বাংলা সাহিত্যে একটা প্রবাদ আছে – 'গরীবের ঘোড়ার রোগ' । আর আমার ঘোরার রোগ। কাশ্মীরতো আর এমন না – চাচা, ঢাকা কতদূর? ''দিল্লী হনুজ দূর অস্ত' দিল্লী বহুদূর। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উত্তরের রাজ্য এবং ভৌগলিকভাবে মধ্য হিমালয় পর্বতগুচ্ছের উপরে একটা সমতল উপত্যকার নাম কাশ্মীর।
ভূপৃষ্ঠ বিকাশের অনেক ইতিহাস রয়েছে – যেমন প্রস্তর যুগ, বরফ যুগ। শেষ বরফ যুগ সমাপ্ত হয়েছে আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে সেই সময় একটি আবদ্ধ পর্বত বেষ্টিত উপত্যকা বরফ গলা পানির দ্বারা জলাশয়ে পরিনত হয়। ইন্ডিয়ান ও রাশিয়ান প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এই উপত্যকা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। পরে জলাধারের আবদ্ধ পানি হাইড্রোলিক প্রেসার, ভূতত্ত্বের কোন বিবর্তন বা বড় কোন ভূমিকম্পের ফলে পশ্চিম দিক দিয়ে পানি সরে গিয়ে মানব বসবাস উপযোগী ভ্যালির সৃষ্টি হয়।
পশ্চিমের ভূ-মধ্যসাগর থেকে আসা শীতল বাতাস কাশ্মীরে কিছুটা বৃষ্টি আনে মার্চ-এপ্রিল মাসে। তাই কাশ্মীর জলবায়ুকে অনেকে বলেন ভূ-মধ্য সাগরীয় জলবায়ু। তবে কাশ্মীরের নিজস্ব একটা জলবায়ু আছে। তা হল হিমালয়ান। যার সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল আনপ্রেডিক্টেবল। এই মেঘ, এই বৃষ্টি আবার পরক্ষণে মিষ্টি রোদের হাসি মনে হবে চামড়া পোড়ানো তাপদাহ। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফিট উপরে সবুজ ভ্যালি, শান্ত হ্রদ এবং শীতল হিমবাহে এসে মনে হতে পারে আপনার ব্যস্ত সময়গুলো শান্ত হয়েছে।
খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে ঝিলাম নদীর তীরে গড়ে উঠা শ্রীনগর কাশ্মীরের গ্রীস্মকালীন রাজধানী। কবিগুরুও এসে ছিলেন ঝিলাম পারের শ্রীনগরে ১৯১৫ সালে। কাশ্মীরের রুপসী শ্রীনগর, শ্রীনগরের মাথার তাজ ডাল। চতুর্দিকের সুউচ্চ পর্বতমালা যেন এই রুপসীকে কুর্ণিস করছে। আর মুগলদের তরফ থেকে রুপসীর জন্য তোহফা – নিশাতবাগ, চশমাশাহী, শালিমারবাগ।
ডাললেকের দক্ষিণ পূর্বে পর্বতের চুড়ায় শঙ্করাচার্য মন্দির, পাদদেশে পরীমহল। পূর্বে হরিপর্বত, হরিপর্বতের উপরে রয়েছে মুগল ফোর্ট। মুসলমানরা একে বলে কোহ-এ-মারান। পাশাপাশি রয়েছে – মকদুম শাহ (রঃ) নামে এক বুজুর্গের মাজার। অসংখ্য মানুষ যায় সেখানে কল্যানের আশায় এবং পর্বতের পাদদেশে আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন। উত্তর পশ্চিমাংশে মুসলমানদের পবিত্র স্থান হযরতবাল মসজিদ ও কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়। অপূর্ব স্থাপত্যের জুমা মসজিদ। ঝিলাম নদীর উপর কয়েকটি সেতু দিয়ে শ্রীনগরের পুরাতন শহরের সঙ্গে উভয় পাশের সংযোগ হয়েছে।
