খিলাফত: ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস ও পতনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

শেখ মিজানুর রহমান
Published : 4 Nov 2016, 07:57 AM
Updated : 4 Nov 2016, 07:57 AM

মহানবী (স) এর পরলোকগমনের পর শুরু হয় খিলাফত। খিলাফত বা Caliphate ( আরবি থেকে خلافة or khilāfa) ছিল, সরকারের ইসলামি রুপ যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক একতার প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরণের শাসন ব্যবস্থার সরকার প্রধানকে খলিফা বলা হয়। ইসলাম ধর্মমতে বলা হয় বা "খলীফাতুল রাসূলুল্লাহ বা Successor of Messenger of God বা খলীফা (Caliph)"।

মুহম্মদ (স) এর মৃত্যুর পর কে হবেন প্রথম খলীফা ই নিয়ে বিতর্ক বাঁধে। অনেক বিতর্কের পর আবু বকর হন খলীফা। এবং রাশিদুন খিলাফত নামে মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। মাত্র ৩০ বছরেই শেষ হয়ে যায় রাশিদুন খিলাফত। ৬৩২-৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল এ খিলাফত। ৪ খলীফা এ খিলাফত চালান। আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবনে আফফান এবং আলী। নাহরাইনের যুদ্ধের পর বেশ কিছু গোষ্ঠী আলীর বিরোধিতা শুরু করে এবং একপর্যায়ে তারা মুয়াবিয়ারও বিরোধিতা শুরু করে। বিদ্রোহীদের একটি দল আলীকে হত্যা করে কিন্তু মুয়াবিয়াকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। আলীর পর তাঁর পুত্র হাসান খিলাফতের মনোনয়ন পান।

তিনি খলিফা হতে পারেননি। তিনি বিদ্রোহ দমন না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেন সাথে ছিল যসব গোষ্ঠীগুলা এই দু'জনের বা কোনো একজনের আস্থাভাজন ছিল তারাও। চুক্তির শর্ত ছিল- মুয়াবিয়া পাবেন খিলাফতের দায়িত্ব তবে সেটা রাজ্য চালনার জন্য এবং মুয়াবিয়া তার পরে অন্যকাউকে খলীফা মনোনয়ন দিতে পারবেন না। হাসানের মৃত্যুর পরও তিনি সাম্রাজ্য বানাতে পারবেন না। কিন্তু মুয়াবিয়া দ্বিতীয় শর্তটি ভঙ্গ করেন। তিনি তার পুত্র "প্রথম ইয়াজিদ বা Yazid I"কে তার পরবর্তী খলীফা হিসেবে ঘোষনা দেন। এভাবে হাসানের মৃত্যুর পর "খিলাফতে রাশিদুন বা Rashidul Caliphate" এর সমাপ্তি ঘটে এবং "Umayyad Caliphate বা উমাইয়া ফিলাফত'এর শুরু হয়।

"Umayyad Caliphate বা উমাইয়া ফিলাফত"

উমাইয়া খিলাফত (আরবি: الخلافة الأموية‎, al-umawiyya) ইসলামের প্রধান চারটি খিলাফতের মধ্যে দ্বিতীয় খিলাফত। এটি উমাইয়া রাজবংশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। উমাইয়া বংশের শাসন মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (Muawiya ibn Abi Sufyan) কর্তৃক প্রতিষ্ঠা হলেও, ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান ইবন আফ্‌ফানের (Uthman ibn Affan) খিলাফত লাভের মাধ্যমে উমাইয়া পরিবার প্রথম ক্ষমতায় আসে। মুয়াবিয়া দীর্ঘদিন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। ফলে সিরিয়া উমাইয়াদের ক্ষমতার ভিত্তি হয়ে উঠে এবং দামেস্ক তাদের রাজধানী হয়। উমাইয়া খিলাফত ছিল তৎকালীয় সবয়েচে বড় সাম্রাজ্য আর পঞ্চম দীর্ঘ সময়ের সাম্রাজ্য। উমাইয়া বংশ ককেসাস, ট্রান্সঅক্সানিয়া, সিন্ধু, মাগরেব, কর্ডোবা ও ইবেরিয়ান উপদ্বীপ (আন্দালুসিয়া) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

