এশিয়ার সুইজারল্যান্ড পেহেলগাম এবং কাশ্মীরের একটি গ্রাম ’বাংলাদেশ’

সোলাইমান ইসলাম নিলয়
Published : 2 Nov 2017, 05:20 AM
Updated : 2 Nov 2017, 05:20 AM

গ্রীষ্মকালে উত্তর প্রেদেশ তথা দিল্লী যখন গরমের লু-হাওয়ায় তপ্ত হত, তখন মুঘল সম্রাট প্রিয় মানুষদের নিয়ে অবকাশ যাপনে আসত কাশ্মীরে। ইরান ও সমরখন্দ থেকে বাগানকর্মী এনে তৈরী করেন প্রমোদ বাগান (মুঘল গার্ডেন)। কাশ্মীরের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে নাম দেয় ভূ-স্বর্গ। এই কাশ্মীরেই মৃত্যুবরণ করার শেষ ইচ্ছাও পোষন করে ছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। তাইতো ফার্সী ভাষায় লিখেছিলেন –

'আগার ফেরদৌস বে-রোহী যামীন আস্ত্। হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্। অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি কোন স্বর্গ থেকে থাকে – তা এখানে, এখানে, এখানে।
শুধু কি মুঘল সম্রাট! বাঙালির সাহিত্য সম্রাট কবিগুরু রবি ঠাকুরও ঝিলাম তীরের শ্রীনগরের বসে বলাকা কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন।

আজকের যাত্রা শ্রীনগরে থেকে পেহেলগামের উদ্দ্যেশে। এমনিতেই ঠাণ্ডা তার উপর আবার মেঘলা আকাশ। মন খারাপ দেখে ড্রাইভার বলল – আমাদের মুল্লুকে মৌসুম নিয়ে একটি প্রবাদ আছে – কাশ্মীরের মৌসুম, বোম্বের ফ্যাশন, আর বিবির মুড এই তিনটার উপর ভরসা নেই। যে কোন সময় চেঞ্জ হতে পারে। বলতে না বলতেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল।

কাশ্মীরি ভাষায় নাগ মানে ঝরণা, অনন্ত মানে অসংখ্যা, অর্থাৎ অনন্তনাগ মানে অসংখ্য ঝর্ণা। কাশ্মীরের পেহেলগাম অনন্তনাগ জেলার অন্তর্গত। স্থানীয়রা একে ইসলামাবাদ নামে ডাকে। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০০ সালে এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। পরে মহারাজা গোলাব সিং ১৮৫০ সালের দিকে আবার এর নাম রাখেন অনন্তনাগ। শ্রীনগর – জম্মু হাইওয়ে ধরে প্রথমে অনন্তনাগ হয়ে পেহেলগাম। দূরত্ব শ্রীনগর থেকে ৯৬ কিঃ মিঃ। এশিয়ার সুইজারল্যান্ড খ্যাত কাশ্মীরের পেহেলগাম পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। প্রাইভেট জিপে যেতে সময় লাগে কম বেশি সাড়ে তিন ঘন্টার মত। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবকিছু বরফে ঢাকা পড়ে বিধায় পর্যটক আগমন হ্রাস পায়। পেহেলগাম ভ্রমনের উপযুক্ত সময় মার্চ – নভেম্বর।

কাশ্মীরের অর্থকারী ফসলের মধ্যে আপেল ও জাফরান অন্যতম। অনন্তনাগ জেলায় সবচেয়ে বেশি আপেলের বাগান। পেহেলগাম যেতে রাস্তার দু'ধারে এসব বাগান চোখে পড়বে। প্রচুর পরিমানে জাফরানও চাষ হয় এই অঞ্চলে। খাবারের রং, ঘ্রান ও স্বাদ বাড়িয়ে তুলতে জাফরানের জুড়ি মেলা ভার। পাকস্থলীরও নানাবিধ রোগের উপশম করে। হাইওয়ে সংলগ্ন ড্রাইফুড এর দোকান থেকে জাফরান, কাজুবাদাম, আখরোট, কিসমিস ও নানান ধরনের মসলা কিনতে পারবেন। চায়ের মত বিশেষ পানীয় কাওয়া বা কাহওয়া এবং কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী খাবার ওয়াজওয়ান খেতে ভুলবেন না। পেহেলগাম যেতে আপনার সফর সঙ্গী হবে লিডার নদী। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি আপনার চোখ ও মন দুটোকেই ভরিয়ে দিবে।

