আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চিরঞ্জীব দিকপাল হুমায়ুন আজাদ

সুকান্ত পার্থিব
Published : 12 August 2011, 03:20 AM
Updated : 12 August 2011, 03:20 AM

প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
রবীন্দ্র উত্তর যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাঁর অবাধ পদচারনায় নতুন ধারায় শিল্পমন্ডিত হয়েছে তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, মুক্ত বুদ্ধির জ্ঞানচর্চার অকুতোভয় পথ প্রদর্শক, আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এর দিকপাল হুমায়ুন আজাদ। যিনি একাধারে বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক, কবি, উপন্যাসিক, ভাষা বিজ্ঞানী, সমালোচক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার । যাঁর বিপুল রচনা সুসমৃদ্ধ করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে যখন এ উপমহাদেশের মানুষ মুক্তির অপেক্ষায় ঠিক তার আগমুহূর্তে ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে।
জীবনে বেড়ে উঠার সাথে সাথে যখন সত্যকে বাস্তবতার আয়নায় উপলব্ধি করতে শিখলেন ঠিক তখন থেকেই তিনি বর্জন করলেন এই তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার হাজার বছর ধরে ব্যাপকভাবে মহামারী আকারে প্রচলিত চিরাচরিত সব প্রথা ও বিশ্বাসের ভিত্তিকে। জীবন, জগত ও মানুষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন স্বাধীনচেতা ও মানবতাবাদী হিশেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে নিজের মধ্যে জন্ম দিয়েছিলেন প্রগতিমুখী মুক্ত চিন্তাধারার দর্শনের । আজীবন জ্ঞান সমুদ্রে জ্ঞানঅন্বেষনের মহৎ সাধনায় প্রবৃত্ত রেখেছেন নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে ছাত্র-যুবসমাজের মাঝে অকুন্ঠবোধে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের অত্যাধুনিক দর্শন ও চেতনাকে। সত্যকে সুন্দর ও নির্মোহভাবে বিশ্লেষন করে স্পষ্ট ভাষায় অসীম সাহসী হয়ে অসামান্য ও অনন্য মেধা এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহাপুরুষ কালের বিবর্তনে একেক সময় জ্বলে উঠেছেন একেকভাবে। রাষ্ট্র ও সমাজের পরির্বতনের দৃঢ় চেতনায় কলমকে মানুষের নায্য অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে কখনো নির্দ্বিধায় পত্রিকায় লিখে গেছেন নিবন্ধ, কখনো কবিতার মাঝে প্রকাশ করেছেন মানব জীবনের উদ্ভাসিত আবেগ-অনুভূতি-প্রয়াস, কখনো জ্বলে উঠেছেন তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ রচনায়, কখনো মুখরিত হয়েছেন গঠনমূলক সমলোচনায়। যাঁর অশেষ অনুপ্রেরণায় শত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন তিনি হলেন তাঁর পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অনন্য জ্ঞানতাপস গবেষক ও মুক্ত চিন্তা-ধারার কালজয়ী প্রগতিশীল লেখক আহমদ শরীফ।

শোষণমুক্ত, স্বনির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জাগ্রত হয়ে সমাজের মানুষের ভেতরে লুকায়িত মিথ্যাকে দূরে সরিয়ে ফেলার জন্যে নিজের মেধা-মনন-প্রজ্ঞা গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষধর্মী গবেষনায়। যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পি,এইচ,ডি অর্জনের সময় বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে রচনা করেছিলেন (প্রনোমিনালিজেশন ইন বেঙ্গলী ) নামক জ্ঞানগর্ভ অভিসন্দর্ভ। এছাড়াও বাংলা ভাষাকে সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি সম্পাদনা করেছেন বাংলা ভাষা (খন্ড ১ ও ২) এবং রচনা করেছেন বাক্যতত্ত্ব, তুলনামুলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, অর্থবিজ্ঞান, ভাষা-আন্দোলনঃ সাহিত্যিক পটভূমি, কতো নদী সরোবর বা বাংলা ভাষার জীবনী, লাল নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী, ভাষা শিক্ষা ও ভাষাবিজ্ঞান পরিচিতি (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)।

