প্রচারনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা! নিয়ন্ত্রণকল্পেপ্রয়োজন আইনের যথাযত প্রয়োগ

সুমাউল হক
Published : 31 Dec 2015, 07:55 AM
Updated : 31 Dec 2015, 07:55 AM

প্রচারেই প্রসার-একথা আমরা সবাই জানি।আর এ প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হল বিজ্ঞাপন। এ কারনেই বোধ হয় বিলবোর্ড, রাস্তা-ঘাটওঅফিস বাড়ীর দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছে লেখা, বাহারি ছবি আর মন ভুলানো যতসব কথাবার্তার লিলাভুমি। আমার প্রশ্ন বিজ্ঞাপনের গুনগত মান নিয়ে নয় । প্রচার প্রচারনা থাকবেই, তবে এর জন্যতো দেশে নিয়ম-নীতিমালা থাকবে-এমনটা হওয়ার ও কথা । কিন্তু বাংলাদেশের যত্রতত্র বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়ালে চিকামারা দেখে কে বলবে এ দেশে নিয়ম আছে? আইন আছে? আছে সুস্থ বিজ্ঞাপন নীতিমালা। শহরের রাস্তায় রাস্তায় নেতাদের চাটুকারিতায় সমৃদ্ধ এইসব ডিজিটাল পোস্টার, ব্যানার এ গুলো কবে অপসারিত হবে? এগুলো থাকবে যতদিন নাকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয় ততদিন। রাজনৈতিক প্রচারপ্রচারনার পাশাপাশি বিভিন্ন পন্যও প্রতিষ্ঠানের প্রচারনার চিত্র দেখলে মনে হবে সারা বছর ধরে চলছে বিভিন্ন পন্যওপ্রতিষ্ঠানের ও জাতীয় নির্বাচনের মহোৎসব। নির্বাচন বলছি এ কারনে যে জাতীয় সংসদ কিংবা স্তানীয় সরকার নির্বাচনে নেতাদে রস্বাগতম, ঈদ-মোবারক ,নববর্ষের শুভেচ্ছায় টাঙানো ব্যানার, ফেস্টুন, ডিজিটাল পোস্টারে সয়লাব হয়ে যায় দেশের আকাশ বাতাস ।নির্বাচনের খাতিরে ওই সময় টুকু নাহয় মেনেনিলাম। কিন্তু বছরের পর বছরজুড়ে সারাদেশে রাজনীতিবিদদের চাটুকারিতায় লেখা ব্যানার, ফেস্টুন, ডিজিটাল পোস্টারে ভরে থাকে নগর, বন্দর, শহরের অলিগলি, রাস্থা-ঘাট; বাসস্থান, অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, দোকান ও অন্যান্য স্থাপনার দেয়াল ; এবং বৃক্ষ, বিদ্যুতের খুটি, খাম্বা, সড়কদ্বীপ, সড়ক বিভাজক, ব্রীজ, কালভার্ট, যানবাহন ; এমনকি বাদ যায় নামসজিদ, মন্দিরের দেয়ালও।
রাজনৈতিক প্রচারপ্রচারনার পাশাপাশি এই আবাধ অনিয়মেরও বিনেপয়সায় (কোনট্যাক্সছাড়া) বিজ্ঞাপনের সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও।এদের মধ্যে মোবাইল কোম্পানীগুলো, ফ্রুটিকা, প্রান, আরএফএল, কোচিং সেন্টারগুলো, বিকাশ ও ডাচ-বাংলা ব্যাংক এর বিজ্ঞাপনগুলো কারো ও নজর এড়াতে পারেনা।ফ্রুটিকা, কোচিং সেন্টার- উদ্ভাস/সাইফুরস, প্রানপন্য সারাদেশের দেয়ালগুলো এবং রাস্তার ডিভাইডারগুলো চিকা মেরে ভরে দিয়াছে।ডাচ-বাংলা ব্যাংক সরকারী নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটিকর্পোরেশন অনুমতি না নিয়েই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে, উপজেলা সড়কের দুপাশে এমন কি হাইওয়ে সড়কের পাশে স্থাপন করেছে শতশত বিলবোর্ড।