মরুর ধুলোয় মুছে ছিলো মুক্তির গান

সবাক
Published : 8 Oct 2011, 04:35 AM
Updated : 8 Oct 2011, 04:35 AM

এ দেশে একদিন পরিবর্তন হবে। শ্রেণী বৈষম্য থাকবে না, একজনও অশিক্ষিত মানুষ থাকবে না, দখলদার থাকবে না, সন্ত্রাস-দুর্নীতি থাকবে না, নির্বিঘ্নে প্রেম করা যাবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে না! – আরে ভাই কী শুনালেন, একেবারে জিভে জল এসে গেলো যে! আপনিতো স্বর্গের লোভ দেখিয়ে বসলেন। আমারতো এখন কী করি কী করি অবস্থা হয়ে গেলো! সে যাকগে…। আপনার কাছে স্বর্গ থাকলে সেটা দেয়ার লোভ দেখাতেই পারেন। কিন্তু এর আগে অন্তত সম্মানের নিরাপত্তাটা দেন। অন্তত প্রাণখুলে দুইটা কথা বলার সুযোগটা দেন। ধৈর্য্য ধরে না হয় একটু কমই খেলাম, কমই টয়লেটে গেলাম। দেখি স্বর্গ কতদূর!

মায়ের কাছ থেকে শুনেছি আমার নানা নাকি মারফতি ছিলেন। প্রায় প্রতিটি দিনই শরিয়তি মারফতি পালা গানের আসর জমাতেন। এসব আমিতো দেখতে পারিনি, আমার মায়েরও নাকি হালকা ঝাপসা মনে আছে। তবে ঠিকই বুঝতে পারি আসলে কি ধরনের পাল্লা জমতো ওসব আসরে। এ বাংলাদেশের যতো পেছনে গেছি ততোই বাউল গান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবি গান, মেলা, ঋতুভিত্তিক উৎসবের গল্প শুনতে পাই। শুনতে পাই বিচিত্র সব সংগীতযন্ত্রের কথা। কিন্তু আমি বড় হয়েছি এসবের বিরুদ্ধে শুনে শুনে। আমার বাবার অনাগ্রহ দেখতাম শরিয়তি মারফতির উপর এবং বিশেষ করে মেলার উপর। আবার পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে চৈত্রের শেষদিন উনার মুদি দোকানকে পরিষ্কার করতে দেখেছি। আমি নিজে বাটখারা, পাল্লা, তেল মাপার পাত্রগুলো নিয়ে যেতাম বাড়িতে। সাথে ব্যবহার্য ন্যাকড়া নিতেও ভুলতাম না। আবার এসব নিজহাতে ধুয়ে শুকাতেও দিতাম। আর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাবা দোকানের হিসেব রাখতেন বাঙলা সন অনুসারে। ঘরে রুনা লায়লার উর্দু গান, সাবিনা ইয়াসমিনের হিন্দি গান। হায়রে দমাদম মাস্ত কালান্দার!

বাবাকে দেখে কিছু বুঝতে পারতাম না। এখনো ঠিক ধরতে পারিনি এ আধাবাঙালির ভেতরে থাকা সাংস্কৃতিক মানুষটিকে। ছোটবেলা থেকে কয়েকটি শব্দের সাথে বেশ পরিচিত ছিলাম বাবার মাধ্যমে। সৌদি আরব, রিয়াদ, জেদ্দা, মক্কা, মদীনা, কুয়েত। এর মধ্যে কেবলমাত্র মদীনা শহরের নাম অন্য একটা মাধ্যমেও শুনেছি। দুরুদ ঝিকিরের মাধ্যমে। বড়মামা এবং সেজোমামা সৌদি আরব থাকতেন। শুনতাম জমজমের কথা, খোর্মা খেজুর আর জয়তুনের তেলের (অলিভ অয়েল) কথা। দেখতাম মহাপবিত্র লাল গুটির হাজী রুমাল। আরো দেখতাম হাজী রুমালে পা লাগার অপরাধে বাবার চোখ রাঙানি। খেতাম বিসমিল্লাহ পড়ে ২ চামচ জমজমের পানি। এ পানির আবার প্রজনন ক্ষমতা ব্যাপক। পক্রিয়াটা বেশ আধ্যাত্মিক। বড় এক ড্রাম দেশীয় পানিতে মাত্র একগ্লাস জমজমের পানি মেশালেই পুরো ড্রামের সাধারণ পানি জমজমের সম্মান পেতো। তবে বিমানে উড়িয়ে আনা ওই মরুর পানি যে অরজিনাল জমজমের, তারও কোন গ্যারান্টি নেই। জমজম কূপের অনেক দূরে ছোট প্লাস্টিকের কন্টেনারে এসব পানি বিক্রি হয়। হয়তো সেখানেও হাজার লিটার সাধারণ পানির সাথে এক গ্লাস জমজমের পানি মিশিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিলো। এভাবে অষুদের আদলে খেতে হতো খোর্মা খেজুর এবং জয়তুনের তেল। এসব আচার আমার অনেক নিকটাত্মীয় ছিলো। অপরিচিত আচার বলে অনীহাও ছিলো না, বরং বেশ ভালোই লাগতো।

