বাংলা বর্ষপঞ্জি (Bangla Calender)

সৃষ্টি ও কৃষ্টি
Published : 12 April 2012, 06:47 PM
Updated : 12 April 2012, 06:47 PM

গ্রেগেরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা হয়৷ সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই শুরু হয় বাঙ্গালির পহেলা বৈশাখ উত্সাব৷ বাংলা দিনপঞ্জির সাথে হিজরি ও খ্রিষ্টিয় সালের সাথে কিছুটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে৷ প্রচলিত হিজরি সালের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে, ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে, আর বাংলা সাল শুরু হয় ভোরে বা সূর্যোদয়ের সাথে সাথে৷ এ ছাড়াও সৌর সাল হয় ৩৬৫ দিনে আর চান্দ্র হয় ৩৫৪ দিনে অর্থাত্‍ চান্দ্র সাল সৌর সাল থেকে ১১ দিন কম৷ সে কারণেই হিজরি ও চান্দ্র সালের মধ্যে ১১ দিন করে ব্যবধান বাড়তে থাকে৷ বাংলা সালে ১২ মাসে মোট ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা৷ অতীতে ১২ মাসের কাল বিন্যাসে কিছুটা জটিলতা থাকায় ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ড.মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্কে সভাপতি করে বাংলা বর্ষপঞ্জি পুনর্বিন্যাসের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷ এ কমিটি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রচলিত বাংলা সালের মূল কাঠামো ঠিক রেখে বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং শেষের সাত মাস ৩০ দিন ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের সুপারিশ করে যা ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জুন বাংলা সৌর সালের নিয়মতান্ত্রিকতা কার্যকর করা হয়৷ ফলে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যনত্ম ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যনত্ম প্রতি মাস ৩০ দিন করে গণনা করা হয়৷ এ ছাড়াও বছরে বাড়তি ৬ ঘন্টার জন্য গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জিতে অধিবষের্র (লিপইয়ার) মতো বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও অধিবর্ষ হিসেবে চৈত্র মাসকে ৩১ দিন হিসাবে ধরা হয়৷

পহেলা বৈশাখের ইতিহাস
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে অনেক আগে থেকেই বাংলা বারটি মাস নিয়ে বছর গণনা করা হত৷ এ সৌর পঞ্জিকা ও গ্রেগেরিয় পঞ্জিকা শুরু হতো এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে৷ প্রাচীন বাংলার রাজা শশাঙ্ক (৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) গ্রেগেরিয় পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ এপ্রিল থেকে বাংলার কাল গণনা শুরু করেছিলেন৷ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এ সময় থেকেই অসাম, ত্রিপুরা, বঙ্গ, কেরল, মণিপুর, নেপাল, উরিষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুতে নববর্ষ উদযাপিত হতো৷ কিন্তু সার্বজনীন উত্সলব হিসেবে নয়৷ তখন নববর্ষ ঋতুধর্মী উত্সরব হিসেবে পালন করা হতো৷ এ উত্সলবের মূল বিষয় ছিল কৃষিকাজকে প্রাধান্য দেয়া ৷ কেননা এ সময় সমাজ-অর্থনীতি কৃষিকাজের উপর অধিকাংশ নির্ভরশীল ছিল৷ ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর মুঘল সম্রাটগণ হিজরি পঞ্জিকা অর্থাত্‍ চান্দ্র মাসের নিয়ম অনুসারে কৃষি ফসলের খাজনা আদায় করতেন৷ কিন্তু খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে সেই বিশেষ দিনটির সাথে কৃষি ফসলের কোনো সমন্বয় ছিল না৷ ফলে অসময়ে কৃষকরা ফসলের খাজনা প্রদান করতে ব্যর্থ হতো৷ খাজনা আদায়ের সুষ্ঠুতা আনা ও প্রজাদের অনুরোধ রক্ষার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বিখ্যাত রাজ জ্যোর্তিবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সালের সংস্কার আনার জন্য নির্দেশ দেন৷ তিনি সেই নির্দেশ অনুসারে হিন্দু সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সালের নিয়ম নির্ধারণ করেন৷ ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয় এবং সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬ ) থেকেই নতুন পঞ্জিকা অনুসারে সাল গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়৷ প্রথমে এ সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সাল, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে৷ এর পর থেকেই চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রানত্মি) জমিদারি সেরেসত্মায় প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করা হতো৷ এ সময় প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো৷ এর পরের দিন, অর্থাত্‍ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন৷ এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো৷ এ সময় থেকেই হালখাতা উত্সকবের প্রচলন হয় ৷ এ দিনে মহাজনরা পুরানো দেনা-পাওনার হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাবের খাতার সূচনা করতেন যার প্রচলন আজও আছে৷ মূলত এ ধরনের উত্সনবের মাধ্যমে দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্কের সূচনা হতো৷