অতিসাধারনভাবে স্বল্পায়ুসম্পন্ন জীবনযাপন করে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষের সঠিকভাবে বেঁচে থাকার এবং মুক্তির উপায় অনুসন্ধানের নিমিত্তে। এ সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়, নারীকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে ব্যাপক গবেষনার ফসল হিসেবে রচনা করেছিলেন ও বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী গ্রন্থ "নারী"।

মৌলবাদী, জঙ্গি, ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাশক্তি মহল তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দেবার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণের বাইরে চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তাঁর দেহকে, অল্পের জন্যে ফিরে এসেছিলেন মৃত্যু থেকে। তাঁর উপর আঘাতের প্রতিবাদে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ ও সমগ্র বাঙালি জাতি। হায়না মৌলবাদী, ধর্মান্ধরা তাঁকে বাঁচতে দিতে চায়নি; অনন্যসাধারণ-ভিন্নধর্মী-সত্য ও বাস্তব অনুসন্ধানী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস "পাক সার জামিন সাদ বাদ" গ্রন্থ রচনার কারনে। যেখানে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের ধর্মের ক্যানভাসে অন্যায়-অনাচার-ধর্ষণ-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ এবং বাংলাদেশের অতীত-বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাস্তব চিত্র ।

দূরদর্শী জ্ঞান মনীষা ও বাস্তববাদী দর্শনের আলোকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আসলে এই বাঙালি জাতির গন্তব্য কোথায়? তাই,গন্তব্যহীন,লক্ষ্যহীন,চেতনাহীন ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করতে কলমের অমিত শক্তি দিয়ে মানুষের মগজে চিরজীবন করে গেছেন প্রচন্ড আঘাতের পর আঘাত।

নিজের সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে বিচিত্র রকমভাবে সাজিয়ে ছিলেন জীবনকে। সবসময় ছিলেন বিজ্ঞানবাদী, যুক্তিবাদী, প্রথাবিরোধী এক মহামানব যাঁর প্রদর্শিত পথে হাঁটতে পারে চেতনাশীল বিজ্ঞান-প্রগতি ও সত্যানুসন্ধানী প্রকৃত শিক্ষাভিমুখী তরুন প্রজন্ম। চারপাশের অস্থিতিশীল, বর্বর, হতাশাগ্রস্ত পরিবেশে বসবাস করেও সবার মধ্যে ও নিজের ভেতরে আশার প্রদীপ জ্বালানোর সংকল্পে অটুট ছিলেন সবসময়। প্রথাবদ্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাদমুখী সমাজ-রাষ্ট্রের বদ্ধ শিকল থেকে মানুষকে মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন করতে তাঁর রচিত যে গ্রন্থগুলো বাস্তবতার আলোকে নতুন কালের সন্ধান দিবে এর মধ্যে অন্যতম- আমার অবিশ্বাস, মহাবিশ্ব, সব কিছু নষ্টদের অধিকার যাবে, সীমাবদ্ধতার সূত্র, আমাদের শহরে একদল দেবদূত, ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল, রাজনীতিবিদগণ, সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে, আব্বুকে মনে পড়ে, (শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার), (আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম ?), প্রতিক্রিয়াশীলদের দীর্ঘ ছায়ার নিচে, হুমায়ুন আজাদের প্রবচন গুচ্ছ, হুমায়ুন আজাদ শ্রেষ্ঠ কবিতা, আততায়ীদের সাথে কথপোকপন, সাক্ষাতকার, আমার নতুন জন্ম, একুশ আমাদের অঘোষিত স্বাধীনতা দিবস (শেষের দুটি গ্রন্থ মৃত্যুর পর প্রকাশিত) ।

