সেই সুমনের ছায়া শরীর যেনো এমপিপুত্র রনি

সীমান্ত প্রধান
Published : 22 June 2015, 06:55 PM
Updated : 22 June 2015, 06:55 PM


সৌভাগ্য বলি না দুর্ভাগ্য বলি! তবে যাই বলি না কেন, এটাই সত্যি, একবার দু'রাত কেন্দ্রীয় কারাগারে কাটিয়েছিলাম। নাহ, সেটা মোটেও সুখকর নয়। জেলখানা কারো জন্য সুখকর হতে পারে না। আবার পারেও, ক্ষেত্র বিশেষ কোনো কোনো মানুষের জন্য। যেমন দেখেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী পুরাণ ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় মহিলা লীগ নেত্রী জেবুন্নেছার ছেলে সুমনকে। জেলখানায় তার রাজকীয় চলাফেরা, সুখকর চিত্র দেখেছিলাম, কাছ থেকে।

দিন তারিখ ঠিক মনে নেই। সময়টা ২০০২ সালের শেষদিকে অথবা ২০০৩ সালের শুরুর দিক হবে। তখন রাষ্ট্র-যন্ত্রের চালিকা শক্তি বিএনপি-জামায়াত। আর আদাজল খেয়ে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ। দেশজুড়েই চলছিলো হরতাল। সরকার পক্ষ থেকে পুলিশকে কড়া নির্দেশ, —বিরোধী দল ঠোকাও! ব্যস, এমন নির্দেশে দিশেহারা পুলিশ, সন্দেহজনক তরুণ-যুবক দেখলেই পাকড়াও করে ভরছে থানা-হাজতে। সেই ধরপাকড়ে আমিও! হরতাল সমর্থক নই, তবুও পিকেটার আমি! কি আর করা, থানা-হাজত, আদালত, এরপর সোজা কেন্দ্রীয় কারাগার পাঠিয়ে দেয়া হলো আমাকে!

নিয়মানুসারে প্রথমদিন কারাগারের যেখানটাতে থাকতে হয় সেটাকে আমদানি বলে জেলখানার মানুষ। সেখান থেকে পরেরদিন পাঠানো হয় আসামীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে। সে মোতাবেক আমার স্থান আমদানিতে। সেদিন আমদানিতে আওয়ামী লীগকর্মী আর আমার মতো মানুষে গিজগিজ। সেখানে ছিলেন লালবাগ এলাকার নামকরা একজন সন্ত্রাসী (নাম মনে নেই)। তাকে ঘিরে অনেকেই বৃত্তাকারে বসে খোশগল্প করছে। একটু পর একজন সুদর্শন যুবক এলো তার কাছে। যুবকটির চুল শ্যাম্পু করা, খয়ের রঙ ফুলহাতা শার্ট, কালো রঙ প্যান্ট ইন করে পড়া। পায়ে চকচকে কালো রঙ শো। হাতের মুঠোয় ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট। আমার কাছে মনে হয়েছিলো সে হয় তো জেলার, নয় তো জেলের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা।

আমদানিতে আমার পাশে থাকা একজনের কাছে থেকে জানতে পারলাম, —সে জেলার বা জেলের কর্মকর্তা নয় (!) তার নাম সুমন। গেণ্ডারিয়ার আলোচিত সায়েম ও শাহিন হত্যা মামলার প্রধান আসামী। খুনের পর লাশ দু'টো ১২ টুকরো করে ম্যান-হুলে ফেলে দিয়ে ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করেছিলো। আমি অবাক, তাহলে সে এতোটা স্বাধীন, স্বচ্ছন্দে! জানা গেলো, —সে মহিলা লীগ নেত্রী জেবুন্নেছার ছেলে। জেবুন্নেছা শেখ হাসিনার বান্ধবী। ততোক্ষণে আমার বোধ হলো। শুধু মনে মনে বললাম, —'শেখ হাসিনার বান্ধবীর ছেলে স্বচ্ছন্দে থাকবে না তো কী আমার মতো অখ্যাত থাকবে'!

একদিন পর জেলখানা থেকে জামিনে ছাড়া পেলাম। বাইরে এসেই সুমন সম্পর্কে জানার কৌতূহল হলো আমার। বিশেষ করে খুন প্রসঙ্গে। সেসময়টাতে মিডিয়ার তেমন প্রসার ছিলো না। ছিলো না হাতের নাগালে গুগোল সার্চইজ্ঞিন। চাইলেই সার্চ করে তা বের করে ফেলব। তাই কারো সম্পর্কে চটজলদি কিছু জানা যেতো না। জানতে হলে পুরনো পত্রপত্রিকা ঘাঁটতে হতো। এতো আগের পত্রিকাই বা কী করে পাব! সম্ভব? সম্ভব হলো আলী আহম্মদ পৌর পাঠাগারের কল্যাণে। সেখানে গিয়ে বের করলাম পত্রিকা। ঘেঁটে জানলাম ঘটনাটি।

ঘটনাটি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুরাণ ঢাকার গেণ্ডারিয়ার। সেসময় মহিলা লীগের নেত্রী জেবুন্নেছার দুই ছেলে সুমন ও সুজন ভীষণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন মায়ের প্রভাবে। সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী হওয়ার কারণে সুমন-সুজনের মা জেবুন্নেছা ছিলেন খুব দাপুটে। পুলিশও তাকে সমীহ করে চলত। মা'য়ের এমন ক্ষমতায় সুমন-সুজন অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