মোবাইল কোম্পানিগুলো নিয়েছে এক অভিনব কায়দা-তারা তাদের রিটেইলারদের দোকানের আশেপাশে ঝুলিয়ে রাখে বাহারি সব ডিজিটাল পোস্টার। এখানেই শেষ নয়।দোকানদারদের বিকৃতরুচিকে পুজি করেসরবরাহকরছেসাইনবোর্ডযেখানেমোবাইলকোম্পানিরনাম, লোগো, মনোগ্রাম ইত্যাদির মাঝে দোকানের নামটিই খুজে পেতে অনুবিক্ষন যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। বিকাশ নামক প্রতিষ্ঠানটি বাস, প্রাইভেটকারের বেকগ্লাসে এঁটে দিয়েছে স্টিকার। ঢাকা শহরের রিকশাগুলোও রেহাই পায়নি ডাচবাংলা ব্যাংক এর মোবাইল ব্যাঙ্কিং স্টিকার থেকে। বৃক্ষ, বিদ্যুতেরখুটি, খাম্বায় দেখা যায় পাত্র/পাত্রি, হারবাল ঔষধ ,জমিজমা ক্রয়-বিক্রয়, উকিল /ডাক্তার /কবিরাজ/ কাজীর প্রচারনা, ডায়াগনিস্টিক ল্যাব, To-Let, কোচিং সেন্টার /স্কুল /কলেজ ভর্তিসহ নানান ধরনের বিজ্ঞাপন। নব নির্মিত দালান/ ভবন এর সন্মুখে দেখা যায় BSRM/KSRM ষ্টীল কিংবা সিমেন্ট কোম্পানির বিলবোর্ড ।এই তালিকা এত বড় যে লিখে শেষ করা যাবেনা। সারাটা দেশ যেন বিজ্ঞাপনের এক মগের মুল্লুকে পরিনত হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, যে যার মত মন গড়া ভাষা, চিত্তাকর্ষক ও লোভনীয় অফার দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করছে । ভাষা প্রয়োগে লাগামহীন হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠান গুলো। এসব দেখে মনে হয় আপনি যা খুশি লিখে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিতে পারবেন বিলবোর্ড ( বৈধ/ অবৈধ সব জায়গায়), পত্রপত্রিকা এমন কি টিভি /ডিশ মিদিয়াতে ও। হারবাল ঔষধ, পির-ফকির,দরবেশের বিজ্ঞাপন টিভি মিডিয়াগুলোতে এমনভাবে প্রচার করা হয় যে সহজ সরল অনেক মানুশ ই নানাভাবে প্রতারিত হয়ে আসছে নিরবে নিভৃতে ।বিজ্ঞাপনগুলোতে এমন ভাষা প্রয়োগ করা হয় যা রীতিমতো প্রতারনার শামিল। দু একটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে, যেমন ডাচ বাংলা ব্যাংক একটি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে "বছরে ১০২ কোটি টাকার উপবৃত্তি"।আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ব্যাংকটি বোধ হয় বছরে ১০২ কোটি টাকার উপবৃত্তি প্রদান করে। ২০১২ সালে ব্যাংকটির AFTER TAX INCOME ছিল ২৩১ কোটি , সেখানে যদি ১০২ কোটি টাকার উপবৃত্তি প্রদান করে – এও কল্পনা করা যায়! আসলে ব্যাপারটি হল ১০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প যা থেকে দরিদ্র মেধাবিদেরকে প্রতি বছর বৃত্তি প্রদান করা হয়। আরেকটি বিজ্ঞাপনের গুলশান কমার্স কলেজ উল্লেখ করে " ঢাকা শহরের সেরা কলেজগুলোর অন্যতম"।এমনি কত রকম প্রতারনা!! এই সমস্ত বিজ্ঞাপনের ভাষা যথার্থ রুপে বিশ্লেষণ করতে না পেরে কেউ যদি প্রতারিত হয় তার দায় দায়িত্ব কার?