আমাদের পুরো গ্রামের প্রায় শতভাগ প্রবাসীর বাস ছিলো মধ্যপ্রাচ্যে। তাও আবার সৌদি আরবে। পুরো বিষয়টা এখন পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাচ্ছি গ্রামের সম্মানিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উনারাই ছিলেন। দেখেছি কিভাবে ৫/৬ বছর বয়সী মেয়ে শিশুদের গায়েও সৌদী, ইরানী, পাকিস্তানি স্টাইলের বোরকা জড়াতো। দেখেছি তরুনীদের মাঝে বোরকার স্টাইল নিয়ে আলোচনা হতে, কার কোন স্টাইল পছন্দ এসব নিয়ে জমজমাট খোশগল্প চলতে। হাজার হাজার মাইল দূরের একটা দেশের নাম প্রতিদিন কয়েক হাজার বার উচ্চারিত হতো এসব গ্রামে। কিসের টানে, কিসের প্রেমে এতো সম্মান পায় একটা দূরদেশ! ধর্মের জন্য? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়েছে ক্ষুধার জন্য, পেটের জন্য। পরিবারের একমাত্র অথবা শীর্ষ উপার্যনকারী যে দেশে থাকে সেদেশের নাম আলোচনায় থাকবে না, এটাতো যুক্তিযুক্ত কথা নয়।

এতোক্ষণ আমি আমার শৈশবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছি। আমি কিন্তু কেবল আমি নই। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীর স্বজনের প্রতিনিধি। এবার দেখি কবে থেকে এ দেশের মানুষ মধ্যপ্রাচ্য যাওয়া শুরু করেছে। এ যাওয়াটা কবে থেকে মিছিলের মতো শুরু হয়েছিলো?

মোটামুটি খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম পাকিস্তান আমলে এদেশের মানুষের বিদেশ ছিলো কলকাতা, লাহোর, করাচি, কলম্বো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এক লাফে বাঙালির বিদেশ হয়ে গেলো সৌদী আরব! এর কারণ কী? এর ফাঁকে বলে রাখি মধ্যপ্রাচ্যের একক রাজত্বে ইতোমধ্যে বেশ শক্ত ভাগ বসিয়েছে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। আরো একটা দেশের নাম বাদ পড়েছে, যেখানে প্রচুর বাঙালি কাজ করে। ওরা মধ্যপ্রাচ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঙালি ধারণ করেছিলো। এখনও বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো সহ অনেক বাঙালিকে ধারণ করে আছে মালেয়শিয়া।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম যখন বেতার ঘোষনা আসে, তখন উচ্চারিত হয়েছিলো একটি লাইন – "আজ থেকে বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র!" পরবর্তীতে এ লাইনটির উপর পূর্ণ বিশ্বাস, আস্থা এবং এর সুরক্ষার অঙ্গীকার করেই জিয়াউর রহমান মসনদে বসেছেন। এ মুচলেকা উনাকে দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কাছে, দিতে হয়েছে এর সাথে জড়িত বিদেশী মিত্রদের কাছে এবং অবশ্যই পাকিস্তানের কাছে। ঠিক এ পর্যন্ত এসে দেশের একমাত্র বড় ক্ষতি বলতে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বিষয়টিই ছিলো। জিয়ার এ ধরনের নাকে খত অথবা দাস্তখতের স্থায়িত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত শিকড় গজাতে পারেনি। এদেশ থেকে তখনো পঁচা লাশের গন্ধ দূর হয়নি, মোছেনি বারুদের ধোঁয়া, হারায়নি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া পর্যন্ত যে ক'জন শাসক আসলো আর গেলো, তাদের কেউই জিয়ার মতো দূরদর্শী ছিলো না। তাদের কারোর প্রতিই চক্রান্তকারীদের পূর্ন সমর্থন ছিলো না। জিয়ার সময়ে এসেই দেশী বিদেশী চক্রান্তকারীদের সবাই জিয়ার যত্ন নিতে শুরু করে। কারণ জিয়াকে দিয়েই বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থের ইসলামী প্রজাতন্ত্র করা সম্ভব।