কাশ্মীরিরা শীতে এক ধরনের মোটা কাপড় (জু্ব্বা) পরে থাকে। কাশ্মীরি নারী পুরুষ দেখতে অনেকটা লালচে গোলাপী কালারের। অতিরিক্তি শীতে অনেককে আবার বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক মনে হয়। নৃ-তত্ববিদদের মতে হযরত নূহ (আঃ) এর তিন ছেলে ছিল যারা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়াতে বসতি স্থাপন করে। তাদের একজনের নাম হাম। হামের ছেলের নাম ছিল কাশ। এই কাশ থেকে বিশাল একটি গোত্র বিস্তার লাভ করে। ইহুদিদের ১২টি গোত্র ছিল যারা সর্বদা সংঘাতে লিপ্ত থাকত। এই হানাহানির ফলে যাযাবর গোত্রগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া কোন গোত্র হিমালয়ের কাছে চলে আসে। কাশ্মীরিদের চেহারা, বর্ণ, আচরণ ও মুখের দাড়ি অনেকটা ইহুদিদের সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ। তাই অনেকের ধারনা কাশ্মীরিরা ইহুদিদের হারিয়ে যাওয়া কোন গোত্রের অংশ। এই কাশ থেকে এই অঞ্চলের নামকরণ হতে পারে কাশ্মীর।

বরফে মোড়ানো পর্বতশৃঙ্গগুলো এবং পাইন গাছের সবুজ ভ্যালিগুলো খুবই মনোরম। পেহেলগাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, জলবায়ু, ক্যাম্পিং সহ বলিউডের মুভি দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য বিখ্যাত। তাইতো পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় গন্তব্য হল পেহেলগাম। এখানে দেখা যাবে – লিডার নদী, পেহেলগাম ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, আরু ভ্যালি, চন্দনওয়ারী, পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট, মিনি সুইজারল্যান্ড খ্যাত বাইসারান, ধাবিয়ান, কাশ্মীর ভ্যালী ভিউপয়েন্ট, কানিমার্গ, ওয়াটারফল, তুলিয়ান ভ্যালী, মামলেশ্বর মন্দির, কোলাহাই হিমবাহ ইত্যাদি। গোড়ায় চড়ে বা পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। গোড়ায় চড়লে একটু কষ্ট কম ও এডভেঞ্চার হয়।

আমরাও গোড়ায় চড়ে রওয়ানা হলাম একে তো ঠাণ্ডা আবার বৃষ্টির বরফ গলা পানি জমে পাহাড়ের মাটি ও পাথুরে রাস্তায় কাদা তৈরী হয়ে পাহাড়ে আরোহন অসম্ভব হয়ে পড়ল। প্রতি পদে ছিল বিপদ-ভয়, রোমাঞ্চকর এ্যাডভাঞ্চার যা সারা জীবন মনে রাখার মত একটি জার্নি। সৃষ্টিকর্তা গোড়া নামের এই পশুটিকে যে অসাধারণ ক্ষমতা প্রদান করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধন্যবাদ কাশ্মীরি বালক শাহ্ নেওয়াজকে অসাধারণ কৌশলে অবশেষে আমাদেরকে পৌছালেন চন্দওয়ারী, বাইসারান, কাশ্মীর ভ্যালি পয়েন্ট সহ বিভিন্ন পয়েন্টে। আর বার বার বলছে – আপ খুশ হো?। আমি উত্তরে বললাম, তুম বকশিস চাইয়্যে। বাইসরান পর্বতের চুড়াও দেখি চা- কফির ব্যবস্থা আছে। কফি পান করে একটু উষ্ণ হয়ে নিলাম সকলে।

ফেরার পথে বাংলাদেশ নিয়ে মজার একটা কাহিনী শুনেছি। গল্পটা এ রকম – কাশ্মীরের ২২ জেলার মধ্যে শ্রীনগরের থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উত্তরে একটি জেলার নাম বান্ডিপুরা। এই বান্ডিপুরা জেলার আনুসা তহশিলে একটি গ্রামের নাম বাংলাদেশ। সোপুর-বান্ডিপুরা মধ্য খান থেকে মাটির রাস্তায় পায়ে হেঁটে পাঁচ কিলোমিটার। সাধারণত বাইরের কোন লোক ঐ এলাকায় যায় না। বিখ্যাত উলার হৃদের তীরে ভাসমান এ গ্রামটি। মাছ ধরে ও পানি বাদাম সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ১৯৭১ সালে পাশ্ববর্তী জুরিমন গ্রামে ৫-৬টি ঘরে আগুন লেগে পুড়ে যায়। তারা পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী ফাঁকা জায়গায় ঘর তোলে। একই সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হয়। তাই তারাও তাদের নতুন গ্রামের নাম রাখেন বাংলাদেশ। সেই ৫-৬টি ঘর আজ ৫০টি ঘরে এবং ৩৫০ জন মানুষে বৃদ্ধি পেয়েছে। বান্ডিপুরা ডিসি অফিস এটিকে আলাদা গ্রামের মর্যাদা দেয় ২০১০ সালে।