নরওয়েতে ঘরবন্দি জীবনে জমে ওঠা হতাশা

সৌমেন রুদ্র
Published : 3 May 2020, 04:05 PM
Updated : 3 May 2020, 04:05 PM

নরওয়েতে জনসংখ্যা তুলনামুলক অনেক কম। সম্ভবত এ কারণেই এই মহামারী এতো ছড়িয়ে পড়েনি। এরমধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রামণের সংখ্যাও কমে এসেছে। অবরুদ্ধ পরিস্থিতি কাটিয়ে নরওয়ে ফিরছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাচ্চাদের স্কুল খুলে দেওয়া হচ্ছে এখানে। তারমানে আমাদের ব্যস্ততাও আগের মত স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে।

পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে ফিরিনি এই মহামারীতে। নরওয়েতেই রয়ে গেছি।নরওয়েতে লকডাউন শুরু হয়েছে সেই মার্চ মাসের ১০ তারিখ থেকে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান খোলা থাকলেও লোক সমাগম কমে গিয়েছিল সব জায়গাতেই। কিন্তু বাজার ও অন্যান্য নিত্যপণ্য কেনার তাগিদে দোকানমুখী হতেই হচ্ছে তাদের আবার।

শহরের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় আগে শত শত মানুষের সমাগম হলেও নরওয়েতে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর এখানে সেই ভিড়ে ভাটা পড়েছে।

লকডাউন ঘোষণার পর গ্রিমেস্টেড শহরের কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সামনের আগের মত যাতায়াত নেই।

শহরের সবচেয়ে বড় ও পুরানো চার্চটি বন্ধ হয়েছে এই সময়। প্রবেশ মুখের দরজাটা খোলা থাকলেও ভক্তদের আনাগোনা নেই আর।

আমি নরওয়েতে অধ্যাপনা করছি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের  কাজকর্ম ঘর থেকেই করে যাচ্ছি। বাকিটুকু সময় পরিবারকে দিচ্ছি। আমাদের সময় কেটে গেলেও প্রতি মুহূর্তে দেশে স্বজনদের কথা মনে পড়ছে।

বেশ কিছুদিন ধরে একটা হতাশা কাজ করছে। আগে কখনো উপলব্ধি করিনি এভাবে। প্রতিদিন মা-বাবার সাথে কথা হয়। মায়ের সঙ্গে যখন ফোনে কথা বলি, মেসেঞ্জার ভিডিও দেখি, তারপর একটা কষ্ট অনুভব হয়। এই কষ্টটা নিজের ভেতরেই রাখার চেষ্টা করি। ওদের বুঝতে দেই না আর। মনটাকে শক্ত করে সবার সাথে কথা বলি।

আমি বুঝতে পারি মহামারীর এই সময়টায় ওদের মনোবলেও একধরনের চির ধরেছে। মায়ের ডায়বেটিস, আগে প্রতিদিন বাহিরে হাঁটতে যেত। এখন পারছে না। ঘরের মধ্যে হাঁটছে। আর বাবাতো আগে থেকেই ঘরের চার দেয়ালে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। এখন দুজনেরই ঘরবন্দি জীবন। একটা আতঙ্ক কাজ করছে ওদের মধ্যে। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয় তাদের মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করার পাঁয়তারা করছে যেন সারাক্ষণ।

আমি এসব  বুঝতে পারছি বিদেশে বসে। নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করি, তারা যেন অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকেন। প্রিয়জনেরা নিজের ও আমার মনোবল বাড়াতে সহয়তাও করছেন। তবুও কেন যেন হতাশা পিছু ছাড়ছে না। যারা আমার মত প্রবাসে আছের তাদেরও নিশ্চয়ই এমন হতাশা জন্ম নিচ্ছে মনের গভীরে।

যারা পরিবারের সবার সাথে থাকতে পেরেও হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম ভেঙ্গে বাইরে যাচ্ছেন  অকারণে তাদের কাছে এই সময় একটাই কথা বলার আছে;  নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করুন, আর যথা সম্ভব ঘরে থাকুন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান।

এই সময় বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও সবার নজর দিতে হবে। মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার জন্য তাদের নানাভাবে সহায়তা করতে হবে এখন।

প্রবাস জীবনে এখন শুধুই অপেক্ষা, কখন পরিস্থিতি ভালো হবে, আর আমরা দেশে মা-বাবার কাছে ফিরবো একটু স্বস্তি খুঁজে পেতে।