আধুনিকভাবে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয় ৷ ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ তবে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যনত্ম পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি৷

(Karwadin), Avw`© (Ardi), †Lvi`v`( Khordad,), Zxi(Teer), Avgvi`v` (Amardad), kvnvwievi (Shahriar), wfwnmy (Vihisu), Avevb (Aban), AvRvi (Azur), †`( Dai), evngvb (Baham) I Bmdv›`v wgR(Iskander Miz )| G cwÄKvi cÖ_g bvg wQi ZvwiL-B Bjvwn (Tarikh-e-Elahi)|

বাংলা মাসের নামকরণ
সম্রাট আকবরের আমলে ফার্সি মাসের অনুকরণে বাংলা মাসের নাম ছিল যথাক্রমে কারওয়ারদিন (Karwadin),, আর্দি (Ardi), খোরদাদ( Khordad ), তীর( Teer), আমারদাদ (Amardad), শাহারিবার (Shahriar), ভিহিসু (Vihisu), আবান (Aban), আজার (Azur), দে( Dai ), বাহমান (Baham) ও ইসফান্দা মিজ( Iskander Miz )৷ এ পঞ্জিকার প্রথম নাম ছির তারিখ-ই ইলাহি
(Tarikh-e-Elahi )৷ পরবর্তীকালে নানা ঘটনাক্রমে মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকার নাম অনুসারে বর্তমান নামে প্রর্বতন করা হয়৷ বাংলা বা ফসলি সালে বারো মাসের নাম করা হয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে যা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধানত্ম (Surya Siddhanta) থেকে গৃহীত হয়েছে ৷ মাসের নামগুলো নিম্নরূপ-

বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে বৈশাখ; জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম থেকে জ্যৈষ্ঠ; উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের নাম থেকে আষাঢ়; শ্রবণা নক্ষত্রের নাম থেকে শ্রাবণ; পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম থেকে ভাদ্র; আশ্বিনী নক্ষত্রের নাম থেকে আশ্বিন; কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম থেকে কার্তিক; মৃগশীরা নক্ষত্রের নাম থেকে মাগশীষর্ (অগ্রহায়ণ); পৃষ্রা নক্ষত্রের নাম থেকে পৌষ; মঘা নক্ষত্রের নাম থেকে মাঘ; উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম থেকে ফাল্গুন; চিত্রা নক্ষত্রের নাম থেকে চৈত্র৷

আমাদের সংস্কৃতির এক মৌলিক উপাদন বাংলা বর্ষপঞ্জি৷ এ বর্ষপঞ্জির সূচনা হয় নববর্ষ উত্সকব দিয়ে যা আমাদের জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীক৷ এ উত্সকবের উদ্ভব হয়েছিল বাংলার কৃষক সমাজের মধ্য দিয়ে৷ আজও বাংলা বর্ষ আমাদের কৃষক সমাজের চেতনায় বিঁধে আছে ও মিশে আছে জীবনের সঙ্গে৷ কোনো মাসের নামের সাথে মিশে আছে ফসল, আহরণ ও বিভিন্ন ধরনের আনন্দ উত্স বের সম্পর্ক৷
দেশে দেশে নববর্ষ পালন উত্সমব

পারসিকগণ খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নববর্ষ পালন বা নওরোজের প্রর্বতন করেছিলেন এবং এ ধারাবাহিকতায় এখনো ইরানে নওরোজ বা নববর্ষ জাতীয় উত্সিব হিসেবে পালিত হয়৷ ইরান থেকেই এ ধরনের একটি সংস্কৃতিক ধারা মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে৷

