শ্রীময়ী শ্রীখোলার স্রোতে

সোলাইমান ইসলাম নিলয়
Published : 8 Nov 2018, 11:53 AM
Updated : 8 Nov 2018, 11:53 AM

শ্রীখোলা গ্রাম, দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ছবি: সোলাইমান ইসলাম নিলয়

সান্দাকফু থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার হেঁটে এসে পৌঁছলাম সাবারগ্রাম। সাবারগ্রাম মূলত একটি ট্রেকার্স হাট। ক্ষুধার রাজ্যে ম্যাগি আর কফি দিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হল। সাবারগ্রাম থেকে ফালুটের দূরত্ব সাত কিলোমিটার। ডানে একটি রাস্তা তিন কিলোমিটার ডাউনহিলে চলে গেছে মোলেতে। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প এবং বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে সিন্দালিলা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে গড়ে উঠেছে একটি ট্রেকার্স হাট।

আজকে রাতের মত থাকা মোলেতে। সিঙ্গেল সিঙ্গেল বেড। বড় এক রুমে ছয়জন। আমি আর আশিক অন্য এক রুমে। রুমের দুইপাশে দুটি খাট। পূর্ব পাশটা জুড়ে জানালা। পর্দা সরিয়ে জানালা খুলতেই আচমকা এক পসলা দস্যি মেঘ শরীর ভিজিয়ে দিয়ে গেল। চট জলদি জানালা বন্ধ করে দিলাম। মেঘের বিন্দু বিন্দু জল জানালার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আমি বাহিরে প্রকৃতির নৈস্বর্গীক সৌন্দর্য উপভোগ করছি।

দ্বিতল ট্রেকার্স হাট, শ্রীখোলা। ছবি: সোলাইমান ইসলাম নিলয়

গভীর বনের মধ্যে ট্রেকার্স হাটটি। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে বিশাল বিশাল বৃক্ষ। আলো-আঁধারির এক সম্মোহনী গোধূলীর সময় প্রকৃতিকে মনে হচ্ছে ক্লান্ত। প্রকৃতির মত আমরাও ক্লান্ত কিন্তু মানসিক ভাবে উজ্জীবিত। পেছন থেকে আশিক এসে বলল, চা-নাস্তা রেডি।

গোধূলী লগ্নে একজন এসে সন্ধ্যাবাতি ও ধুপকাঠি জ্বালিয়ে চলে গেল। কেমন যেন আদিম আদিম লাগছে। আধুনিকতার ছোঁয়া নেই এই গহীন জঙ্গলে। এই সময়টা বনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পাক-পাখালির কল-কাকলিতে মুখরিত। মোমবাতির রহস্যময় আলোয় ঘন হয়ে আসছে সন্ধ্যা।

উপর থেকে দেখা শ্রীখোলা। ছবি: সোলাইমান ইসলাম নিলয়

ততক্ষণে আমি ডাইনিংয়ে। নাস্তা শেষ করে ধোঁয়া উঠা কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর আমাদের গাইডের সঙ্গে মজা করছি। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, তা দাদা কেমন দেখছো? আমি মজা করে উত্তর দিলাম, পাহাড়ের জন্য তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সেও আমাকে বলছে, সামনে পাহাড়-মেঘ দুটোই পাবে আরো, তখন তো কিছুই দেখতে পাবে না। ফিরতি আমার উত্তর ছিল, এজন্যই তো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

আজ সকালে ট্রেকিং লাইনে দেখি ও আরবি পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর ইউ মুসলিম?