লাকুতিডাল, বড়াডাল, গাগরিবাল এই তিনের সমন্বয়ে শ্রীনগরের ডাললেক। এর একটি অংশকে আবার নাগিন লেক নামেও ডাকা হয় যা ভাসমান উদ্যান দ্বারা পৃথক হয়েছে। ডালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ কিঃ মিঃ প্রস্থ ৩ কিঃ মিঃ উচ্চতা কমবেশি ৬ মিটার পর্যন্ত। ডাল লেকের পানির ব্যাপ্তি ২৬ কিঃ মিঃ পর্যন্ত বিস্তৃত।
ডাললেককে কেন্দ্র করেই শ্রীনগরের হোটেল, মোটেল ও হাউজ বোটসহ পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কাশ্মীর ভ্রমনের একটা ভিন্ন আনন্দ পেতে হলে অন্তত একটা রাত কাটাতে হবে শ্রীনগরের ডাললেকের হাউজ বোটে। অত্যন্ত দামী কাঠের তৈরী ও বৈচিত্রময় কারুকাজ করা থাকে বোট হাউজগুলো। কার্পেট মোড়ানো বসার ঘর, থাকার ঘর, বারান্দা, বাথরুম, ছাদে বাগান, সিলিং এ চোখ ঝলসানো ঝাড়বাতি। জানালায় পশমিনা কাপড়ের পর্দায় এক রাজকীয় পরিবেশ। রাতের হাউজবোট ডালের স্বচ্ছ পানিতে আলোর বিকিরণ, পাহাড়, আর যদি চাঁদনী রাত হয়, তো বহুদিন ধরে ধারন হয়ে থাকবে, এ সুখের স্মৃতি আপনার মনের মনি কোঠায়।।
তীরে আশার জন্য ব্যবহার করতে হয় ছোট এক ধরনের ডিঙ্গি নৌকা। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে "শিকারা"। চাইলে হাউজ বোট নিয়ে নৌবিহারেও বের হতে পারেন। শিকারা দিয়ে ঘুরতে পারবেন ডালের অলিগলি। শিকারায় ফুল, ফল, সব্জি, শাল, কার্পেট, পেপারমেশের তৈরী হস্তশিল্পের নানা পন্যের পসরা সাজিয়ে বসে ভাসমান বাজার। আছে ভাসমান পোষ্ট অফিস, দ্বীপ রেষ্টুরেন্ট, চারপাশে পানি মধ্যে চারটি চীনার বৃক্ষ তাই নাম তার চার চীনার।
কাশ্মীরি সূফি সৈয়দ আলী হায়দার (রহঃ) সমরখন্দ ও পারস্য হতে ১৪ শতকে প্রায় সাতশ বুনন শিল্পী এনে শাল, কার্পেট, ধাতুর নানা সম্ভারসহ হস্তশিল্প গড়ে তোলেন। গোটা ইউরোপ জুড়ে কাশ্মীরি পশমিনা শালের সুখ্যাতি ছিল এবং তা এখনও আছে। বাদশা জয়নুল আবেদীন দক্ষিন কাশ্মীরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড়ী ঝরনা থেকে নালা তৈরী করে কৃষির উন্নয়ন সাধন করেন।
কাশ্মীর উৎপাদনের চেয়ে আমদানী বেশি তাই একে বলা হয় কনজুমার ইকোনমি বা ভোক্তা অর্থনীতি। ভারত সরকারের মোট ভর্তুকির প্রায় ১০ ভাগেরও বেশি যায় এই জম্মু এন্ড কাশ্মীর রাজ্যে। যদিও কাশ্মীরিদের এ নিয়ে অভিযোগ কৃষি বা ফলের বাগানের উন্নয়নে কোন ভর্তুকি দেওয়া হয় না। যা দেওয়া হয় তা সৈন্যদের ভরণপোষন ও সমতল জম্মুর কলকারখানার উন্নয়নে।
কাশ্মীরের ইতিহাসেও বাংলাদেশের সংযোগ মিলেছে খানিকটা। মৃদু রায় তার বইয়ে উল্লেখ্য করেছেন – ডোগরা মহারাজার আমলে কাশ্মীরের মুসলিম খানকাহ্ ও মসজিদগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব মুসলমানদের হাতে ন্যস্ত করা হয় ১৮৮৫ সালে। সে সময় অর্থাভাবে সেগুলোর মেরামত করা যাচ্ছিলনা। সেই বছর হজরতবাল মসজিদ ও খাজা নকশাবন্দির মাজার (টম্ব) মেরামতের জন্য ঢাকার নবাব অর্থ দিয়েছিলেন।