উমাইয়া পরিবার (বনু আবদ শামস নামেও পরিচিত) ও মুহাম্মদ (সা) উভয়েই আবদ মানাফ ইবনে কুসাইয়ের বংশধর এবং তারা মক্কার অধিবাসী ছিলেন। আবদ মানাফের পুত্র হাশিমের বংশে মুহাম্মদ (সা) জন্মগ্রহণ করেন। কুরাইশদের দুইটা ভিন্ন গোত্র ছিল উমাইয়া আর হাশিম (Hashimites)। উমাইয়া ও হাশিমিদের মধ্যে মুহাম্মদ (সা) এর আসার পূর্ব থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল। বদরের যুদ্ধের পর তা আরো বিরূপ অবস্থায় পড়ে। এ যুদ্ধে উমাইয়া গোত্রের তিনজন শীর্ষ নেতা উতবা ইবনে রাবিয়াহ, ওয়ালিদ ইবনে উতবাহ ও শায়বা দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় হাশিমি গোত্রের আলী ইবন আবী তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও উবাইদাহ ইবনুল হারিসের হাতে নিহত হয়। এ ঘটনার ফলে উমাইয়ার নাতি আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের মুহাম্মদ (সা) ও ইসলামের প্রতি বিরোধিতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। উহুদের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পাঁচ বছর পর মুহাম্মদ (সা) মক্কা বিজয় করেন এবং সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দ ইসলাম গ্রহণ করেন। এসময় তাদের পুত্র ও পরবর্তী খলিফা মুয়াবিয়াও ইসলাম গ্রহণ করেন। যেহেতু উসমান নিজের কোনো উত্তরসুরি মনোনীত করে যাননি তাই তাকে রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় না। ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে প্রথম মুয়াবিয়া (Muawiyah I) সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। এসময় আরো ২৫,০০০ মানুষ প্লেগে মারা যায়।

আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধের সময় সমুদ্রের দিক থেকে বাইজেন্টাইন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মুয়াবিয়া মনোফিসিট খ্রিষ্টান, কপ্ট ও জেকোবাইট সিরিয়ান খ্রিষ্টান নাবিক ও মুসলিম সৈনিকদের নিয়ে একট নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। ৬৫৫ তে মাস্তুলের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন নৌবাহিনী পরাজিত হয় এবং ভূমধ্যসাগরের দিক উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম মুয়াবিয়া একজন সফল গভর্নর ছিলেন। তিনি সাবেক রোমান সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি অনুগত ও নিয়মানুবর্তী বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি আমর ইবনুল আসের বন্ধু ছিলেন। আমর ইবনুল আস মিশর জয় করেন ও পরবর্তীকালে খলিফা তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। উসমান তার গোত্রের কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন উসমানের শীর্ষ পর্যায়ের উপদেষ্টা মারওয়ান ইবনুল হাকাম যিনি সম্পর্কে উসমানের তুতো ভাই ছিলেন। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম ইয়াজিদ (Yazid I ibn Muawiyah) তার উত্তরাধিকারি হন। অনেক নামকরা মুসলিম ইয়াজিদের ক্ষমতালাভের বিরোধী ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুহাম্মদ (সা) এর এক সাহাবির ছেলে আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের ও চতুর্থ খলিফার পুত্র হুসাইন ইবনে আলি।

ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া সংঘাত দ্বিতীয় ফিতনা বলে পরিচিত। ব্যাপক লড়াইয়ের পর উমাইয়া রাজবংশ প্রথম মারওয়ানের হাতে এসে পড়ে। মারওয়ানের (Marwan I) প্রথম কাজ ছিল এসময় ইসলামি বিশ্বের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে খলিফা হিসেবে স্বীকৃত আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়েরের বিদ্রোহী দলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। মারওয়ান মিশর অধিকার করেন ও নয় মাস শাসন করার পর ৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মারওয়ানের পর তার পুত্র আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান (Abd al-Malik ibn Marwan) (শাসনকাল ৬৮৫-৭০৫) খলিফা হন। আবদুল মালিকের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম আল ওয়ালিদ "al-Walid I ibn Abd al-Malik" (শাসনকাল ৭০৫-১৫) খলিফা হন। আল ওয়ালিদ একজন দক্ষ নির্মাতা ছিলেন।

আবদুল মালিক ও আল ওয়ালিদ উভয়ের শাসনের সময়কার একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। আল ওয়ালিদের পর তার ভাই সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক "Sulayman ibn Abd al-Malik" (শাসনকাল ৭১৫-১৭) খলিফা হন। ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ইন্দুজ নদীসহ সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চল জয় করেন। সিন্ধু ও পাঞ্জাবের জয় উমাইয়া খিলাফতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিজয় ছিল। রাজস্থানের যুদ্ধের পর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া থেমে যায়। আরবরা ভারত আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু উত্তর ভারতের রাজা নাগাভাতা ও দক্ষিণ ভারতের সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য তাদের পরাজিত করেন। আরব লেখকদের ভাষ্যমতে এরপর খলিফা মাহদি ভারত বিজয়ের পরিকল্পনা বাদ দেন। সুলায়মানের পর তার তুতো ভাই উমর ইবনে আবদুল আজিজ "Umar ibn Abd al-Aziz" (শাসনকাল ৭১৭-২০) খলিফা হন। উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে তার স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। তিনি একমাত্র উমাইয়া খলিফা যাকে প্রচলিত অর্থে সম্রাট হিসেবে নয় বরং প্রকৃত অর্থে খলিফা বিবেচনা করা হয়। উমরকে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয়। উমাইয়া শাসনের সময় অধিকাংশ জনতা ছিল খ্রিষ্টান, ইহুদি,

জরস্ট্রিয়ান ও অন্যান্য ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। তাদেরকে জিজিয়া নামক কর দিতে হত। উমরের মৃত্যুর পর আবদুল মালিকের আরেক পুত্র দ্বিতীয় ইয়াজিদ "Yazid II" (শাসনকাল ৭২০-২৪) খলিফা হন। ইয়াজিদ খিলাফতের সীমানার ভেতরের খ্রিষ্টান ছবি মুছে ফেলার আদেশ দেন। আবদুল মালিকের আরেক পুত্র হিশাম ইবনে আবদুল মালিক "Hisham ibn Abd al-Malik" (শাসনকাল ৭২৪-৭৪৩) এরপর খলিফা হন। হিশামের শাসনের সময় ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে টুরসের যুদ্ধে ফ্রেঙ্কদের কাছে আরব সেনাদের পরাজয়ের পর পশ্চিমদিকে সীমানা সম্প্রসারণ সমাপ্ত হয়। হিশামের পর দ্বিতীয় ইয়াজিদের পুত্র দ্বিতীয় আল-ওয়ালিদ "al-Walid II ibn Yazid" (শাসনকাল ৭৪৩-৪৪) খলিফা হন। তার ব্যাপারে বলা হয় যে তিনি ধর্মীয় দিকের চেয়ে বরং পার্থিব সুখভোগের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। বিরোধিদের মৃত্যুদন্ড দানে ও কাদারিয়াদের উপর নির্যাতনের মাধ্যমে দ্রুত তিনি অনেকের শত্রুতে পরিণত হন। ৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ওয়ালিদের এক পুত্র তৃতীয় ইয়াজিদ "Yazid III ibn al-Walid" দামেস্কে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। তার সেনারা দ্বিতীয় আল-ওয়ালিদকে হত্যা করে। তৃতীয় ইয়াজিদ দয়াপ্রদর্শনের জন্য সুনাম অর্জন করেন এবং কাদারিয়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। শাসনের ছয় মাসের মাথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াজিদ তার ভাই ইব্রাহিমকে "Ibrahim ibn al-Walid" তার উত্তরসুরি মনোনীত করেন। কিন্তু প্রথম মারওয়ানের নাতি দ্বিতীয় মারওয়ান "Marwan II ibn Muhammad" (শাসনকাল ৭৪৪-৫০) উত্তর দিক থেকে একটি সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসেন ও ৭৪৪ এর ডিসেম্বরে দামেস্কে প্রবেশ করেন। এখানে তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। মারওয়ান তাৎক্ষনিকভাবে উত্তরে বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত হারানে তার রাজধানী সরিয়ে নেন। মারওয়ান ইরাকে পুনরায় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন কিন্তু এসময় খোরাসানে আরো বড় হুমকির জন্ম হয়।

