ডাক হরকরা ডাকে

সুদীপ্ত সজল খাঁ
Published : 2 March 2015, 05:33 PM
Updated : 2 March 2015, 05:33 PM

বহুকাল আগের কথা । রানার কবিতাটা এতবার পড়েছি আর এতটা আবেগে আপ্লুত হয়েছি যে এখনও মনে বাজে । বাবার কিনে দেওয়া প্রথম কবিতার বই – সুকান্ত ভট্টাচার্যর ছাড়পত্র 

কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে

শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;

হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন্ জোনাকিরা দেয় আলোমাভৈঃ রানার !

এখনো রাতের কালো।

এরপর একদিন নতুন বাংলা বই হাতে পেয়ে কোন এক বছরের প্রথম দিনে একটা গল্প পড়েছিলাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ডাক হরকরা। সেখান থেকে আমার একটা আবেগ গড়ে ওঠে ডাক ব্যবস্থার সাথে জড়িত এই রানার/ডাক হরকরা বা পিয়ন চরিত্রটির উপর । বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন ।সেই সুবাদে তার বাড়ি আসা হত না প্রায়ই । মাসের পর মাস কেটে যেত । মাকে দেখতাম চিঠি লিখতে । আমিও আমার ছোট প্যাড আর কলম নিয়ে বসে ভাঙ্গা অক্ষরে বাবাকে লিখেচি অনেক কথা । কয়েকটা লাইন এখনও মনে পড়ে । "আব্বা, মা মারছে । আমি খেলতে যাবো ।" "তুমি কবে আসবা ? আসার সময় ব্যাট আনো" " এবার স্কুলে আমি একসাথে ৫ টা প্রাইজ পাইছি।" আমি জানি শুধু আমি না । আরো অনেক শিশুর কাছেই এই আবেগটা ছিল। হয়তো কেউ কেউ এই লেখাটা পড়ে স্মৃতিচারণ করবেন। তবে আমার সবথেকে বেশি ভাল লেগেছিল স্কুলে যাবার সময় ঝালমুড়ির দুই টাকা দিয়ে হলুদ একটা খাম কিনে সেখানে আমার সেই নালিশ চিঠি পুরে – জিভের আঠায় লাগিযে, ডাকবাক্সটায় ফেলে দেয়ার মুহুর্তগুলো । একদিন বাবার ব্যাগ থেকে কি জানি খুজতে গিয়ে এক কোণায় যত্ন করে রাখা আমা সেই চিঠিগুলো দেখে চোখে পানি এসেছিল আনন্দে।

বৃষ্টির দিনেও যখন সাইকেলের রিং শুনতাম জানালার পাশে আমি নিশ্চিৎ ছিলাম ডাকপিয়ন এসেছে আমার বার্তা নিয়ে । বুকটা ভরে উঠত এইসা আনন্দে । সেসব দিন আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে দাড়িয়েছে। যে কারণে আজকে কীবোর্ডটা কোলে তুলে নেয়া ।

আমার যে স্মৃতিগুলোর কথা বর্ণণা করেছি তার সাথে অনেকেরই স্মৃতি মিলে যেতে বাধ্য। তাকিয়ে দেখুন পিছনের দিকে । ডাকপিয়ন আর ডাকবাক্স নিয়ে কত স্মৃতি যে উঠে আসবে বলে শেষ করতে পারবেন না । একসময় মনের কোণায় একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস উঠে আসবে । কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের খুব খুব সুখের কিছু মুহুর্ত এনে দেয়া দীনুরা ? ডাকবাক্সের লাল রঙ আজ ধূসর হয়েছে। সময় করে ওটা খোলার দরকার পড়ে না রোজ বেলা ১২-৩০ মিনিটে ।

আমাদের অনেক কিছুই হারিয়েছে বা হারিয়ে যেতে দিতে হয়েছে। সময়ের কাছে আমাদের আবেগ দাড়াতে পারেনি। কিন্তু , আধুনিকতার নাম করে আমরা কি কোনকিছু বলি দিয়ে ফেলেছি? আধুনিকতার অর্থ তো কোনকিছু লোপাট করা নয় । বরং সামঞ্জস্যতা আনা । বরং আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে আমাদের সবকিছূকেই একীভূত করা ( কুসংস্কার আপন ইচ্ছায় ঝরে যায় ) ।

চীনের প্রতিটি পোস্ট অফিস আধুনিকায়ন করা হয়েছে। রাষ্টায়ত্ত এই সংস্থাটি সবথেকে বেশি নির্ভরতার প্রতীক হযে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে ৬০ গুন বড় গণচীনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের মানুষ পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে থাকে । প্রতিটি পোস্ট অফিস কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হলেও সেগুলো মানুষই নিয়ন্ত্রন করে । পোস্টম্যানের চাকরি এখনও রয়েছে এবং সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কার চিঠি এখন কোথায় আছে সেটি ইন্টারনেটে দেখা যায় । কোন পোস্ট অফিসের কোন ব্যক্তির কাছে গেলে সেটি পাওয়া যাবে সেটাও জানা যায় । প্রিয়জনের জন্মদিন । আপনি দূরে আছেন । পৌছে যাবে সঠিক সময়ে আপনার পাঠানো গিফট। যেটা আপনি নিজে গিযে কেনেন নি । যা ইমেইলে পাঠানো সম্ভব না । আপনার প্রিয়জন যখন দেখবে তার দরজায় দাড়ানো ডাকপিয়নের হাতে আপনার পাঠানো জিনিস। একবার ভাবুন সেই অনুভূতিটার কথা । মোটকথা ডাকপিয়নের অস্তিত্বকে ভ্যানিশ করে নয় বরং আরো উপযুক্ত করে দাড় করানো হয়েছে। ভারতেও চলছে সেই চেষ্টা । বড় বড় দেশগুলোতোও সেটা হয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই হয় নি। প্রমাণ চান ?বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ,, আপনার বর্তমান এলাকার পোস্ট অফিসটা কোথায় ? আপনার সখের ডাকটিকিট জমানো অ্যালবামে মোট কতটা দেশীয় ডাকটিকিট ?? অ্যালবামের নাম কি ? বিদেশী ডাকটিকিট সমগ্র না ? বলুন তো আপনার দেখা শেষ পোস্টম্যানটির সাথে কবে দেখা হয়েছে? আশা করি বুঝে গেছেন আমার লেখার উদ্দেশ্যটা ।

