সকাল সকাল আমাদের গাড়ী ডাললেক, নাগিন লেক, হযরতবাল মসজিদ, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় অতিক্রম করে পাথুরে পাহাড়ী আকা বাকা পথ ধরে চলতে থাকলো সোনমার্গের দিকে। পথে ইউনিফর্ম পরা ছাত্র-ছাত্রীদের সমাগম বেশ চোখে পড়ার মত। বাচ্চামেয়েদের হিজাব দেখে বুঝা যায় কাশ্মীরি মুসলিম সমাজ কতটা রক্ষণশীল। শ্রীনগরের ফসলী মাঠ সবুজ শ্যামল হয়ে আছে শীতকালীন শব্জিতে। রাস্তার দু'পাশে চোখে পড়ল – কাঠ, পাথর ও রঙ্গিন টিনের সমন্বয়ে নির্মিত কাশ্মীরিদের দ্বিতল, তৃতল বাড়িগুলো বেশ সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন। মনে হচ্ছে শ্রীনগরের কোন অভিজাত আবাসিক এলাকা দিয়ে যাচ্ছি। সম্ভবত ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় সুউচ্চ ভবন চোখে পড়লো না।
সোনমার্গ, জন্মু এন্ড কাশ্মীর রাজ্যের গন্ডারবাল জেলার অন্তর্গত। শ্রীনগর থেকে ৮০ কিঃমিঃ উত্তর পূর্বে, দ্রাস, কারগিল, লাদাখের লে শহরের পথে যা সমুদ্র পৃষ্ঠের ১১,৬৪৯ ফিট উপরে। কাশ্মীরের এই অংশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বছরে প্রায় সাতমাস এই পথটি তুষারপাতে বন্ধ থাকায় লেহ লাদাখের বসবাসকারী নাগরিক এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর খাদ্য ও জ্বালানী সরবরাহে ব্যাহত হয়।
সোনমার্গ প্রাচীন সিল্ক রোডের একটি সংযোগ সড়ক। গিলগিটের সাথে চীন ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে কাশ্মীরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই রোড দিয়ে রেশম, মসলিন, সরু চাল, কর্পূর, চন্দন কাঠ, মসলা, কস্তুরী, হাতির দাত, কার্পেট, দামি পাথর, পশুর চামড়া, ইত্যাদি আফগানিস্তান, পারস্য, হয়ে পৌছত ইউরোপে।
ড্রাইভার নাজিরকে বললাম কাশ্মীরি গান চালাও.. ও দেখি মায়াবী এক সূরের গজল ছাড়ল। রোশ ওয়ালা ম্যইনে দিলবারু …..পোষন বাহার আ …ইউরওয়ালু। চুপচাপ শুধু গান শুনছি আর বাইরের দিকে তাকিয়ে আপন মনে নিপুন শিল্পীর আকা ছবির মত দৃশ্য দেখছি। দেখতে দেখতে কখন যে দু'ঘন্টা পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না।
ড্রাইভার নাজির গানের ভলিউম কমিয়ে দেখাচ্ছে ঐ সামনে থাজিয়াস হিমবাহ, ওখানে যেতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে। হিমবাহ যত কাছে আসছে মনের মধ্যে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। অবশেষে সোনমার্গ পার্কিং পয়েন্টে পৌছলাম। পয়েন্টে নেমেই মনের আনন্দে চার পাশের সু-উচ্চ পর্বতমালা দেখছি। আর মনে মনে ভাবছি সৃষ্টিকর্তার ভূ-স্বর্গ এমন হলে স্বর্গই না কেমন।
গত বছর মানালী ট্রিপে, সফর সঙ্গী সাইদের, আসামের ফারুকের সঙ্গে পরিচয় হয়। চাকুরী করে সোনমার্গ ট্যানেলের ঠিকাদারী কোম্পানীতে। সোনমার্গে এসে ফোন দিলাম, কপাল মন্দ বেচারা ছুটিতে। তার কলিগের নাম্বার দিল যোগাযোগ করতে। পরে এসে শাকিল ভাই আমাদেরকে নিয়ে গেল। সোনমার্গ গাড়ি পার্কিং পয়েন্টেই যেখানে ট্যানেল নির্মিত হচ্ছে পাহাড়ের গা ঘেষে অফিসার্স মেস।
