রাত দশটায় ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের বিমানে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জয়পুর। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে খুব ভোরে পৌঁছে গেলাম আগ্রায়।
স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় দালালের ছড়াছড়ি এড়িয়ে আগ্রার অবস্থা দেখে দেখে মনে হলো এখনো মোগল আমলেই আছি। যে দিকেই তাকাই মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন। তাজমহলের পথে পা বাড়িয়ে মনে মনে আওড়াতে থাকি মোগল ইতিহাস।
সাংবাদিক ও লেখক সাহাদত হোসেন খানের 'মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়' বইয়ে শাহজাহান ও তাজমহলের বর্ণনা রয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র খুররমের (যিনি পরবর্তীতে শাহজাহান নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন) জন্ম হয়েছিল ১৫৯২ সালে। পিতামহ আকবর ও পিতা জাহাঙ্গীরের নয়নের মণি ছিলেন শাহজাদা খুররম। যুদ্ধবিদ্যায় ও লেখাপড়ায় পারদর্শী হলেও তার স্থাপত্যশিল্প, মণিরত্ন ও কারুশিল্পসহ আরো অনেক বিষয়ে আগ্রহ ছিল।
শাহজাদা খুররাম মিনা বাজারে আর্জুমান্দ বানু বেগমকে প্রথম দেখেন। প্রথম দেখাতেই তাকে ভালো লেগে যায়। এ চতুর্দশী বালিকার চুল ছিল রেশমের মত, চোখ ছিল টানা টানা, নাক ছিল তীক্ষ্ণ। খুররাম তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত পিতা জাহাঙ্গীরের কাছে জানান। আর্জুমান্দ বানু ছিলেন শাহজাহানের সৎ মামাতো বোন। সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নেছা ওরফে নুরজাহানের ভাই আসফ খানের মেয়ে।
পিতা জাহাঙ্গীর বিয়েতে সম্মতি দেন। কিন্তু শর্ত দেন যে, আর্জুমান্দ বানু বেগমকে বিয়ে করার জন্য খুররমকে অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ বছর। আর সামাজ্যের শক্তি সংহত করতে পারস্যের যুবরাজ্ঞীকে বিয়ে করতে হবে। রাজদরবারের জ্যোতিষীর গণনা অনুযায়ী ১৬১২ সালে তাদের বিয়ে হয়। আর্জুমান্দ বানুর নতুন নাম হয় মমতাজ মহল।
দু'জনের বন্ধন ছিল গভীর, শাহজাহান যেখানেই যেতেন, মমতাজও তার সঙ্গে থাকতেন। এমনকি যুদ্ধের জন্য মেবার, গুজরাট বা বুরহানপুরে থাকার সময় মমতাজও সঙ্গে ছিলেন। এই বুরহানপুরে থাকাকালীন ১৬৩১ সালে তাদের চতুর্দশ সন্তান প্রসবের সময় মমতাজের মৃত্যু হয়।
পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনকাল ছিল ১৬২৮-১৬৬৮ পর্যন্ত। এই সময়কাল ছিল মোগলদের স্বর্ণযুগ এবং ভারতীয় সভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অধ্যায়। বাবা সম্রাট জাহাঙ্গীর অসংখ্য বিজয়ের স্বীকৃতি স্বরুপ শাহজাদা খুররামকে শাহজাহান উপাধি দেন। শাহজাহান তার সময়কালে বহু ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করেন। লাহোরের শালিমার গার্ডেন ও শীষ মহল তারই কীর্তি। তার অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে আগ্রার মতি মসজিদ, দিল্লির লালকেল্লা, জামা মসজিদ, লাহোরের মসজিদ ও লাহোর দুর্গ অন্যতম। তবে কোনো স্থাপনাই তাজমহলের সৌন্দর্যকে অতিক্রম করতে পারেনি।
ইতিহাস মনে করতে করতেই আগ্রা স্টেশন থেকে অটোরিকশায় করে তাজমহল পৌঁছলাম। পাঁচশ রুপি দর্শনীর বিনিময়ে দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলাম পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য তাজমহলে।
মূলত মোগলদের নির্মিত বিভিন্ন বাগান ও সমাধি থেকে তাজমহল নির্মানের ধারণা নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে দিল্লিতে হুমায়ুন ও আব্দুর রহিম খান-ই-খানার মাজারের শীর্ষের গম্বুজাকৃতির কাঠামো তাজের মডেল হিসাবে কাজ করেছে। তাজমহলের চার কোনার চারটি স্তম্ভ নির্মানের ধারণা নেওয়া হয়েছে সিকান্দায় নির্মিত আকবরের সমাধি থেকে।
তাজমহলের চারকোনে চারটি মিনার ও ২২টি গম্বুজ রয়েছে। তাজমহলের অভ্যন্তরে দুটি সারিতে আটটি করে ১৬টি কক্ষ। এসব কক্ষ অষ্টভুজাকৃতির সমাধি দুটিকে বেষ্টন করে রেখেছে। পথের মাঝখানে রয়েছে পানির ফোয়ারা।
সময় নিয়ে দেখলে উপলব্ধি করতে পারবেন বৈচিত্রময় এক তাজকে। তাজের শ্বেত মর্মর পাথরে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ও সূর্যের কিরণ খেলা করে। তাই এর রূপ একেক সময় একেক রকম।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ব্রিটিশ শাসন- সব আমলেই তাজমহলের বিভিন্ন সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়। শুরুতে তাজমহলের দরজা ছিল রুপার, ছিল সোনার তৈরি রেলিং, রত্নখচিত ঝাড়বাতি ও মহামূল্যবান কার্পেট, মমতাজের করবের উপরে ছিল মনিমুক্তা খচিত গিলাফ। সবই গেছে ভিনদেশি শাসকদের হাতে।
এক জরিপে দেখা যায় ২.৭ শতাংশ মহামূল্যবান ধনরত্ন অবশিষ্ট আছে, বাকি ৯৭.৩ শতাংশ ধনরত্ন লুণ্ঠিত বা খোয়া যায়।
তাজমহল দেখে একেক জনের অনুভূতি একেক রকমের। কেউবা বলে দুটো সমাধির জন্য এত অপচয় অনর্থক। আবার অনেকের আছে বিপরীত মত।
তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে রবি ঠাকুর লিখেছেন, "এক বিন্দু নয়নের জল, কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল, এ তাজমহল।"
তাজমহল দেখে বের হয়ে আসলেও মনটা পড়ে থাকলো তাজমহলের ভিতরে। ফতেহপুর সিক্রি যাওয়ার পথে কবি নজরুলের কথাটি বারবার মনে পড়লো – "তাজমহলের পাথর দেখেছ/দেখেছ কী তার প্রাণ? অন্তরে তার মমতাজ নারী/ বাহিরেতে শাজাহান।"