প্রচারনার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার একটা সুরাহা হওয়া সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক দিকে যেমন নস্ট হচ্ছে পরিবেশের সৌন্দর্য্য ও আমাদের রুচিজ্ঞান অন্যদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে। দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণকল্পে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ নামে একটি আইন পাস করে।দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ (২০১২ সনের ১ নংআইন) এর ধারা -৪ এ বলা হয়েছে যেকোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইবার জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করিয়া দিতে পারিবে এবং উক্ত রূপে নির্ধারিত স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে; তবে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যকোন স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে, দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে। ধারা -২এ ''পোস্টার'' বলতে বোঝানো হয়েছে কাগজ, কাপড়, রেক্সিন বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম সহ অন্য যেকোন মাধ্যমে প্রস্ত্ততকৃত কোন প্রচার পত্র, প্রচারচিত্র, বিজ্ঞাপনপত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র; এবং যে কোন ধরণের ব্যানার ও বিলবোর্ড ।দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ধারা-৩ এ নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র ধারা-৯ এর বিশেষ বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ কোন স্থানীয়কর্তৃপক্ষের নির্বাচনে, নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান এবং এতদুদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা প্রযোজ্য হইবে।
ধারা-৬ এ অপরাধ ও দণ্ড বিষয়ে বলা আছে যেকোন ব্যক্তিধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫(পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থ দণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং সুবিধা ভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০(পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থ দণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০(ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা, ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।ধারা-৮ এ বলা হয়েছে যে কোন কোম্পানী কর্তৃক এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটিত হইলে উক্ত অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে কোম্পানীর এমন প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে, যদিনা তিনি প্রমাণ করিতে পারেন যে, উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে অথবা উক্ত অপরাধ রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।
বিদ্যমান দেওয়াল লিখন বা পোস্টার সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ, ইত্যাদিঃ সম্বলিত ধারা-৫ এর উপ-ধারা (১) (২) (৩) এবং উপ-ধারা (৪) অনুযায়ী সময়সীমা নির্ধারণ করা হইলে, উক্তরূপ সময়সীমার মধ্যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগীকে তাহার দেওয়াল লিখন বা, ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিতে বা অপসারণ করিতে হইবে।উক্ত সময়সীমা অতিবাহিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, স্ব-উদ্যোগে, অননুমোদিত যে কোন দেওয়াল লিখন বা, ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিতে বা অপসারণ করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমের আনুষঙ্গিক ব্যয়ের সমুদয় অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগী রনিকট হইতে নগদ আদায় করিবে।ব্যক্তি বা সুবিধাভোগী তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করিতে না পারিলে উহা Public Demands Recovery Act, 1913 (Act IX of 1913) এর বিধান অনুযায়ী সরকারি দাবী হিসাবে আদায় করা যাইবে।বিচারঃ ধারা-৭ এ আছে যে , আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুকনা কেন, ধারা৬এরউপ-ধারা (২) এর অধীন সংঘটিত অপরাধ মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ (২০০৯সনের ৫৯ নং আইন) এ উল্লিখিত মোবাইল কোর্ট কর্তৃক বিচার্য হইবে, এবং ধারা ৬ এর উপ-ধারা (৩) এর অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার Code of Criminal Procedure, 1898 (Act No. V of 1898) এর Chapter XXIII অনুসারে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হইবে।
আইনের সুস্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বে ও আবাধে চলছে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো। বিনা ট্যাক্সে প্রচারনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে যে যার মত ফায়দা লুটছে। ফলে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোও নিয়মনীতি মেনে কর্তৃপক্ষকে নির্দিষ্ট হারে টেক্স দিয়ে ব্যাবসা করতে হিমসিম খাচ্ছে। সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই মুলত এর জন্য দায়ী। সরকার এ ব্যাপারে একটু সক্রিয় ভুমিকা নিলেই তৈরি হবে শত কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের উৎস এবং দেশবাসী স্বস্তি পাবে এই পোস্টার/ দেয়াল লিখন উৎপাত থেকে। তৈরি হবে প্রচারনার সুস্থ মানসিকতা এবং গড়ে উঠবে বিজ্ঞাপনের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো।

———————————————–লিখেছেনঃমু.আ.হা.সুমাউলহক