মনে আজও বিরাজমান। এদেশের শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের অর্থলিপ্সু মালিকেরা আগেও দেয়নি, এত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আন্দোলন, সংগ্রামের পর এখনও সেই অবস্থার চিত্র সন্তোষজনকভাবে বদলায়নি। চরম ঝুঁকির মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করার হীন প্রবণতা এখনও বিরাজমান। নিরাপদ কর্ম সহায়ক পরিবেশ, নিরাপত্তার অভাব এবং দূর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং উদ্ধারের জন্য দক্ষ প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত যুগোপযোগী উদ্ধার সামগ্রী না থাকায় এই শিল্পের ভাবমূর্তি ও গার্মেন্টস শিল্পের কর্ম পরিবেশ কে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

২৩০ বছর আগে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা, আটঘণ্টা কাজের দাবি, ন্যায্য মজুরি ও সুস্থ পরিবেশের দাবিতে ছয়জন শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো আজ এত বছর পরেও বাংলাদেশের শ্রমিকের জীবনের নুন্যতম নিরাপত্তা শুধু নয়, মানুষের মর্যাদাটুকু দেয়া হচ্ছেনা। এই লজ্জা এই ব্যর্থতার গ্লানি এই শতাব্দীর মানুষ ঢাকবে কী দিয়ে? গত ছয় বছরেও কেন পোশাক শ্রমিকদের কান্না থামেনি? আহত শ্রমিকরা কেন হাজারো সমস্যা নিয়ে আজো নির্বাক জানতে হবে। গত ২৩ এপ্রিল আশুলিয়ায় শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের মানববন্ধনে আহত শ্রমিকদের আহাজারি গণ-মাধ্যমে উঠে এসেছে। কোন রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা নিলুফার বেগম বলেছেন, সেদিন বের হতে যেয়ে একটি পা নষ্ট হয়ে গেছে। পা হীন এই অক্ষম মানুষটি আজো চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি সরকারের কাছে বেচে থাকার জন্য সাহায্য চেয়েছেন।

শিলা বেগম অভিযোগ করেছেন শুনেছি কেউ কেউ দশ, বিশ লাখ টাকাও পেয়েছে কিন্তু আমরা অনেকেই পাই নাই। সন্তানের মুখে দু'মুঠো অন্ন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়ার যে স্বপ্ন দেখে আমরা ঢাকা এসেছিলাম তা শেষ হয়ে আমরা এখন পথে বসেছি। জানা গেছে শিলা বেগমের মেয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এ বছর সে এইচএসসি দেবে। শিলা আক্ষেপ করে বলেছেন এই স্বপ্নটুকু যদি পূরণ না হয় তাহলে তার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। পঙ্গু, বঞ্চিত আশাহত শ্রমিকরা এই মানববন্ধনে দাবি জানিয়েছেন, রানা প্লাজার শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী ৪৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ, পুর্নবাসন, আজীবন চিকিৎসা সেবা, আহত নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়া, আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং উদ্ধার কর্মীদের চিকিৎসা এবং নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ সহ বিভিন্ন দাবি, যা তাদের প্রাণের দাবি, অবিলম্বে মেনে নেয়া হোক। দেশের সচেতন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সকলে এ দাবির পক্ষে।

কিছুদিন আগে বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন ধরলো, চুড়িহাট্টার আগুনের ঠিক ৩৬ দিন পর এই আগুন আবার চোখে আংগুল দিয়ে দেখালো কর্মস্থল কর্মীদের জন্য কতখানি অনিরাপদ, কতখানি জীবন ঝুঁকি সম্পন্ন। নকশা অনুযায়ী ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা এবং সেখানে নেই নির্গমন পথ, নেই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ভবন কর্তৃপক্ষ রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিস ছিল নির্বিকার।

