বিচারহীনতার সংস্কৃতির উপহার রাজনের লাশ

সীমান্ত প্রধান
Published : 13 July 2015, 06:20 PM
Updated : 13 July 2015, 06:20 PM


পশুদের প্রাণ আছে কিন্তু বোধ বুদ্ধি নেই, তাই তারা জানোয়ার, হিংস্র পশু। আমাদের প্রাণ আছে বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন, তাই আমরা মানুষ। মনুষ্যত্ব-বোধ আছে বলেই আমরা মানুষ। কিন্তু আমাদের আচার-আচরণ, সামগ্রিক চিন্তা ভাবনায় আমরা কী সত্যি মানুষ? আমারা কি আমাদের আচরণ দ্বারা বনের হিংস্র পশুকেও হার মানাচ্ছি না?

আমরা বর্বর এবং পশুর চেয়েও অধম, সম্প্রতি সিলেটের শিশু রাজন হত্যার মধ্য দিয়ে তা আরো একবার প্রমাণ করেছি। আমরা হিংস্র, আমরা হায়েনা তা বারবারই প্রমাণ করছি আমাদের কর্মকাণ্ডে। আমরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারি বিশ্বজিৎকে। আমরা কিশোর ত্বকীকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দিই শীতলক্ষ্যায়। আমরা প্রকাশ্যে সাতজনকে মেরে পেট কেটে লাশ ভাসিয়ে দিই নদীর জলে! আমরা আমাদের ঔরসজাত কন্যাকেও ধর্ষণ করতে দ্বিধা করি না। আমরা মানুষ না হিংস্র নেকড়ে?

আমরা রাজনীতির নামে শতো শতো নিরপরাধ সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারি। আমরা মনির, সুমির মতো ছোট্ট শিশুদেরকে পুড়িয়ে মারি। আমরা রাজনীতির বলি করি শতো শতো প্রাণ। আমরা মৃত্যুর উল্লাস করি, লজ্জিত কখনো হই না। আমরা মানুষকে জিম্মি করে আমাদের গদির লক্ষ্য স্থির করি। আমরা সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের আড়াল করি। আমরা সামান্য মুনাফার লোভে হাজারো প্রাণ কড়ে নিই, ধ্বংস করি রানা প্লাজা। তারপরও লজ্জাহীণভাবেই আমরা চিৎকার করে বলি-আমরা মানুষ! আমরা মানুষ?

আসলে আমরা কখনোই মানুষ ছিলাম না! পৃথিবীতে কখনোই মানুষ জন্মায়নি! পৃথিবীতে কখনো কোনো মানুষ আসেও নি, যায়ও নি! আমরা যারা মানুষ পরিচয় বহন করি, তারা সকলেই ধর্ম দ্বারা বিভক্ত, একেকজন আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও মুসলমান। আমারা শ্রেণীবদ্ধ, একেকজন ধনী, গরীব, সাদা আর কালোয় বিভক্ত। তাই আমরা মানুষ নই। মানুষের রূপ কেবল ধারণ করে আছি। অনেকটা 'চক্ষু কর্ণ নাসিকাতে আমরা মানুষ হই, আসলে মন ভেতর ঘরে আমরা তাহা নই'। গানের এই চরণটির মতোই আমরা। আমরা লেবাস-ধারী মানুষ। একেকজন আসলে হিংস্র জানোয়ার।

আমরা রাজন হত্যায় ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। আমরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছি। আমরা প্রতিবাদ করছি। দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী করছি। দোষীদের বিচার হবে। ফাঁসি হবে। জেল হবে। জরিমানা হবে। ব্যস? তারপর আবার কোথাও না কোথাও আরো একজন রাজন জন্মাবে। এমন ভাবে নরপশুদের দ্বারা হত্যার শিকার হবে! আমরা আবার প্রতিবাদী হবো। বিচার দাবী করবো। ফেসবুক বেছে নেবো প্রতিবাদের আসল মাধ্যম! ব্যস?

আমরা হয় তো ভাবছি রাজন দরিদ্র ঘরের সন্তান। তাই রাজনের এমন পরিস্থিতি হয়েছে। আমার সন্তানের বেলায় এমনটি ঘটবে না। এ সমস্যা আমার নয়। তাই আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি! কিন্তু একটিবারও কি ভাবছি না, কাল এ সমস্যার সম্মুখীন আমি বা আমাদের নিকট আত্মীয় কেউ হতে পারে! তখন? এই হত্যার সংস্কৃতি আর কতদিন চলবে? আমাদের মনুষ্যত্ব-বোধকে আমরা আর কতদিন শিকয় তুলে রাখব?

একজন পিতার কাছে সন্তানের লাশের মতো এতোটা ভারি আর কিছু নেই। সন্তানের লাশ কতোটা ভারি তা সেই পিতাই জানে যে পিতা কাঁধে বহন করেছে সন্তানের লাশ। ত্বকীর পিতা সন্তানের লাশ কাঁধে করে ঘুরছে বিচার দাবীতে। হয়নি বিচার। মনির, সুমির পিতা ঘুরছে সন্তানের লাশ কাঁধে করে বিচার দাবীতে। হয়নি বিচার। বিচারহীণতার সংস্কৃতির কারণে আজকে রাজনকে লাশ হতে হয়েছে।

সেদিন যদি ত্বকী হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার হতো, তাহলে নরপশুদের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে মরতে হতো না মনির, সুমিকে। যদি মনির, সুমি হত্যার বিচার হতো, তবে আজ রাজনকে লাশ হতে হতো না। এমন বিচারহীতার সংস্কৃতি আর কতদিন চলবে? উত্তর আমাদের জানা নেই।

আমরা রাজন হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি চাই না। আমরা জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাই না। আমরা চাই রাজনের মতো যেন আর কোনো রাজনকে এই পরিণতি বরণ করতে না হয়। আমরা চাই আমাদের শিশুরা নিরাপদ জীবন যাপন করুক। তার জন্য চাই নিশ্চয়তা। আর এই নিশ্চয়তা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য চাই রাজন হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি। যা দেখে ভবিষ্যতেও যেন আর কেউ হত্যা ঘটনায় উৎসাহিত না হয়। রাজন হত্যায় এমন বিচার হোক, এ বিচার যেন কাল থেকে কালান্তর সাক্ষী হয়ে থাকে।

আমরা চাই রাজন হত্যায় যারা জড়িত তাদেরকে রাজনের মতো ঠিক একইভাবে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হোক। আর সেই দৃশ্য ধারণ করা হোক। এবং তা আমাদের মতো জানোয়ারদের শিক্ষার জন্য কাল থেকে মহাকাল পর্যন্ত উপযুক্ত শিক্ষা হয়ে থাকুক।