স্পেনে মাতৃভাষা চর্চা- ফেব্রুয়ারি গেলেই যেন খেই না হারায়

সাহাদুল সুহেদ
Published : 21 Feb 2012, 06:56 AM
Updated : 21 Feb 2012, 06:56 AM

স্পেনে আমরা আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলে অপসংস্কৃতির চর্চায় লিপ্ত হচ্ছি কি-না, ভেবে দেখা দরকার। নতুবা ভবিষ্যতে এই আমাদেরকে অনেক কাঠ খোড় পোড়াতে হবে। এটা অস্বীকারের জোঁ নেই যে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্পেনে বাংলা সংস্কৃতি চর্চা কোন অংশেই কম নয়। সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া বাংলা কাগজ কমিউনিটি এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিরা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে স্পেনের শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ইংল্যান্ডের শিল্পীদের থেকেও কোন অংশে কম নয়। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো বেশ জাঁকজমকভাবেই পালন করা হয় এখানে। পাশাপাশি বৈশাখী মেলার জাঁকজমকপূর্ণ বাঙালীয়ানা আয়োজন আমাদের নতুন প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার উপলক্ষ তৈরী করে। স্পেনে বসবাসরত বাংলাদেশীদের অনেকেই ভালো গান করেন; যাঁরা দেশেও সঙ্গীত চর্চা করে এসেছেন। বাংলা গান নাচ শিখার স্কুলও চালু হয়েছে। তাই শিল্পীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। কোন অনুষ্ঠানে শিল্পীদের আধিক্যতার জন্য সময়ের অভাবে অনুষ্ঠানগুলোতে অনেককে সুযোগ দেয়াও সম্ভব হয়না বলে শিল্পীরা মনোক্ষুণœ হোন- সাংবাদিকতার খাতিরে এমনটিও আমার নজরে এসেছে। আয়োজকরা সময়ের দোহাই দেন। আসলেই কিছু করার থাকে না।

মূল প্রসঙ্গে আসি। ইদানিং স্পেনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় লক্ষ্য করছি- হিন্দি গান, নাচ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনেকাংশ জুড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশী শিল্পীদের হিন্দি গান পরিবেশনা ছাড়াও অনুষ্ঠান আয়োজকদের অনেকেই স্পেনে যারা হিন্দি গান নাচ চর্চা করছেন, তথাকথিত 'বলিউড গ্র"প' কে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন হিন্দি নাচ গান পরিবেশন করার জন্য। আমি বলি, আমাদের বাংলা জনপ্রিয় গানের কী অভাব? কিংবা শিল্পীদের অভাব? যেখানে শিল্পীদের আধিকত্যায় অনেককে সময়ের অভাব দেখিয়ে সঙ্গীত পরিবেশনে বিরত রাখা হচ্ছে। এমনকি ইংল্যান্ড থেকে পয়সা খরচ করে শিল্পী এনেও তাদেরকে সময়ের অভাবে দুই একটি গান পরিবেশন করার পর বিরত রেখে বলা হচ্ছে দু:খিত।

হিন্দি নাচ গান আমাদের সাময়িক আনন্দের খোরাক জুগালেও ভবিষ্যতে এর প্রভাব আমাদেরকে ভোগাবে। তাই আমাদের এব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হলেও অন্তত ভাবতে হবে।

এখন চলছে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্র"য়ারি। একুশে ফেব্র"য়ারি আজ কেবল বাঙ্গালী ভাষাভাষীদের জন্য বিশেষ দিন নয়; জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোও পালন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এই প্রবাসে আমরা আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে কতটুকু লালন করছি? ফেব্র"য়ারি এলেই দেখা যায়- আমরা মাতৃভাষা চর্চ্চার গুরুত্ব বাড়িয়ে ফেলি। আলোচনা সভা করি, অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরী করে পুষ্প অর্পন করে ভাষা শহীদদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাই। আবার ফেব্র"য়ারি গেলেই খেই কি হারায় না ভাষা চর্চ্চার গুরুত্ব? আমরা আবার ভুলে যাই। স্পেনে যারা নবপ্রজন্ম, যারা ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছে; তাদেরকে আমাদের মূল শিকড় মাতৃভুমি বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার কথা আমরা প্রায়ই বলি। বাংলা স্কুলও চালু হয়েছে স্পেনে, যেখানে মূল স্কুল ছুটির দিন অর্থাত শনি ও রবি বার ঐ বাংলা স্কুলগুলোতে বাংলা অক্ষরের সাথে মিশছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। মাদ্রিদে একটি ও বার্সেলোনায় আছে দুইটি বাংলা স্কুল। বার্সেলোনার একটি স্কুলেও গিয়েছি বহুবার সংবাদ সংগ্রহের জন্য। কিন্তু দেখেছি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা বাংলা শিখছে- সন্দেহ নেই; তবে যখন তারা নিজেদের মধ্যে গল্পে মত্ত থাকে- ঠিকই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। অভিভাবকরাও দেখেছি অনেক সময় তাদের সাথে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছেন। হ্যাঁ, ছোট শিশু কিশোররা যখন তাদের মূল স্কুলে যায়, সেখানে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতেই হয় বাধ্যতামূলক। সেখানে তারা স্প্যানিশ বলুক। কিন্তু স্কুলের বাইরে এমনকি ঘরেও কেন স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলবে? আমাদের অভিভাবকেরা যদি এ ব্যাপারে এখনই সচেতন না হই; তাহলে আমাদের প্রজন্ম আমাদের মাতৃভাষা চর্চ্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এবং একসময় আমাদের বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে এই প্রবাসের গড্ডালিকা প্রবাহে। সেই দিন যেন কখনো না আসে। যে ভাষার জন্য রাজপথ হয়েছে রক্তমাখা, যে ভাষার ইতিহাস রয়েছে বিশাল; সে ভাষা প্রবাসে কি হারিয়ে যাবে একটু সচেতনতার অভাবে? আমাদের মূল শিকড় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে আত্মস্থ করি, আমাদের প্রজন্মান্তরে হোক মাতৃভাষার চর্চ্চা।