আব্বাসীয়দের প্রবেশ

আব্বাসীয় পরিবার কর্তৃক পরিচালিত হাশিমিয়া আন্দোলন (Hashimiyya movement) উমাইয়া খিলাফতকে উৎখাত করে। আব্বাসীয়রা হাশিমি গোত্রের সদস্য ছিল। তবে হাশিমিয়া শব্দটি আলির নাতি ও মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়ার পুত্র আবু হাশিম থেকে এসেছে বলে মনে হয়। ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া হাশিমিয়া কর্মকাণ্ড খোরাসানে অনুগত লোক খুজতে থাকে। ৭৪৬ এর দিকে আবু মুসলিম খোরাসানে হাশিমিয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কালো পতাকার (Black Flag) অধীনে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু করেন। তিনি শীঘ্রই খোরাসানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, এর উমাইয়া গভর্নর নাসর ইবনে সায়ারকে বহিষ্কার করেন এবং পশ্চিমদিকে একটি সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে কুফা হাশিমিয়াদের হস্তগত হয়। এটি ইরাকে উমাইয়াদের শেষ শক্ত ঘাঁটি ছিল। ওয়াসিতে অবরোধ করা হয় এবং সে বছরের নভেম্বরে আবুল আব্বাস (Abu al-Abbas) কুফার মসজিদে খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এর ফলে মারওয়ান তার সেনাদেরকে হারান থেকে ইরাকের দিকে পরিচালিত করেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি দুই বাহিনী জাবের যুদ্ধে (Battle of the Zab) মুখোমুখি হয় এবং উমাইয়ারা পরাজিত হয়। এপ্রিলে দামেস্ক আব্বাসীয়দের হাতে এসে পড়ে এবং আগস্টে মারওয়ানকে মিশরে হত্যা করা হয়।


আব্বাসীয়রা উমাইয়া পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলে আশিজন ক্ষমা গ্রহণ করতে আসে এবং সবাইকে হত্যা করা হয়। হিশামের একজন নাতি প্রথম আবদুল রহমান (Abd al-Rahman I) বেঁচে যান এবং আল-আন্দালুস রাজ্য স্থাপন করেন এবং কর্ডোবা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত সিরিয়া ছিল উমাইয়াদের খলিফার কেন্দ্রবিন্দু। তবে উমাইয়ারা কর্ডোবাতে (আল আন্দালুস, বর্তমান পর্তুগাল ও স্পেন) আমিরাত হিসেবে ও পরবর্তীকালে খিলাফত হিসেবে ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। ইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসন পরবর্তী ৫০০ বছর বিভিন্ন রূপে টিকে ছিল যেমন, তাইফা, বার্বার রাজ্য ও গ্রানাডা রাজ্য। পরবর্তী বছরগুলোতে এবং বিশেষত ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে ইবেরিয়ার তাইফা পদ্ধতির আওতায় গ্রানাডা আমিরাত স্বাধীনতা বজায় রাখে। উত্তরের খ্রিষ্টান রাজ্যগুলোকে কর প্রদানের মাধ্যমে তারা টিকে ছিল। ১০৩১ থেকে তারা দক্ষিণে বিস্তৃত হতে শুরু করে। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি কর্ডোবার নাসরি রাজ্যের পতনের মাধ্যমে ইবেরিয়ায় মুসলিম শাসনের সমাপ্তি হয়। গ্রানাডার শেষ মুসলিম শাসক দ্বাদশ মুহাম্মদ যিনি বোয়াবদিল নামে পরিচিত, আরাগনের রাজা দ্বিতীয় ফার্ডিনেন্ড ও কাস্টিলের রাণী প্রথম ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

