ব্লগাররা মানুষ নয়, এরা একেকজন পোকা মাত্র!

সীমান্ত প্রধান
Published : 8 June 2015, 07:35 PM
Updated : 8 June 2015, 07:35 PM

প্রগতিশীল, মুক্তমনা ব্লগারদের হিটলিষ্ট অনেক আগেই তৈরি করেছে ইসলামি উগ্রপন্থী, জঙ্গিরা। এটা এখন পুরনো কথা। হিটলিষ্ট ধরে ধরে এক এক করে ব্লগারদের খুঁজে খুঁজে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তারা হত্যা করছে—এটাও নতুন কথা নয়। আগামীকাল আবার নতুন কোনো ব্লগারকে তারা হত্যা করবে—এটাও স্বাভাবিক। এদেশে এখন নুনের চেয়েও ব্লগার হত্যাটা অনেক বেশি সস্তা।

ব্লগার তো আর মানুষ নয়। এরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলে। এরা নারী মুক্তির কথা বলে। এরা মানবতার কথা বলে। এরা অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার আহ্বান করে। এরা মানুষ হয় নাকি! এদেরকে কুপিয়ে হত্যা করা হোক। এদেরকে সৌদি সরকারের আইন অনুযায়ী দোররা মারা হোক। এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী করে; এদেরকে রাস্তায় ফেলে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হাত আর পায়ের রগ কেটে দেয়া হোক। এদেরকে গলা কেটে পশুর মতো জবাই করা হোক; এরা মানুষ নয়, এরা কেবলই ব্লগার। ব্লগারদের মানুষ হতে নেই! এদেরকে কী মানুষ হতে আছে? ব্লগাররা একেকজন পোকা মাত্র!

কেন আমরা ব্লগার হত্যার বিচার দাবি করি! এ দাবি করাটা কী উচিৎ? এ জন্যই হয়তো রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদের এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। ব্লগার হত্যাটা রাষ্ট্র-যন্ত্রের কাছে কাঁধ থেকে পোকা ঝারার মতো। একজন করে ব্লগার খুন করছে খুনিরা, আর রাষ্ট্র-যন্ত্র এ বিষয়গুলোকে পোকা ঝারার মতো কাঁধ থেকে ঝেরে ফেলছে! ব্লগার হত্যায় রাষ্ট্রে নির্লিপ্ততায় এটাই তো প্রতীয়মান। তাই নয় কী?

সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি উগ্রপন্থী, জঙ্গিরা দু'দফায় দেশের বিশিষ্ট-জনদের পত্র মারফত হত্যার হুমকি দিয়েছে। বিনিময়ে রাষ্ট্র আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ১৩ নামক অদৃশ্য একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্র দায়মুক্তি হয়েছে। তাদের এখন আর কোন দায় নেই। কথিত ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছে। এরপর আর তাদের কী কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে?

হত্যাকারী, হুমকি-দাতাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো আর রাষ্ট্রের নয়। এ দায়িত্ব নিশ্চয় রাষ্ট্রের থাকার কথা নয়! তাই কী এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্বারা পরিচালিত গোয়েন্দারা কথিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ১৩'র কাউকে খুঁজে বের করতে পারেনি? আসলে তারা খোঁজচ্ছেন, পাচ্ছেন না! এতে তাদের দোষই বা কী? তারা তো হুমকি-দাতা, হত্যাকারীদের খুঁজে যাচ্ছেন! এতে আমাদের সরকারেরও আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই! জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদ দমনে আমাদের সরকারও বেশ আন্তরিক! তা আমরা সরকারের কর্মকাণ্ডেই বেশ ভালো বুঝতে পারছি।

সরকার যে ব্লগার হত্যাকারী, বিশিষ্ট-জনদের হুমকি-দাতা ইসলামি উগ্রপন্থী, জঙ্গিদের ধরতে কতোটা সচেষ্ট, তা এখন আর কারোরই অজানা নয়। তাই তো সরকারের এমপি-মন্ত্রী, নেতা-কর্মীরা সভা-সমাবেশ, মিটিং বা মিছিলে জঙ্গি দমনের ধোয়া তুলছেন। ফাটিয়ে দিচ্ছেন তারা বক্তৃতা, সেমিনারে। কিন্তু কাজের কাজ ঠুঁটোজগন্নাথ! তাহলে এর অর্থ কী? গোয়েন্দা বিভাগের দুর্বলতা!

আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ তেমনিভাবে কী পরিপক্ব নয়? তাহলে কেন তারা খুঁজে পাচ্ছেনা ব্লগার হত্যাকারী, হুমকি-দাতা ইসলামি উগ্রপন্থী, কথিত জঙ্গিদের? নাকি এ ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছা নেই? নাকি তারা যাদের দ্বারা পরিচালিত, তাদের তরফ থেকে বাঁধাধরা কোন নিয়মের কারণে নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারছেন না?