বেবিলনে নববর্ষ উদ্যাপিত হতো আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে যা ছিল সে দেশের সর্ববৃহত্‍ জাতীয় উত্সপব৷ এ উত্সগব ১১ দিন ধরে পালন করা হতো৷ ফরাসি, গ্রিক, মিসর, ভারত, চিন, ভিয়েতনাম, লাওসেও বর্ষবরণ উত্স`বের প্রচলন রয়েছে৷ এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের সকল দেশেই নববর্ষ বিশেষ ধুম-ধামের সাথে পালন করা হয়৷ ইংরেজি নববর্ষ ইউরোপ ও আমেরিকায় আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে৷ গ্রেগরিয় পঞ্জিকা সারা বিশ্বে অধিক অনুসৃত হয় বলে পহেলা জানুয়ারি বিশ্বে মহোত্স ব বয়ে যায়৷ এর ঢেউ আমাদের দেশেকেও কম আলোড়িত করে না ৷

ভারতীয় উপমহাদেশে সাচ্চীর তোরণে নববর্ষ উত্সেব উদ্যাপনের কিছূ নির্দশন পাওয়া যায়৷ এ নির্দশন অনুসারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশাখী ও সংক্রানত্মি উত্সাব অন্যতম৷ বার্মায় ১২শতকের দি গ্লাস প্যালেস ক্রনিকলে সংক্রানত্মি ও বৈশাখী উত্সএবের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ চৈত্র-সংক্রানত্মি ও পহেলা বৈশাখ বৌদ্ধ পঞ্জিকায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে অনেক প্রাচীন কাল থেকেই৷ এই দুই উত্সিবের উল্লেখ বার্মা, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার নথিপত্রেও দেখা যায়৷ বর্তমানে এ সকল দেশে তিন দিনের অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় ও জাতীয় পর্যায়ে৷ উত্সদবের তিন দিন সরকারি অফিস-অদালত বন্ধ থাকে৷ জলকেলি বা ওয়াটারি ফেস্টিভ্যাল, সংক্রানত্মি ও বৈশাখী লাউসের অত্যনত্ম জনপ্রিয় অনন্দময় সার্বজনীন অনুষ্ঠান যা পৃথিবীর খুব কম জায়গায়ই অনুষ্ঠিত হয়৷ ব্রাজিলে পালিত হয় বিখ্যাত মারদিয়াস ফেস্টিভ্যালস৷

বাংলা দেশে নববর্ষ পালন
মুঘল পূর্ববর্তী আমলে এ দেশে নববর্ষ পালনের রীতি ছিল না৷ অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশের সকল অঞ্চলে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি-নীতি প্রায় একই রকমের এবং জাতীয়ভাবে পালন করা হয়৷

বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের সাথে নববর্ষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান৷ ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নতুন জামা-কাপড় পরে এবং নবর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে বেড়াতে যায় এবং ছোটরা বয়জ্যেষ্ঠদের সালাম বা প্রণাম করে৷ এ ছাড়াও নববর্ষ উপলক্ষে চৈত্রের শেষ দিনে বাড়িঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুন্দরভাবে সাজানো হয়৷ প্রতিটি পারিবারিক পর্যায়ে সকালে ও বিকালে বিশেষ বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়৷ আর্থ-সামাজিক দিক থেকে স্বচ্ছল পরিবারগুলো সকালে পানত্মা ইলিশের অয়োজন করে থাকেন৷ বিকাল বেলায় খেলার মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার৷ মেলাতে স্থান পায় বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পজাত দ্রব্য, নানা রকমের পিঠা ও পুলি৷ শিশুদের জন্য থাকে বিশেষ খলনা জাতীয় দ্রব্যের সমারোহ৷ এছাড়াও নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা কিম্বা কুসত্মি খেলার অয়োজন এখনো বাংলার গ্রামীণ কৃষ্টিকে ধারণ ও বহন করে চলছে৷ এছাড়াও পহেলা বৈশাখের সাথে আমাদের অনেক পুরানো সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে৷ এক সময় গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হতো যাত্রাগান, পালা গান, কবিগান, গাজীর গাজন, পুতুল নাচ, বাউল-মুর্শিদি, ভাটিয়ালি গান, বর্ণনামূলক নাটক_ লাইলি-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুুলেখা ইত্যাদি যা এখন আর চোখে পড়ে না৷ এক সময় ঢাকায় ঘুড়ি উড্ডয়ন, মুন্সিগঞ্চে ষাঢ়ের দৌড়, গ্রামে-গঞ্জে ঘোড়ার দৌড়, মোরগের লড়াই প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল যা এখন নেই বললেই চলে৷ বর্তমানে এগুলো বিলুপ্তি সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত৷ তবে এখনো পহেলা বৈশাখে চট্রগ্রামে বলি খেলা ও রাজশাহীতে গম্ভীরা বেশ আড়ম্বরের সাথে পালন করা হয়৷