গ্রেট ব্রিটেনের বিগবেন এর দেয়া সময় নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই । কারণ প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোনে সময় দেকা যায় । তবুও বিগবেন এখনও আছে রঙিন। প্রতিটি ইংরেজ এখনও তার পূজা করে কবিতা বা নাটকে । অথচ আমরা সেটা ছেড়ে দিয়েছি । আমাদের নাটকের বা গানের বড় অংশ হয় প্রেমে ছ্যাক দেয়া না হয় ছ্যাক খাওয়া । অথচ কত আর্তনাদ যে চাপা পড়ে গেছে তার হিসাব নাই । পোস্ট অফিসের বারান্দায় পোস্টম্যানের অলস সময় এর ফাকে তার সাইকেলের স্পোকে ধরেছে জং । বড়বাবু বলে দিয়েছেন খরচ কমাতে অপ্রয়োজনীয় লোক ছাটাই হবে। সংসারের হাল হকিকত কি হবে আল্লাহ মালুম ।

ভাই , বন্ধু, আমাদের সমাজটা অতটা আধুনিক হয় নি যতটা আমরা ভাবে দেখাই । মেইল বা মোবাইল এর অবদান আমি অস্বীকার করি না । কিন্তু তারপর ও এটাই কি সব অনুভূতিকে ট্রানসফার করতে পারে ? ভেবে দেখুন যে কথা আপনি ফোনে বলেন – আপনার আত্মার মানুষগুলোর সাথে সেই কথা গুলো চিঠিতে বললে আরো কি রঙিন হত না আপনার অনুভূতিগুলো ? মেইলে যা যা কপি পেস্ট করছেন তার থেকে চিঠিতে লেখা আপনার নিজ হাতে লেখা দুই লাইনের অনুকাব্য কি আপনার প্রিয়জনকে আরো সাসপেন্স , আরো রোমান্টিকজম দিতে পারতো না ?

এখনও রাত জেগে ভাবতে ইচ্ছা করে কাল সকালে যদি একটা চিঠি পাই !!!

আমরা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমকে আমাদের রানার বা ডাক হরকরার সাথে যুক্ত করতে পারি কিন্তু তাই বলে বিনাশ করলে নিজের অস্তিত্বে কি একটু ঘা লাগে না ? ভেবে দেখুন আপনার সবথেকে প্রিয় বন্ধুটির কথা । হয়তো অন্য শহরে থাকে । আপনার সাথে কথা হয় না অনেকদিন । একদিন সময় করে এক পাতা লিখুন তাকে ? শালা ভূলে গেলি আমাকে >? কত স্মৃতি আমাদের । মনে পড়ে সেই কাজলা নদীর ধারের প্রাইমারি স্কুলে সারের কলা চুরি করে খেয়েছি। হাহাহ,,, কেমন আছিস ? সময় করে একদিন চিঠি দিস । তোকে নিয়ে দুই লাইনের একটা কবিতা লিখেছি —স্মৃতির চর হয় –বালুচর হয় না ।বন্ধু কখনও দূরে দূরে রয় না ।

এই কথাগুলোই দেখবেন কতটা আবেদন সৃষ্টি করে আপনার বন্ধুর মনে । আমি জানি অনেক অনেক বন্ধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। মাসে না হয় একটা করে চিঠি লিখুন তাদের । আর ডাক বিভাগের এখনও সেই দুই টাকার খামে করে ফেলে দিন ডাক বাক্সে । আবার রানারের পায়ে দৌড় আসুক । ডাক হরকরার পায়ের শব্দে কাঁপিয়ে তুলুক গ্রাম। পোস্টম্যানের সাইকেলের বেলে রমনীর তন্দ্রা ছুটুক প্রিয়জনের চিঠির প্রতীক্ষায় ।

এটা নিতান্তই একটা মানবিক আবেদন । হবে নাকি ? প্রতি মাসে অন্তত একটা ? এত সব আধুনিকতার ভীড় ঠেলে আপনাকে কি কোনদিনও দেখব ? পোস্ট অফিসের দরজায় আপনি খাম নিয়ে ফিরছেন ???

জাতিসত্তার সাথে মিশে থাকা একটা অনুভূতির কথা বললাম । ভাল লাগলে একটাবার কাজটা করে দেখবেন — কতটা আনন্দ পান । অন্তত কোন ব্লগ সাইট বা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে কতগুলো লাইক পড়ল এটা নিয়ে যতটা সাসপেন্স বা মজায় থঅকেন তার চেয়ে বেশি মজা পাবেন এ আমার বিশ্বাস না , চ্যালেঞ্জ । ভাল থাকবেন সবাই ।

রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে

রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,

রানার চলেছে, রানার !

রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।

দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার- কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।