প্রেভিট-অরটনের মতে উমাইয়াদের পতনের কারণ ছিল ইসলামের দ্রুত প্রসার। উমাইয়া শাসনামলে ব্যাপক মাত্রায় ধর্মান্তরের কারণে পারসিয়ান, বার্বার, কপ্ট ও আরামায়িকরা ইসলাম গ্রহণ করে। এই অনারবরা যারা মাওয়ালি বলে অবিহিত হত, প্রায় সময় তাদের আরব শাসকদের চেয়ে অধিক শিক্ষিত ও মার্জিত হত। নতুন ধর্মান্তরিতদের প্রতি সব মুসলিমের জন্য সমতার নীতির কারণে রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যায়। প্রেভিট-অরটনের এও বলেন যে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যকার জাতিবিদ্বেষের কারণে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। উমাইয়া শাসনের সময় আরবি প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়। রাষ্ট্রীয় দলিল ও মুদ্রা আরবিতে জারি করা হত। ব্যাপক মাত্রায় ধর্মান্তরকরণ সমাজে বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যার জন্ম দেয়। উমাইয়ারা জেরুজালেমের ডোম অব দ্য রক ও দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ নির্মাণ করে।

পরবর্তী ইসলামি ইতিহাসবিদদের কাছে উমাইয়ারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। তারা উমাইয়াদের প্রকৃত খিলাফতের পরিবর্তে রাজতন্ত্র চালুর জন্য দোষারোপ করেন। তবে আধুনিক আরব জাতীয়তাবাদীরা উমাইয়া শাসনের সময়কে আরবদের স্বর্ণযুগ বলে থাকে। এটি বিশেষত সিরিয়ান জাতীয়তাবাদী ও বর্তমানের সিরিয়া রাষ্ট্রের সাথে মেলে যাদের কেন্দ্র উমাইয়াদের মতই দামেস্ক। প্যান আরব রং হিসেবে যে চারটি রং বিভিন্ন আরব দেশের জাতীয় পতাকায় অঙ্কিত আছে তাকেও উমাইয়াদের প্রতিনিধিত্বশীল ধরা হয়। তাহলে আমরা পেলাম যে উমাইয়া বংশ দুটো স্তরে খিলাফত চালায়। প্রথম পর্যায়ে ৬৬১-৭৫০ পর্যন্ত। এসময় তাদের রাজধানী ছিল ৭৪৪ সাল পর্যন্ত দামেস্ক, তারপর হারান। দ্বিতীয় পর্যায়ে শাসন করে ৭৫৬ থেকে ১০৩১ সাল পর্যন্ত। এসময় তাদের রাজধানী ছিল কর্দোবা। এভাবে শেষ হয় মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ এক সাম্রাজ্যের। দ্বিতীয় মারওয়ান ছিল শেষ খলীফা। এখানেও আমরা দেখলাম এই দীর্ঘ শাসনে ইসলামের নামে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এদের মূল লক্ষ। এবং সেটা করতে গিয়ে তারা নিজেরা নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছে সংঘাতে।

লেখক-
শেখ মিজান 02.11.2016
তথ্যসূত্র: বিশ্ব ইতিহাস কোষ, গুডল, ইউকিপিডিয়া, এফবি: আব্দুস সামী.. অন্যান্য ।