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় রমনার বটতমূলে মুক্ত চিন্তার সংগঠন ছায়ানটের_"এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গানের মাধ্যমে৷ এ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান করা হয়৷ ১৯৬০ দশকে পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সংস্কৃতি চর্চা বন্ধের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়৷ ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা বের করে মঙ্গল শোভাযাত্র৷ এ শোভাযাত্রায় স্থান পায় বাংলার পশুপাখি আর অন্যান্য বিচিত্র চেহারার মুখোশ যা বৈশাখ উদযাপনকে আরো অধিক আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করে তোলে ৷ এ শোভাযাত্রায় হাজার হাজার বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ অংশ নেয়৷ বিশাল এলাকা জুড়ে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও বযস্কদের পথচারণে মুখরিত হয়ে উঠে রাজপথ৷ হাতে বেলুন, বাউলের একতারা, ছোট ডুগডুগি নিয়ে ঢাকের বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে নব বৈশাখে ৷ মূলত এ শোভাযাত্রার মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন এবং অবহামান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়৷ এ শোভা যাত্রার জন্য তৈরি করা হয় রঙ-বেরঙের বিভিন্ন আকৃতির মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি৷ এ ছাড়াও সকল বিভাগীয় ও জেলা শহরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের অয়োজন করা হয়৷ ১৯৮৩ সালে শুরু হয় পাআত্ম ইলিশের প্রচলন যা বর্তমানে অত্যনত্ম জনপ্রিয় বৈশাখের পানত্মা ইলিশ সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এর শিকড়ের বিস্তৃতি লাভ করেছে শহর ছেড়ে গ্রামেও৷
সমপ্রদায়গত দিক থেকেও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ৷ হিন্দু, বৌদ্ধ, চাকমা, মার্মা সমপ্রদায় জাতীয়ভাবে এ দিনটি পালনের পরও বিভিন্ন ধরনের ধর্মীও অনুষ্ঠান, নিয়মনীতি পালন করে থাকে৷ ত্রিপুরাদের বৈসুক, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিজু উত্সেব অন্যতম৷ বর্তমানে এ তিনটি জাতিসত্তা যৌথভাবে এ উত্স বটি পালন করে থাকে যা বৈসাবি নামে পরিচিত৷ বৈসাবি সৃষ্টি হয়েছে প্রতিটি অনুষ্ঠানের প্রথম অক্ষর দিয়ে৷

পশ্চিম বাংলায় নববর্ষ উদ্যাপন
পশ্চিম বাংলায় মহানন্দের মধ্য দিয়ে পালিত হয় বাংলা নববর্ষ_ পহেলা বৈশাখ৷ নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য গ্রাম ও নগর পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ অনেকটা আমাদের দেশের মত৷ তবে প্রতিটি পরিবারে সকল সদস্য ভোরের স্নান পর্বের মাধ্যমে নিজকে পবিত্র করে বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে ভগবানের আশির্বাদ লাভের জন্য প্রার্থনা করে ৷ অতঃপর মেতে উঠে নববর্ষের আনন্দে ৷ প্রতিটি গৃহেই আয়োজন করা হয় লুচি, পায়েস, মাংস, ইলিশ ও অন্যান্য উন্নত খাবারের ৷ মন্দিরগুলোতেও বিতরণ করা হয় প্রসাদ৷ রাসত্মার অলিতেগলিতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের৷ মাঠে ও রাসত্মার দুপাশে বসে গ্রামীণ পণ্য সামগ্রির মেলা৷ বাস, গাড়ি, রেলের ভীড় মনে করিয়ে দেয় পহেলা বৈশাখের কথা, আনন্দে উপভোগের কথা৷

নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য সারা চৈত্র মাস ধরেই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি৷ চৈত্র মাসের শেষের দিনে পালিত হয় চৈত্র সংক্রানত্মি, চড়ক বা নীল পূজা, শিবের উপাসনা ইত্যাদি৷ গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করা হয় চড়ক মেলা৷ এ মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে উপস্থিত দর্শকের আনন্দ দিয়ে থাকে৷ এছাড়াও অধিকাংশ হিন্দু পরিবার বর্ষের শেষ দিন টক ও তিতা-ব্যঞ্জন খেয়ে সমর্্পকের সকল প্রকার তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করে নতুন বছরে জন্য নিজকে প্রসত্মুত করে নেয় সকলের সাথে আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য৷ সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টি ভোজন৷ ব্যবসায়িক লেনদেন বৃদ্ধির জন্য পহেলা বৈশাখের নিমন্ত্রণ কার্ডও ছাপানো হয়৷