এই ভবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় দক্ষ তরুণ-তরুণীসহ মধ্যবয়সী যাদের প্রাণ দিতে হল, তাদের এই মৃত্যুকে আমরা কিভাবে বিশ্লেষণ করবো! তারা তো নিজেদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ যোগ্য করে চাকরিতে যোগ দিয়েছিল, অনেক আশা-স্বপ্ন-ভালোবাসা নিয়ে। কিন্তু তারা কি জানতো যে ভবনে তারা প্রতিদিন এবং কখনো কখনো প্রায় রাত অবধি কাজ করতেন সেই ভবনটি ভবন কোড মেনে নির্মিত হয়নি, ত্রুটিমুক্ত নয়। এই ভবনে তারা একবোরেই নিরাপদ ছিলেন না। আগুনে পুড়ে কালোধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জীবন বাঁচাতে বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে অথবা পাইপ বেয়ে বেয়ে নামতে যেয়ে প্রাণ হারালেন এরা । মারা গেলেন স্বামী, গর্ভবতী স্ত্রী, তরুণ দম্পতি সহ ১৯ জন। প্রাণ দিলেন এদের বাঁচাতে গিয়ে এক তরুণ উদ্ধারকর্মীও। মৃত্যুর মুখে নেমে আসতে যেয়ে অনেকেই বেপরোয়া হয়ে নানা ঝুঁকি নিয়েছেন। পুরনো ঢাকার চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে এমনি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকেও জীবন দিতে হয়েছে। এই সব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কাজ করছে চরম সমন্বয়হীনতা। পূর্ব প্রস্তুতি এবং নির্গমনের সুপ্রশস্ত ব্যবস্থা এবং পানি ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এর ভয়াবহতাকে বহুগুণ বাড়িয়েছে। আমরা আশা করবো ব্যবসায়ীরা মানুষ হবেন, তাদের মনুষত্ব এবং বিবেক জাগ্রত হবে, সরকারও দায়িত্বশীল হবেন। আমরা আশা করবো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাবেন। আমাদের মেয়েরা এখন সংসদে মনোনীত পঞ্চাশ জন এবং স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন অনেকে। এই নারীরা এখন রাজনৈতিক শক্তি ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। অভিজ্ঞতাও বাড়ছে তাদের। কাজেই আশা রাখতে পারি জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটলে এ দেশের রাজনীতির অনেকটাই নারীরা পাল্টে দিতে পারবেন। শ্রমিকদের স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া, পত্র পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শ্রমিকদের দাবী দাওয়ার গুরুত্ব সম্যকভাবে তুলে ধরতে পারলে কিছু পরিবর্তন আসবেই।