আমাদের গোয়েন্দারা দক্ষ নয়, তারা পরিপক্ব নয়—এমন অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হলে, তা মোটেও ঠিক হবে না। আমাদের দেশের গোয়েন্দারা যথেষ্ট পরিপক্ব—এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তারা নিজেদের ঠিক মতো মেলে ধরতে পারেন না—এটাই স্বাভাবিক। আমাদের গোয়েন্দারা যে যথেষ্ট পরিপক্ব এতে কারোরই কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কেন না, অমরা ইতোমধ্যে আমাদের গোয়েন্দাদের দক্ষতার অনেক প্রমাণ পেয়েছি।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক: আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তার পুত্রকে নিয়ে একাধিকবার ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ ক'জন কুটোক্তি করেছিলেন। যারা এহেন কর্ম করেছেন, তাদেরকে কিন্তু অনতিবিলম্বেই খুঁজে বের করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কুটোক্তিকারিদের আইনের আওতায়ও নিয়ে আসা হয়েছিলো। তারা কিন্তু কেউ ওই সমস্ত কুটোক্তি প্রকাশ্যে করেননি। তাদেরকে খুঁজে পাওয়াটাও কিন্তু কষ্টকর ছিলো। তারপরও গোয়েন্দারা আধুনিক পক্রিয়ার মাধ্যমে ওই সমস্ত কুটোক্তিকারীকে খুঁজে বের করেছেন, প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তিও হয়েছে। অথচ ব্লগার হত্যাকারী ইসলামি উগ্রপন্থী, জঙ্গিদের কেনো খুঁজে পাচ্ছে না গোয়েন্দারা?

কেনো গোয়েন্দারা এখনো নিশ্চিত করতে পারছে না হত্যাকারীদের অবস্থান? নাকি এতে গোয়েন্দাদের সদিচ্ছা নেই? নাকি ব্লগাররা মানুষ নয়? প্রধানমন্ত্রী আর তার পুত্রই একমাত্র মানুষ? তারা মানুষ বলেই কী তাদের নিয়ে কুটোক্তি করাতে পুরো প্রশাসনই বীণা-ভূমিকম্পে নড়েচড়ে উঠেছে! তাই কি তাদের নিয়ে কুটোক্তিকারীদের চটজলদি গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে?

অথচ আমরা কতোগুলো মেধাকে হারিয়েছি। এখনো হুমকির মুখে রয়েছে অনেক মুক্তমনা, প্রগতিশীল ব্লগার। পত্র মারফত মৃত্যুর হুমকি পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত আমাদের বিশিষ্ট-জনরা। সে ব্যাপারে তারা কেন এতোটা উদাসীন! কেন?

এতে কী দাঁড়ালো? আমরা কি এখনো বলবো, আমাদের গোয়েন্দারা পরিপক্ব নয়? নাকি নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি, আমাদের গোয়েন্দারা সত্যিকার অর্থে নিজেদেরকে; নিজেদের মতো মেলে ধরতে পারছেন না। তাদের লাগাম কোনো অদৃশ্য হাত কি টেনে ধরছে? তাহলে কি ধরে নেয়া যেতে পারে, ইসলামি উগ্রপন্থী তথাকথিত জঙ্গিদের হাতের সাথে এই অদৃশ্য হাতের কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ আছে! যার কারণে এতকিছুর পরও এসমস্ত ইসলামি উগ্রপন্থী, জঙ্গিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে?

একের পর এক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ততায় অনেকেই মনে করছেন, সরকার বুঝে শোণে পা বাড়াচ্ছেন। তারা লক্ষ্য রাখছেন তাদের ভোটের দিকে। ধর্মীয় উগ্রপন্থী অর্থাৎ তথাকথিত জঙ্গি দমনের ফলে যাতে তাদের ভোটের উপর কোনো প্রভাব না পরে। আর তাই তো সরকারের অবস্থা এখন 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'।

আসলে আমাদের সরকার মুখে মুখে যতোই ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওরাক, অন্দর মহলে কিন্তু তারা ঠিকই ধর্মটাকে হাতিয়ার করেই এগুচ্ছে। কেন না মানুষের সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা ধর্মানূভুতি। আর এটাকেই সরকার ডাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আর তাই তো আমাদের মহান কমরেডরা হজ্ব পালনে উৎসাহিত হয়েছেন—আগামী দিনে তসবিহ জপে ভোট আদায় যাতে করা যায়। অথচ তারাই ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওড়াচ্ছে! তাদের এসমস্ত কার্যকলাপ কী হিপোক্রেসি নয়?

যারা আজ মুক্তমনা, প্রগতিশীল ব্লগারদের চিহ্নিত করে হত্যা করছে। যারা ধর্মান্ধতার চাঁদরে ঢেকে দিতে চাইছে এই বাংলাকে। এরা মনে প্রাণে চাচ্ছে এই দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা উজবেকিস্তান হোক।

কিন্তু তারা কী জানে না—এই দেশ এমনি এমনি হয়নি। এই দেশ আমরা পেয়েছি অজস্র রক্ত ঝরিয়ে; বহু ত্যাগের বিনিময়ে—তারা কি জানে না? তারা কী জানে না, যে কোনো বিনিময়ে আমরা আগলে রাখবো আমাদের এই বাংলাকে। কোনো অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেনি আমাদের পূর্বসূরিরা। তারা কী জানে না—আমার সেই বীরদের উত্তরসূরি? জয় বাংলা-জয় হোক মানবতার।