বুকভরা আঘাত-যন্ত্রনা সহ্য করার পরেও শুধু মানুষদের আলোকিত নতুন দিগন্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছে পোষন করেছিলেন, তবুও তাঁকে চিরবিদায় হতে হয়েছে জীবন থেকে। একুশে বই মেলায় হামলার প্রায় ছয় মাস পর ৭ আগষ্ট, ২০০৪ তথাকথিত গণতন্ত্রের রূপধারী সরকারের সূচালো ষড়যন্ত্রে তাঁকে পেন-এর আমন্ত্রনে পাঠানো হয়েছিল জার্মানীর মিউনিখ শহরে জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের উপর বৃত্তিমূলক গবেষণায়। পাঁচ দিন পর, ১২ আগষ্ট,২০০৪ (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড সময় অনুযায়ী) অপরাধচক্রের সুক্ষ চক্রান্তে অমীমাংসীত কাজ সঙ্ঘটিত হবার মাধ্যমে একনায়ক খ্যাত হিটলারের দেশে তাঁকে চিরতরে বিদায় নিতে হলো আকস্মিকভাবে। জার্মানীর মিউনিখস্থ ফ্লাটের নিজ শয়নকক্ষেই তাঁকে পাওয়া গেয়েছিল মৃত অবস্থায়। এখনো তাঁর আকস্মিক মৃত্যু প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে মুক্ত চেতনার মানুষদেরকে! ঘোরতর সন্দেহ জাগে তাঁর মৃত্যু ঐ কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের উপসংহার কি না?

বাতাসের প্রকোপে প্রদীপ নেভার আগে শেষবারের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে; মনে হয় সেই আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে চারপাশ। দেশমাতৃকার প্রতি অশেষ ভালবাসা-শ্রদ্ধায় হুমায়ুন আজাদও জ্বলে উঠতে চেয়েছিলেন পুনরায় সত্য প্রকাশে অটল থেকে অন্ধকারের কালো হাতগুলোকে চিরতরে গুড়িয়ে দিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার জন্যে বাংলাদেশের দম আটকানো, ত্রাসগ্রস্থ, বিপদগ্রস্থ পরিবেশ থেকে সরে এসে শেষবারের মতো হলেও জ্বলার চরম আকাঙ্ক্ষা হয়ত তাঁর মনে ছিল। তাই, হয়ত বৃত্তি দিয়ে তাঁকে জার্মানিতে পাঠানো ষড়যন্ত্র মনে না হয়ে; তাঁর উপলব্ধি বোধে জীবন আশ্রয়ের শেষ স্থল হিশেবেই জেগেছিল।

যাই হোক, এখনো তাঁর উপর সেই হামলার সঠিক বিচার শেষ হয়নি। অপরাধী চোখের সামনে বন্দী থেকেও বিচারের জন্যে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। যেসব ধর্মীয় ভন্ড, যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মতিউর রহমান নিজামী আরো অনেকে হুমায়ুন আজাদকে বহুবার বিভিন্ন সভা-জলসায় 'মুরতাদ' বলে আখ্যায়িত করেছে এমন কি তাঁর উপর বর্বোরচিত হামলার পর "জাতীয় সংসদ"-এ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হামলাকে সাধুবাদ জানিয়েছে, সেসবের প্রমাণ থাকা সত্বেও কেন থেমে আছে ওদের অন্যায়ের নায্য বিচার? ওদেরকে রিমান্ডে নিয়ে সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেড়িয়ে পড়বে থলের বিড়াল! কারন, এটা স্পষ্টতর সত্য যে, সর্ষের ভেতরেই ভূতকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে!

একটি স্বাধীন দেশে প্রত্যেক নাগরিকও তো অন্যায়ের সঠিক বিচার পাবার অধিকার রাখে! তাহলে, কেনই বা হুমায়ুন আজাদের মতো বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের উপর ঘৃণ্যতম, আদিম পাশবিক হামলার আক্রমণকারীদের শাস্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ?

যাই হোক, বিভিন্ন সময় হত্যার হুমকির সম্মুখীন হয়েও জীবনকালে আপসহীনভাবে সত্য ও স্পষ্ট কথা বলতে কখনো পিছপা হননি হুমায়ুন আজাদ। তাই, সত্য যতদিন বেঁচে থাকবে পৃথিবীর বুকে, ততদিন সত্যের মাঝেই আলোর দিশারী হয়ে মুক্ত চেতনার মানসলোকে বেঁচে থাকবেন বঙ্গজননীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, মহৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সুবিশাল উদার প্রানের মূর্ত প্রতীক হুমায়ুন আজাদ। যিনি নিজেই নিজের প্রকৃষ্ট উদাহরন। তাঁকে মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধ দিয়ে উপলব্ধি করে তাঁর ক্ষুরধার অজেয় শক্তিসম্পন্ন লেখনী জ্ঞানপিপাসু তরুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় সত্যানুসন্ধানী ও মানবতার কল্যাণকর পথের সন্ধান দিবে।