জিয়া ঝুঁকে পড়লেন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। প্রথমেই সৌদির সাথে গড়লের বুক লাগানো সম্পর্ক। এ সম্পর্ক মরুর বালু পর্যন্ত খুঁড়েছে। আরাফাহ ময়দানে জিয়াউর রহমান লাগালেন প্রচুর নিমগাছ। সৌদি বাদশাহ জিয়াউর রহমানকে দিলেন স্বর্ণ দিয়ে লেখা "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম"। সর্বশেষ এটা দেখেছিলাম বায়তুল মোকাররম মসজিদে। বাংলাদেশের মানুষ জাপান যেতে পারে না, কোরিয়া যেতে পারে না, সবাই খালি সৌদি আরব যায়। না যেতে চাইলেও নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী লাইনের মতো মিছিল লেগেছে মরুর পথে। এদেশের মানুষ টাকার চেয়েও বেশি চিনলো সৌদি রিয়ালের চেহারা। সচ্ছল হতে দরিদ্র পরিবারগুলো। আর আড়ালে আবডালে খুনীদের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শরীরও বেড়ে চলতেছে। বানের জলের মতো এ দেশে ঢুকেছে খোর্মা খেজুর, জমজমের পানি আর জয়তুনের তেল। রূপকথার গল্পের মতো ছড়াতে শুরু করলো আরবের কাহিনী। মক্কায় ক'টা মিনার আছে, মদীনায় ক'টা মিনার আছে, জেদ্দা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট, সৌদি বাদশাহ পরিবারের সদস্যের নাম, মালামাল এর আরবি শব্দ ছাম্মান, পলিব্যাগের আরবি কিস- এসব কিছু এদেশে আসতে শুরু করলো বানের জলের মতো।

সৌদি থেকে এতো আচার, এতো পণ্য এ দেশে আসতো। কিন্তু ইসলাম কি আসতো? না, ইসলাম আসতো না। আসতো ইসলামের প্রতি আকাশসম সম্মান, ভালোবাসা আর আনুগত্য। আরবের ইসলাম আরবেই থাকতো। ইসলামের প্রতি আরবদের সম্মান, ভালোবাসার ঘাটতি পূরণে কাজ করতো আরব প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ওরা ব্রিফকেসে করে আরব থেকে মরু গল্পের নকশা নিয়ে আসতো আর ওদের পরিবার এ নকশাকে লালন পালন করতো। জিয়াউর রহমানকে যতোটা না খালকাটা কর্মসূচী আর হিরোমার্কা গেটআপে টিকিয়ে রেখেছে, তারচেয়ে বেশি টিকিয়ে রেখেছে আরাফাহ ময়দানের নিম গাছ, খোর্মা খেজুর, জয়তুনের তেল আর জমজমের পানি। এর সাথে রাসুলের দেশ নিজ চোখে দেখার সুযোগের মতো কৃতজ্ঞতাতো আছেই। সে এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা। বেহেশততো আসলে সৌদির কাছাকাছি। সৌদি যখন এসেই পড়লাম, বেহেশত আর বেশি দূর না! আরবের মরু এসে চোখ থেকে ধুয়ে দিতে লাগলো বায়ান্ন, একাত্তর, মুছে দিতে লাগলো মুক্তির গান। আমরা আবার মুসলমান হতে শুরু করলাম।

