বিস্তৃত হলুদ সাংবাদিকতা: অবরুদ্ধ বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

সুকান্ত পার্থিব
Published : 31 July 2011, 05:13 AM
Updated : 31 July 2011, 05:13 AM

প্রকৃত সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি ও প্রধান লক্ষ্য নিরপেক্ষ, সত্যনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপন করা। কোন সত্য ঘটনাকে মুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করে সম্যক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তথ্য প্রমাণসহ পাঠকের কাছে তুলে ধরা যেখানে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রয়োজনীয়তা একান্ত কাম্য । আসলে কি আমরা সব গণমাধ্যমে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সাক্ষর দেখতে পাচ্ছি ? নাকি হলুদ সাংবাদিকতা চর্চার মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আক্রোশ ভঙ্গিমায় অপপ্রচার চালানো হচ্ছে ? ভুমিদস্যুরা কালো টাকা সাদা করার লক্ষ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গণমানুষের সামনে মুখোশ পড়ে নিজেদের অপরাধ-কুকীর্তি ঢাকতে গনমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের শক্ত ভিতের আবাসের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করছে । প্রকৃত সাংবাদিকতা আজ কালোবাজারি কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের হাতে বন্দি হয়ে গেছে । গনমাধ্যমের মালিকদের একাধিপত্যের কারনে অনেক মিথ্যা রাতারাতি সত্যের খোলসে ঢুকে সাময়িক সত্যের রুপ ধারন করছে । নিজেদের অবস্থান টিকে রাখার লক্ষ্যে সেই কারনেই কতিপয় বিজ্ঞ সম্পাদক, অসংখ্য সিনিয়র সাংবাদিক এবং মফস্বলের বেশিরভাগ সাংবাদিক নিজেদের বিবেক অসততার জলে বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করছেন না !

এ ধরনের সাংবাদিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরন ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে নতুন প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমগুলোর হিংসা ভাবাপন্ন সংবাদে । প্রকৃত সত্য গোপন রাখার শপথ গ্রহন করে এবং মূল ঘটনাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্যে সেইসব গনমাধ্যম নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে অন্য সব বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সম্পর্কে কুৎসা রটাচ্ছে । ব্যক্তিগতভাবে কারো প্রতি আক্রমন করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের গোপন রাখার পাঁয়তারা করার মহৎ পেশার নামই কি সাংবাদিকতা ? ব্যক্তি আক্রোশ চালিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার বীজ বপন করার দায়ে ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট (হিকির গেজেট) সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান দিলেও তার কণ্ঠস্বর ১৭৮২ সালে চিরতরে রোধ হয়েছিল । এই করুন ইতিহাস জ্ঞান ও তথ্য সন্ধানী সকল সাংবাদিকের অবশ্যই জানার কথা !

গনমাধ্যম হলো এমন একটি মাধ্যম যা গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা, সমস্যা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অধিকার অর্জনের চিত্র তুলে ধরবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে । সরকার, রাজনৈতিক দল ও সমাজ ব্যবস্থার নানা অন্যায়-অনাচার-অসংগতি গঠনমূলক সমলোচনার মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে ফুটিয়ে তুলবে নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণ দ্বারা । কিন্তু, গত ২১ সেপ্টেম্বর'২০১০-এ হলুদ সাংবাদিকতা চর্চারত কিছু গণমাধ্যমের ভিত্তিহীন সংবাদকে প্রাধান্য দিয়ে কয়েকজন এম,পি, মন্ত্রি এবং স্পিকার মহোদয় মহান জাতীয় সংসদে যেভাবে প্রথম আলো, সমকাল এবং আমাদের সময় এর ঘোর মিথ্যে সমালোচনায় মুখর হয়ে তাদের সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করলেন, দেখে মনে প্রশ্ন জাগল এ দেশে কি গণতন্ত্র নতুন রূপধারণ করে ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে ? যেখানে গণমানুষের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ করা হয়, সেখানে লোক দেখানো তথাকথিত 'গণতন্ত্র' ফ্যাসিবাদ শাসন ব্যবস্থারই পূর্বাভাস দেয় । সরকার দলীয় নেতা-জনপ্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে গণমানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও প্রকাশ্যে দলীয়করণের বক্তব্য জাহির করলে গণমাধ্যমে তার প্রকৃত চিত্র খবরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললেই অপরাধ ? এই হলো আমাদের দেশে জনগনের মূল্যবান ভোটে নির্বাচিত অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কিংবা জ্ঞানপাপী জনপ্রতিনিধির অবিবেচক কর্মকান্ড ! সরকারের আধিপত্যে অবরুদ্ধ গনমাধ্যমের স্বাধীনতা ! এই ইতিহাস স্মরণ করে দেয়া অতি জরুরী যে- দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর ১৯৭৫ এর ১৬ জুন শেখ মুজিবুর রহমান 'নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স' জারি করে বাংলাদেশে চারটি সংবাদপত্র ব্যতিত সকল দৈনিক পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষনা করে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় চরম আঘাত হানেন এবং সাংবাদিকদের উপর ক্রোধের খড়গ ছুড়ে মারেন । এমন দৃষ্টান্ত কিছুটা হলেও বর্তমান মহাজোট সরকারের অদক্ষ রাজনীতিবিদ গণের বিতর্কিত বক্তব্যে ও কার্যকলাপে পরিলক্ষিত হচ্ছে !

কোন গনমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর যদি এ ধরনের ব্যক্তি আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়, তবে কিভাবে সত্য টিকে থাকবে সঠিক মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংগে নিয়ে । কালোবাজারিদের মিথ্যে প্ররোচনায়-আধিপত্যে কতকাল নির্ভীক সাংবাদিকগণ মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকবে ? সত্যকে গোপন করতে বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে কতদিন পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে এই বাংলাদেশের মাটিতে ঐ সব গনমাধ্যম টিকে থাকবে ?

প্রকৃতপক্ষে, গনমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখা দরকার গণমানুষের মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনার বিকাশ, অবস্থা এবং ব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়নের স্বপক্ষে ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আক্রোশমূলক বানোয়াট সংবাদ প্রকাশে নয় । তাহলে সেই মাধ্যম শুধু ব্যক্তিস্বার্থ সাধনের জন্যে, কখনই জনগনের মঙ্গলে ভূমিকা রাখতে পারে না । বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমগুলোর অবশ্যই সচেষ্ট ভুমিকা রাখা উচিত তরুন সমাজ ও নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে দেশাত্মবোধের প্রত্যয়ে শোষণমুক্ত, বিভেদ-বৈষম্যহীন, মৌলবাদ-জঙ্গিবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অভিপ্রায় ।

কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের মিথ্যে শৃঙ্খল ভেঙ্গে এই কলুষিত ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কলমসৈনিক সাংবাদিকদের বলিষ্ঠ হাতের সাহসী উদ্যোগ ও অমিত লেখনী শক্তিই পারে উত্তরনের পথ সম্মুখে প্রশস্ত করতে । তারাই পারে নিজেদের সত্য প্রকাশে অটল রেখে স্বচ্ছ, সৎ , বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে গড়ে তুলতে । যুগে-যুগে, কালে-কালে প্রমানিত হয়ে এসেছে সত্য চিরদিন অন্ধকারে গোপন থাকে না, সূর্যের আলো'কে সঙ্গে করে নিয়ে অবশ্যই প্রখর কিরন আলোকিত করবে বিশ্ব-ভুবন ।