প্রতিটি দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত খুব দরকার। প্রায় সব তদন্ত কার স্বার্থে মাঝপথে থেমে যায় সেটাও সরকারকে অনুসন্ধান করতে হবে। কারণ যে কোন দুর্ঘটনাই জিএসপিতে প্রভাব ফেলবে। বড় আকারের যে কোন দুর্ঘটনাই বিশ্ব মিডিয়াতে যেভাবে উঠে আসে, তাতে শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র দেখে নিন্দার ঝড় ওঠে। তাতে এর একটি সুদূর প্রসারি ভূমিকা ঘটে এ ক্ষেত্রগুলোতে। যা এদেশের জন্য কোন অনুকূল বার্তা নিয়ে আসবেনা। আমরা জানি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ বড় হতেই থাকবে। আমরা এই নির্মম সত্যটি প্রতিনিয়ত অনুভব করি। গার্মেন্টস শিল্প কারখানা এবং বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এক ধরনের বাণিজ্য এবং সেই বাণিজ্যের সাথে কায়েমি স্বার্থ, রাজনীতি, ক্ষমতার টানাপড়েনও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বাণিজ্যের এবং নানা ক্ষমতাবান মানুষের স্বার্থের এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও ব্যবসায়িক মুনাফার প্রয়োজনে এই শিল্প কারখানাগুলোর কাছে মানবতা মুখ থুবড়ে পড়ছে। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা, কাজের পরিবেশ, শ্রম আইন অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ কিছুই নিশ্চিত করা হচ্ছে না। অথচ মালিকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের একটি বড় অংশ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ব্রিটেন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। পরিবারের অধিকাংশ সদস্য থাকে বিদেশে। আয়েশি জীবনযাপনের জন্য তাদের জন্য মোটা অংকের টাকা পাঠানো হয়। মালিকদের এই বিদেশমুখি অবস্থান এবং কতিপয় শ্রমিক নেতা-নেত্রীর কোটরী স্বার্থ রক্ষার কারণে এই কারখানাগুলোকে টাকা উৎপাদন এবং এখনও গরীব মারার ফাঁদ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে আমরা এই দেশটিকে স্বাধীন করেছিলাম। স্বাধীনতার পর সরকারগুলোর গতিশীল নেতৃত্বে দেশপ্রেমকে পুঁজি করে সমস্ত উন্নয়মূলক খাতগুলোকে বিকশিত এবং এক অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করে শ্রমিকবান্ধব এক মানবিক পরিবেশ সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা ব্যর্থ হলাম। কারণ এখানে শোষণের নির্মম প্রক্রিয়াটি বরাবরের মতই সক্রিয়। মূল বিষয় শ্রমিক জীবনমানের উন্নতির দিকটিকে চোরাস্রোতের মতো গোপন এবং নিরুচ্চার রেখে বাইরের খোলসে অনা হয়েছে শ্রমিক দরদের লোক ভুলানো মুখরোচক সব গল্প। আবহমান কাল থেকে হুবহু এই ঘটনার স্রোত নিরন্তর বয়ে চলেছে এদশের খেটে খাওয়া এই সব মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণে। সেই পুরনো শোষক এখনও নতুন মোড়কে আছে, কেবলমাত্র তার চেহারাটা আধুনিক হয়েছে।

আমরা অতীতে দেখেছি একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিজিএমই যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করে তা মূলত নিজেদের রক্ষার জন্যই। তদন্তের নামে লোক দেখানো কিছু তৎপরতা এবং আহতদের পুনর্বাসন ও নিহত পরিবারের ক্ষতিপূরণ দেয়াটাও এক সময় লোক দেখানো প্রতিশ্রুতি হয়ে যায়। ট্রাজেডির সর্ব রেকর্ড ভঙ্গকারী রানা প্লাজার ভয়াবহ এবং অন্যান্য নির্মম হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছে তার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই প্রতারণা যাতে পুর্নবার না হয়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

রাজনীতিবিদদেরও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। কারণ তারা জন মানুষের কল্যানের জন্য কাজ করেন। শ্রমিকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন করে তোলা তাদের দায়িত্ব। আমাদের দেশের শ্রমিক মেয়েরা মনে করেন যে, রাজনীতির কোন নিয়ন্ত্রণ ওদের হাতে নেই। নির্বাচন এলে রাজনীতিবিদরা শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু প্রতিশ্রুতি দেয় বটে কিন্তু শ্রমিকদের স্বার্থ শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় না। যারা রাজনীতিতে টাকার জোগান দেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংসদ তাদের কাছে নতজানু থাকে। নির্বাচনের পর প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখতে পারে না তারা। সংসদে শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন যোগ্য সাংসদ এখন খুব দরকার। জাতীয় নিম্নতম মজুরি ও মজুরি কমিশন বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দরকার। বাজারদরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকদের মজুরি যাতে নির্ধারিত হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। চাকরি ক্ষেত্রে হয়রানি ছাঁটাই এবং মজুরি বৈষম্য সর্বোপরি নারী শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার পথে নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো জাতীয় মনোযোগ দাবি করে।

শোকার্ত স্বজনের কাঁধে আর প্রিয়জনের লাশ আমরা দেখতে চাইনা। চাইনা রুটি রুজির প্রয়োজনে কাজ করতে এসে মূল্যবান জীবনগুলো ঝরে পড়ুক। জীবনের নিরাপত্তা সকলের আগে, এটাই কাজ করার পূর্ব শর্ত হওয়া উচিত।