ছোটবেলায় দেখেছি বাড়ির অন্য পরিবারের মানুষগুলো আমাদেরকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতো। কারণ আমাদের গায়ে সৌদি থেকে আনা কাপড়ে সেলাই করা জামা, ঘরে সৌদি থেকে আনা ফেয়ার এন্ড লাভলী। আরো আছে ব্যাথানাশক অষুধ। জমজমের পানি আর জয়তুনের তেলতো আছেই। আমাদের পরিবারের কেউ সৌদি আরব ছিলো না। মামারাতো আর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবুও আমাদের প্রতাপের শেষ ছিলো না। স্কুলে, বাজারে সৌদির গল্প করতে করতে মুখে ফেনা ধরে যেতো।

জিয়ার পর খুব যত্নের সাথে এ ধারা বজায় রেখেছিলেন এরশাদ এবং এরপর খালেদা জিয়াতো অবশ্যই। অথচ দেশ গঠনের তাগিদে এদেশের মানুষকে পাঠানো প্রয়োজন ছিলো পরিশ্রমী দেশগুলোতে। কিন্তু খুব সুকৌশলে এসব দেশকে এড়িয়ে গেছে এদেশের ইসলামী(?) শাসকেরা। অলস বিলাসী অহংকারী আরবদের দেশে গিয়ে এদেশের গ্রামের মানুষ শিখেছে কিভাবে ধনীদের সামনে মিসকিন হতে হয়, আর কিভাবে গরীবের সামনে আরবের শেখ হতে হয়। দেখেনি সভ্যতা, শিখেনি শৃঙ্খলা; বুঝেনি মানবতার শক্তি। কোরিয়াতে এদেশের বিশাল শ্রমবাজারের হাতছানি। বারবার অনিয়মের কারণে কোরিয়াতে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি ভেস্তে যায়। ইউরোপের দেশগুলোতেও বিশাল চাহিদা। কিন্তু স্রেফ মৌলবাদ, দুর্নীতি আর অসভ্যতার কারণে এ দেশের মানুষ সম্মানের সাথে ওসব দেশে বেড়াতে পর্যন্ত যেতে পারে না। দেশের শাসকেরাও প্রাপ্য পূর্ণ প্রটৌকলে ইউরোপের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে পারে না। কেবল প্রতিবছর আরবে গিয়ে হজ্জটাই স্বতস্ফূর্তভাবে করতে পারে।

এখন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে। আরবের মাহাত্ম্য থেকে এদেশের মানুষ ধীরে ধীরে বেরুচ্ছে। এ প্রজন্ম থেকে মিনমিনে দেশাত্মবোধক গান কেন্দ্রিক দেশপ্রেম উঠে যাচ্ছে। চারপাশে তীক্ষ্ণচোখে দেখি গতি এবং সম্মানের দেশপ্রেম। দেখি পথে পথে বিছিয়ে রাখা শাসকগোষ্ঠীর মরণকাঁটা ডিঙিয়ে তরুনদের এগিয়ে চলা। ওদের দেশপ্রেম অনেক স্পষ্ট এবং গতিতে ভরপুর। আমি নিশ্চিত যে, আশায় গদগদ হয়ে কোন প্রলাপ বকছি না। আমি নিশ্চিত, শাসকগোষ্ঠীর হাতে নয়, এ দেশ আবার বাঙালির বাংলাদেশ হবে তরুণদের হাত দিয়ে।