আমাদের গাইড মুসলিম। কিন্তু তার স্ত্রী হিন্দু। গ্রেটার হিমালয়াতে হিন্দু, মুসলিম, ভুটিয়া, লেপচা, নেপালী বংশ পরস্পরায় একই সঙ্গে মিলেমিশে আছে।

পথের ক্লান্তি শেষে। ছবি: শামসুল আলম

অন্য প্রদেশ থেকে আসা ট্রেকারদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় হলো। সকলের সঙ্গে গল্পগুজবের মধ্যেই ডাইনিং থেকে ডাক এলো। রাতের খাবারে বাঙালিয়ানা ভাত, ডিম, সব্জি, ডাল খেতে বসলাম সবাই।

খাবার শেষে কারো কারো ঠাণ্ডায় কাঁপাকাঁপি বেড়ে গেলো। কেউ কেউ আবার গল্পে মশগুল। কারো কারো চোখে রাজ্যের ঘুম।  প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দুটো কম্বল মুড়ি দিয়ে শোয়ার পর ক্লান্ত শরীর কখন যে ঘুমের রাজ্যে তা টের পেলাম ভোরে গাইড এসে ডাকার পর।

জুম চাষ ও পাহাড়ি বসত। ছবি: সোলাইমান ইসলাম নিলয়

জানালার পর্দা সরিয়ে কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখলাম ভিন্ন একটি দেশে ভিন্ন একটি সকাল। ভোরের প্রকৃতিকে মনে হচ্ছে শিশুরমত নিম্পাপ। জানালার ওপাশে মেঘ উড়ছে। পরক্ষনেই আবার পরিস্কার। প্রকৃতি মেতে আছে তার হেঁয়ালিপনায়।

আমাদের আজকের ট্রেকিং গন্তব্য মোলে থেকে শ্রীখোলা। সাবারগ্রাম মোলে ছাড়াও ফালুট -গোর্খে – রাম্মাম হয়ে শ্রীখোলা পৌঁছানো যায়। এই রুটটাও এক কথায়  স্বপ্নের মত।

নাস্তা খেয়ে দ্বিতীয় দিনের মত হাঁটা শুরু। বড় বড় পাইন বৃক্ষের সারি, থোকা থোকা রডোডেনড্রন গুচ্ছকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলছি সামনে দিকে। কিছু কিছু বয়স্ক গাছের বাকলে শ্যাওলা ধরে কেমন যেন  বুনো করে তুলেছে পরিবেশ।

শ্রীখোলা ব্রিজ থেকে ট্রেকার্স হাট। ছবি: সোলাইমান ইসলাম নিলয়

পাথর ও কাঠের উপর রেড অ্যারো মার্ক চিহ্নিত ট্রেকিং পথ ধরে আমরা হাঁটছি। হুমায়ুন পিছিয়ে পড়ায় আমি আর ইব্রাহিম অপেক্ষা করছি। আমাদের গাইড তখন নিখোঁজ। পরে আবিস্কার করলাম বনমোরগ ধরতে ট্রেকিং লাইন ছেড়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে আমরা ট্রেকিং হাঁটে আশ্রয় নিয়ে চা বিরতি নিলাম। শ্রীখোলার আপহিল জায়গাটি অসাধারণ। এ পথে একমাত্র ঘোড়াই বাহন। ব্যস্ততা ছুটি নিলেও জীবন এখানে থমকে যায়নি। ঘরে ঘরে আছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার।

মাথার উপর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে মেঘ, পাহাড়, বন, প্যাগোডা অতিক্রম করে ধীরে ধীরে চলছি শ্রীখোলার দিকে।। মাঝে মাঝে আমাদের মেঘ তার আতিথেয়তার চাদরে জড়িয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির সান্নিধ্য, স্থানীয়দের সাথে আলাপচারিতা সে এক মধুর স্মৃতি। অবশেষে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেখা মিললো  শ্রীখোলার।

ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন থেকে হুমায়ুন, ইব্রাহিম, শামসুল আলম, মাহমুদ রাসেল, আশিক, সুলায়মান, অজিত, নেহাল। ছবি: সোলাইমান ইসলাম নিলয়

পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি থেকেই সৃষ্টি শ্রীখোলা নদীর। ঐ নামেই শ্রীখোলা গ্রাম। আর আছে শ্রীখোলা নদীর উপর নির্মিত দৃষ্টি নন্দন ঝুলন্ত ব্রিজ। শ্রীখোলার চারপাশের সৌন্দর্য হৃদয় দিয়ে ছোঁয়ার মত। মেঘ, ঝরনা, পাহাড়ে যে এত মুগ্ধতা জাগবে তা শ্রীখোলায় না এলে বোঝা যাবে না।