বৈশাখ আসে আনন্দ উত্সেবে সকলের মাঝে
বাংলা সালের প্রতি বাংলার মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে নববর্ষ বরণের মধ্য দিয়ে৷ অতঃপর নিজস্ব ধারায় বারো মাসে তের পার্বনের ধারা চলতে থাকে৷ বৈশাখী মেলা, হালখাতা, নাচ, গান, কবিতার আসর, লোকজ মেলা, চৈত্র সংক্রানত্মি, পালাগানের আসর, নৌকাবাইচ ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে মেতে উঠে বাঙ্গালির মন৷ আবহমান কাল থেকে এ উত্স্বগুলো যেন আমাদের প্রকৃতির কথা বলে, সংস্কৃতির কথা বলে, সমপ্রতির কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে৷ রমনা বটমূলের পহেলা বৈশাখ আজ আর বটমূলে সীমাবদ্ধ নয় ৷ প্রতিটি বাঙ্গালির ঘরে ঘরে উত্সপবের জন্ম দিয়েছে৷ এ দিনটি পালনের মাধ্যমে জেগে উঠে বাঙ্গালি হৃদয়- মন, দেহ ও প্রাণ৷ এ দিনে আমরা পুরাতন বছরের ভুলক্রুটি শুধরে নিয়ে অঙ্গিকারাবদ্ধ হই নতুন উদোগে, নতুন উল্লাসে, নতুন ভবিষ্যতের দিকে ৷ বাংলা নববর্ষ আজ আর নিছক সংখ্যা নয় ৷ বাঙ্গালির সংস্কৃতি বিকাশে এক নতুন ধারা, নতুন স্রোতধারা৷

যে কোনো উত্সকবই মানুষের আনন্দানুভূতি থেকে উত্সানরিত৷ বর্ষবরণ, বর্ষবিদায় কিম্বা পৌষ মেলা, বসনত্ম মেলা, দোল পূর্ণিমা ইত্যাদি৷ এ সকল উত্স,ব আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে জাজ্বল্যমান করে রাখে৷ নবান্ন, চৈত্র সংক্রানত্মি এ সকল উত্সাবই গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি৷ গ্রামীণ জীবন এ ঐতিহ্যকে ধারণ করে, লালন করে এবং পরিপুষ্ট করে৷ বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালি সাংস্কৃতিক জীবনের সবচেয়ে উত্সএবমুখর দিন৷ প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালির সংস্কৃতিধারায় নব নব চেতনার উম্মেষ ঘটছে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে৷ গড়ে তুলছে সকল সমপ্রদায় ও মানূষের মধ্যে সৌহার্দ ও সমপ্রীতির বন্ধন৷

পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালির উত্স বের দিন, বাংলা বছরকে অভিবাদন জানানোর দিন ৷ এ দিন গোটা বাঙ্গালী আলোড়িত হয়, আন্দোলিত হয় নতুন চেতনায়, নতুন উন্মেষে৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় "প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকি৷ কিন্তু উত্সশবের দিনে মানুষ বৃহত্‍, সে সমসত্ম মানুষের সাথে একত্র হইয়া বৃহত্‍, সেদিন সমসত্ম মানুষের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহত্‍৷"সত্যই মানুষ নির্মল আনন্দ এবং সামাজিক মিলনের মধ্য দিয়ে বড় হয়৷৷ প্রসারিত হয় তার দৃষ্টির দিগনত্ম৷ এই বড় হওয়া সার্থক হয়ে ওঠে তখনই যখন তা ব্যাপৃত হয় জীবন জুড়ে৷ কিন্তু আমাদের বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন৷

নিশি অবসান প্রায় এ পুরাতন বর্ষ হয় গত
আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণর্ জীবন করিলাম নত৷৷
বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে রও
ক্ষমা কর আজিকার মত
পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত৷৷
—–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লেখক পরিচিতি: বিষ্ণু দাশ, লেখক, গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও ড. উত্তম কুমার দাশ সহযোগী অধ্যাপক ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ
( বাংলাদেশ পাঠ্য পুস্তক বোর্ড), লেখক ও গবেষক