বর্তমান সরকার নাকি প্রচলিত জনপ্রিয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মাঝে সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল। তাই এদের কাছে কিছু প্রত্যাশাও আছে। প্রধানমন্ত্রী পারেন না একজন যোগাযোগমন্ত্রীকে ব্যর্থতার শাস্তি দিতে, পারেন না একজন নৌ পরিবহনমন্ত্রীকে যোগ্যতাহীনতার অপরাধে বরখাস্ত করতে, জাতীয় চোর বাটপারকে সততার লাইসেন্স দেয়া অর্থমন্ত্রীকেও শোকজ করতে পারেন না। পারেন না বাউলদের চুল দাঁড়ি কাটনেওয়ালা আওয়ামী মোল্লাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে। কিন্তু অন্তত শেষ কাজটি উনি করতে পারতেন। গত বইমেলার উদ্বোধনে বলেছেন "শাহাবাগ এলাকায় সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলবেন।" এটা উনি পারবেন না। কারণ তাহলে সবার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রলীগমুক্ত করতে হবে। শাহাবাগ থানায় সংস্কৃতিমনা প্রশাসনিক লোকজন রাখতে হবে। এরচেয়ে সহজ কাজও উনি পারেন না। উনার নাকি সীমাবদ্ধতা আছে!

কিন্তু জিয়া, এরশাদ এবং খালেদার হাত ধরে এ দেশে যে ইসলামাইজেশন হয়েছে এবং এ সুযোগে জামায়াত ইসলামের নেতৃত্বে দেশে যে পরিমান মৌলবাদের চর্চা হয়েছে, তার দুষ্টুচক্র থেকে দেশের মানুষকে বের করার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিকল্প নেই। ধরে ধরে বিএনপি জামাতের নেতার ঠ্যাং ভাঙলেই এদেশ থেকে মৌলবাদ যাবে না। এসব কলেরার সাথে শেখ হাসিনার ছাত্রলীগসহ সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারতো আছেই। কোথাও নির্ভয়ে নি:শ্বাসের যায়গা নেই। শেখ হাসিনা আদর দিয়ে কিংবা ধমক দিয়ে ছাত্রলীগকে ভালো করতে পারবে না। ছাত্রলীগ যদি শেখ হাসিনার অনিচ্ছার সম্পদ হয়ে থাকে, তাহলে এসব দায়িত্ব এ দেশের জনগনই নিতে পারবে। উনি কেবল দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অভয়ারণ্য করে দিলেই হয়। আন্তরিকভাবে ঢাকার শাহাবাগকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলুন। সময় করে পরপর দু'তিন মাসে দেশের আনাচে কানাছে কয়েকটি বাউল উৎসবে যান, ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি গ্রাম্য মেলায় যান। আবার শুরু হোক অবাণিজ্যিক পালাগানের আসর, গ্রামের মোড়ে মোড়ে বটবৃক্ষগুলো আবার জাগতে শুরু করুক, দেখবেন পুরো দেশটা শীতল ছায়ার বটবৃক্ষে ছেয়ে যাবে। আপনার উত্তপ্ত মগজে বৃষ্টি নামিয়ে ছাড়বে এসব ছায়া। আপনার ভাষায় আপনার মতো বিপদগ্রস্থ মানুষদেরকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দেবে একতারা, দোতরা। বাঁশির সুর বেয়ে আপনিও নেমে যেতে পারবেন আমাদের সামনে ঝুলিয়ে রাখা স্বর্গের মতো প্রশান্তিতে।

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা বিশ্বাস করতে হবে না। কেবল আপনাকে দিয়েই বিচারটা করুন। এখনো কি লোকগীতি শুনলে আচমকা শরীরটা হালকা হয়ে উঠে না? ঢোলের শব্দ শুনলে শরীরের জয়েন্টগুলো নড়েচড়ে উঠে না? পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা দেখে মৌলবাদীদের কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান না? বইমেলায় মানুষের ঢল দেখে চোখ দু'টো জ্বলজ্বল করে উঠে না? সবশেষে একেবারেই দেশীয় যন্ত্রে জাতীয় সংগীতের সুর শুনে শরীরের অর্ধমৃত কেশগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যায় না? এ প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটির জবাব যদি হ্যাঁ হয়, তবে বাঙালি সংস্কৃতিকেই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ বানানো সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী চিন্তা হতে পারে।