প্রভা নাকি জলি, অনুকরণ করবেন কাকে?

সীমান্ত প্রধান
Published : 11 Sept 2016, 06:33 PM
Updated : 11 Sept 2016, 06:33 PM


সাদিয়া জাহান প্রভাকে আমরা চিনি বা জানি না, এমন লোকের সংখ্যা একেবারেই নেই বললেই চলে। যে বধূটি পর্দার আড়াল থেকে একদমই বের হন না, সে বধূটিও অন্য কোন অভিনেত্রীকে না চিনলেও প্রভাকে ঠিকই চিনেন। আর মসজিদের ঈমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক, গির্জার ফাদার, মন্দিরের পূজারি কিং বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও তাকে চেনেন বলেই মনে করি।

সে যাহোক। প্রভার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ফিরিস্তি না হয় না-ই টানলাম। তবে তার জীবনে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে নিশ্চিত সুইসাইড করতেন। কিন্তু, প্রভা তা করেননি। কিছুটা সময় নিয়েছেন, নিজেকে ঘুচিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সে অনুধাবন করতে পেরেছেন, আত্মহত্যা মানেই শেষ কথা নয়। আত্মহত্যা যে কোন সময়ই করা যায়। তবে, এতে বীরত্বের কিছু নেই। বরং খারাপ সময়টাকে জয় করে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাটাই সব 'চে বড় এবং বীরত্বের।

সুতরাং প্রভা তাই করেছেন। নষ্ট পুরুষের নষ্টামি আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নষ্ট সব পুরুষদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, 'সুইসাইড' শেষ কথা নয়। প্রথম এবং শেষ কথা বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা বেঁচে থাকা। জীবনকে উপভোগ করা। জীবন মানেই সত্য ও সুন্দর। আর সেই সত্য ও সুন্দর জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখেছেন তিনি।

তবে, এই প্রভার মতো করে কেন অন্যরা বুঝে না! হতাশা, গ্লানি আর শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে? কেন তারা পারে না, ঘুরে দাঁড়াতে, জীবনকে ভালোবাসতে? যদিও আমি জানি যে, আত্মহত্যার পথ মানুষ খুব সহজেই বেছে নেয় না। যখন জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা চলে আসে, কেবল তখনই মানুষ এ পথে আসে। আর সেটা কতটা যন্ত্রণার, কতটা গ্লানির, সে আমিও কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছি নিজের জীবন থেকে।

প্রতিটি মানুষের জীবনেই দুঃখ-কষ্ট থাকে। থাকে পাওয়া, না পাওয়ার কিছু হতাশা। আর কোন জীবনে যদি দুঃখ-কষ্ট, আশা-নিরাশা, সফলতা-ব্যর্থতা কিংবা ভালো-মন্দ আলোচনা-সমালোচনা থাকে, তবে কী সেটি কোন জীবন? বোধ করি না। এমনটি কোন জীবনের পর্যায় পড়ে না। এগুলো রঙ করা পুতুল কেবল। কেন না, প্রতিটি জীবনই এক একটি যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিটি মুহূর্তে যে মানুষ যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, সেটিই প্রকৃত জীবন। তারাই জানেন জীবনের স্বাদ কতটা?

মানুষ এমনটি বুঝেন। জানেন। অন্যকেও বুঝান এসব। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করতে পারেন না। হতাশ হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে বেছে নেন আত্মহত্যার মতো জঘন্য একটি রাস্তা। এর সংখ্যাটা পুরুষের 'চে নারীই বেশী। আবার শিক্ষিতর 'চে অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিতই বেশী। উচ্চ-শিক্ষিতদের মধ্যে আত্মহত্যা খুব কম মানুষই করেন। কারণ, তারা জানেন জীবনটা তুচ্ছ বা তাচ্ছিল্য নয়। জীবনটা এভাবে শেষ করে দেয়ার নয়। জীবন উপভোগ করার। জীবনে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ।

অনেক শিক্ষক তাদের শিক্ষার্থীদের এমন শিক্ষা নিশ্চয় শিখিয়ে থাকেন? বুঝিয়ে থাকেন চেনা-জানা হতাশাগ্রস্ত অনেককেই? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলিও এমনটি তার ছাত্র-ছাত্রীদেরও শিখিয়েছেন, নিশ্চয়? তাহলে সেই তিনি কী করে আত্মহত্যা করেন (!) তা কোন ভাবেই বোধগম্য নয়। বিশ্বাস করার মতো নয়। তারপরও তার সুইসাইড নোট কিংবা প্রাথমিকভাবে এটাই ধরে নেয়া হচ্ছে তিনি আত্মহত্যাই করেছেন!

শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষের দরজা ভেঙে জলির মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। এই কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। কয়েক বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে তার। সে স্বামী একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদ। তাদের সন্তান সোয়াদ ঢাকার একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র।

জলি সুইসাইড নোটে লিখেছেন, 'আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক ও মানসিক চাপের কারণে আমি আত্মহত্যা করলাম। সোয়াদকে যেন তার বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে সে যেকোনো সময় সন্তানকে মেরেও ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে। আমার মৃতদেহ ঢাকায় না নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেয়ার অনুরোধ করছি।'

সুইসাইড নোটটি যে জলির লেখা, সেটি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করেছেন একই বিভাগের শিক্ষক কাজী মামুন হায়দার রানা। তিনি বলেছেন, 'সুইসাইড নোটের লেখা দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা ওনারই (জলি) লেখা।' এব্যাপারে তার ভাই মো. কামরুল হাসান আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে শনিবার একটি মামলাও করেছেন।

তাহলে জলির সুইসাইড নোট বলে দিচ্ছে তিনি শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন হতেন? তবে সে নির্যাতন কে করতেন? তার স্বামী সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদ? হ্যাঁ, তিনিই যে মূল কালপিট, এতে ভুল কিছু নেই। কেন না, এই স্বামীর কথাই জাহান এক অংশে লিখেছেন তার সন্তান সোয়াদকে ঘিরে।

যেখানে তিনি দাবী করেছেন, সোয়াদকে ছুরিও ধরতেন তানভীর! একজন শিক্ষক কতটা অসভ্য আর বর্বর হলে নিজের সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে? তাহলে আমরা পেয়ে গেলাম জলির আত্মহত্যার নেপথ্যে কে? প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হোক, অবশ্যই হোক।

আচ্ছা শিক্ষিকা জলি শুধু কী একজন উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন? না। এর পাশাপাশি তিনি একজন উচ্চ মানসিকতা সম্পন্ন মানুষও ছিলেন। যেটি তার সুইসাইড নোটে স্পষ্ট। কেন না, কোন নিম্ন মানসিকতার কেউ নিজের মরদেহ মেডিকেলে দেওয়ার কথা লিখে যেতেন না। তাই এখানেই প্রশ্নটা জোরালো, এমন মানুষ কী সত্যিই আত্মহত্যা করতে পারেন? যদি পারেন, তবে জীবনের প্রতি তিনি কতটা বিরক্ত ছিলেন? নিশ্চয় ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যার জন্য এ পথ?

তবে আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, এটি আত্মহত্যা! গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক কী করে আত্মহত্যা করতে পারেন! নাহ এটি অসম্ভব। তাহলে কী খুন? অনুমানের উপর তাও বলা যাচ্ছে না। তবে, তার সুইসাইড নোটের সূত্র ধরে এটুকুই বলতে পারি যে, এটি আত্মহত্যাই!

এখন প্রশ্ন হলো, এমন একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ যদি জীবনের ভার বইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তাহলে নতুন প্রজন্ম তথা যাদের জীবন এখনও শুরু হয়নি, তারা কী শিখবে? মৃত্যুই শেষ কথা? মৃত্যুই সব সমস্যার সমাধান? না। মোটেও তা নয়। জলি একজন শিক্ষিকা হতে পারেন, কিন্তু জীবন ধারণের জন্য তিনি আইডল নন। কারণ, তিনি পরাজিত। তিনি জীবন থেকে পালিয়েছেন। পরাজিত মানুষ কখনোই অন্যের অনুকরণীয় হতে পারেন না। অনুকরণীয় হতে পারে তারা, যারা খারাপ সময় ওভারকাম করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। যেমন সাদিয়া জাহান প্রভা।

হ্যাঁ, আমরা আকতার জাহান জলিকে নয়, সাদিয়া জাহান প্রভাকেই উদাহরণ হিসেবে বেছে নিতে পারি জীবন চলার পথে। আমরা প্রভাকেই অনুকরণ করব। তার সাহসিকতার প্রতি কুর্ণিশ করে আমরাও পথ চলব। আর বলব, মৃত্যুই সব সমস্যার সমাধান নয়। জীবনকে উপভোগ করতে হয়। জীবন সত্যি ভীষণ রকম সুন্দর।