ট্যানেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর রেকর্ড বুকে নাম এন্টি করে আমাদের নিয়ে গেল তার কোয়াটারে। প্রচন্ড ঠান্ডা, তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রীতে। রুম হিটার জ্বালিয়েও কাজ হচ্ছে না। আতিথিয়তা পেয়ে মুগ্ধ, পরে অবশ্য জানতে পারলাম শাকিল ভাইয়ের বাড়ি শ্রীনগরে। তার ছোট বোন বাংলাদেশের রাজশাহী মেডিকেলে পড়ে। এজন্য একটু বেশি আদর যত্ন করলো। খুব ভালো লাগলো খবরটি শুনে আমরা চিকিৎসার জন্য ভারত যাই আর কাশ্মীর থেকে চিকিৎসক হতে আসে আমাদের দেশে।
সোনমার্গ পার্কিং পয়েন্টে মনে হল ঘোড়ার হাট বসেছে, আপনাকে ঘোড়ার লোক এসে ঘিরে ধরবে। আমাদের অবশ্য শাকিল ভাই-ই সব ব্যবস্থা করে দিল। ইচ্ছা করলে পায়ে হেঁটেও যেতে পারেন। তবে যেহেতু আমরা সমতলের লোক তাই ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ উপভোগ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলাম না। ঘোড়ায় চড়ার আগে দরদাম অবশ্যই করে নিবেন।
ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছি থাজিয়াস গ্লাসিয়ার বা থাজিয়াস হিমবাহ, সারা বছরই কমবেশি বরফাচ্ছাদিত থাকে তবে শীতে চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ এবং জোজিলা পাস এটি পৃথিবীর উচ্চতর, ভৌগলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ভয়ঙ্কর পাহাড়ী রাস্তাগুলোর একটি। স্লেজে চড়ে, বরফে স্কিং করে আপনি ফিরে যাবেন আপনার শৈশব। পুরো সোনমার্গ মনে হচ্ছে সাদা চাদর জড়িয়েছে গায়ে। প্রকৃতি মনমুগ্ধকর, আবহাওয়াও স্বাস্থ্যকর হওয়ায় দেশী বিদেশী পর্যটক ছুটে আসেন এই সোনমার্গে। তাইতো জহরলাল নেহেরুরও খুব পছন্দের জায়গা ছিল সোনমার্গ। এছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র স্থান অমরনাথ গুহা সোনমার্গ/রাঙ্গা/বালতাল/গিরিমার্গ হয়ে যাওয়া যায়। তবে আপনাকে শীতের সাথে যুদ্ধ করার সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে।
দিনে দিনে ফেরত আসলে দেখা হবে উপভোগ করা হবে না। তাই বলছি সময় থাকলে এক দুদিন থাকলে আরো দেখতে পাবেন। সারি সারি পাইন বৃক্ষ, বরফ গলা প্রবাহিত ঝর্ণা, গঙ্গাবল লেক, কৃষ্ণসার লেক, বাল্টাল ভ্যালি। আরো আছে বিখ্যাত সিন্ধু নদী, নিগদ নদী, এটি লালচে রঙ্গের জন্য জনপ্রিয়, নদীটি বাল্টিক কলোনীতে সিন্ধু নদীর সঙ্গে এসে মিলিত হয়েছে। স্থানীয় বাল্টিক উপজাতিদের বিশ্বাস এই নদীর লাল রঙ্গের পানি রোগাক্রান্ত মানুষের ঔষধ হিসেবে কাজ করে। তাই প্রতি রবিবার এখানের লোকজন জড়ো হয় স্নান করার জন্য।
শ্রীনগর ফেরার পথে মন খারাপ লাগছিল। মন যেতে নাহি চায়, তবু যেতে হয়। জীবন সময়ের ফ্রেমে বাধা। নাজিরের কাছ থেকে শিখে কাশ্মীরি ভাষায় সোনমার্গকে বিদায় জানালাম – খোদায়েস পৈঠ হাওলা।