এর ফলশ্রুতিতে তারা ১৯৯৭ সালে গেণ্ডারিয়া রাইফেল ক্লাবে ধরে এনে অসহায় দুই ছেলে সায়েম ও শাহিনকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ গায়েব করার জন্য কসাই ডেকে এনে বার টুকরো করে! অবশেষে প্রত্যক্ষদর্শী এক নারীর স্বীকারোক্তিতে পুলিশের হাতে তারা ধরা পড়ে। এ-ঘটনায় সুমন ও তার সহোদর সুজনসহ ১৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।

এই বার টুকরো জোড়া খুনের ঘটনাটি সেসময় দেশজুড়ে খুব আলোচিত। এ ঘটনায় চারিদিকে নিন্দার ঝড় উঠে। কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার।

সম্প্রতি আবারো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো মহিলা লীগ নেত্রী পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার রনির হাতে জোড়া খুনের মধ্য দিয়ে। এবারো হত্যার শিকার নিরীহ দু'জন। তবে ধরনটা ভিন্ন। এবারকার খুনের ঘটনা ঘটেছে এলোপাথাড়ি গুলিতে। আর সেবার ছিলো পিটিয়ে এবং কসাই ডেকে এনে বার টুকরো করা।

সেসময়কার মহিলা লীগ নেত্রী জেবুন্নেছার আস্কারাতেই বখে গিয়েছিলো তার দু'ছেলে সুমন ও সুজন। এবারো সেই একই, মহিলা লীগ নেত্রী সংসদ সদস্য পিনু খানের আস্কারাতে বখে যায় তার ছেলে বখতিয়ার রনি। ১৯৯৭ আর ২০১৫ সালের মধ্যে দেড়যুগ পার্থক্য হলেও ঘটনা দু'টির মূলে একটিই কারণ, ক্ষমতার অপব্যবহার।

যদিও বর্তমানে জোড়া খুনের ঘটনায় এমপি পুত্র রনি কারাগারে আছে। হয় তো আদালত তাকে সাজা দিবে। সুমন-সুজনের মতো মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তাকে যেই সাজাই দেয়া হোক, কার্যকর হবে তো? নাকি সুমন-সুজনের মতো (যদিও সুমন কারাগারে, কিন্তু ফাঁসির আদেশ বহাল নেই) সে-ও রেহায় পেয়ে যাবে?

দেখা যায়, বার টুকরো হত্যা মামলায় সেসময় দুই সহোদর সুমন-সুজনসহ ১৬ জনের ফাঁসির রায় হয়েছিলো। একজন মহিলা প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। কিন্তু পরবর্তীতে হাইকোর্টে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানিকালে দেখা যায়, প্রত্যক্ষদর্শী মহিলা বেশ কয়েক বছর আগেই গেণ্ডারিয়া এলাকা ছেড়ে চলে যান। মামলার বিচার চলাকালে আসামি-পক্ষের জেরার জবাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিতির সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেননি সাক্ষী। হাইকোর্টে বিচার চলাকালে সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আসামির আইনজীবীরা।

এ ছাড়া আরেকটি অজুহাত, ঘটনাস্থলের মানচিত্র আঁকেননি তদন্ত কর্মকর্তা। হাইকোর্টে এ প্রসঙ্গটিও তোলেন আসামি পক্ষ আইনজীবীরা। মূলত এ দু'টি ত্রুটির কারণেই উচ্চ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন ১৫ আসামি। একমাত্র সুমনের মৃত্যু-দণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এমনটি বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

সেসময় দেশজুড়ে হৈচৈয়ের কারণে সরকারও পিছু হটতে পারেনি। কিন্তু এখন সুমন-সুজনের কথা ক'জনই বা মনে রেখেছে? ভুলে গেছে বার টুকরো হত্যার ঘটনাটিও। যার কারণে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যায় খুনিরা। এবারও হয় তো এমপি পুত্র রনির ক্ষেত্রেও তাই হবে। যখন মিডিয়ার লেখালেখি বন্ধ হবে। আস্তে আস্তে ভুলতে বসবে মানুষ এই জোড়া খুনের ঘটনা। তখন হয় তো তদন্ত বা অন্য কোনো অজুহাতে রেহায় দেয়া হবে এমপি পুত্র রনিকে।

ঘটনার প্রেক্ষিতে এটাই কী এখন মনে হওয়ার কারণ নয়? আর যদি তা নাই হবে, তাহলে এখন থেকেই কেনো জোড় প্রচার করা হচ্ছে, 'রনি মাদকাসক্ত'? এর মানে কী (!) সে যখন ঘটনাটি ঘটিয়েছে তখন সে মস্তিষ্ক বিকৃত? সে সুস্থ মস্তিষ্কের নয়? যার কারণে সে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে! এতে করে আইনেও কিছুটা ছাড় পাবে সে। তাই কী কায়দা করে এমন প্রচার চালানো হচ্ছে?

এদিকে, ঘটনার পর থেকে শোনা যাচ্ছে, রনি তার লাইসেন্স করা পিস্তল থেকে গুলি ছুড়েছে! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একজন বখাটেকে কিসের ভিত্তিতে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিলো? এটা কী আইন সিদ্ধ? যদি তা না হয়, তবে যিনি এ অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছেন তাকেও এই জোড়া খুনের মামলায় আসামী করা হোক। সেই সাথে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে যেন রনি আইনের ফাঁক গলে বের হতে না পারে, এটি কারকেই নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে রনির বিচার কার্য দ্রুত শেষ করা হোক। দ্রুত নিশ্চিত করা হোক তার সর্বোচ্চ শাস্তি। যেনো হত্যার শিকার নিরীহ ওই দু'টি পরিবারকে হতাশা আর আক্ষেপের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে না হয়।