ইয়াঙ্গুনে কয়েকদিনঃ ৩য় পর্ব

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 25 Sept 2012, 04:49 AM
Updated : 25 Sept 2012, 04:49 AM

বৃষ্টি আপাতত বন্ধ হয়েছে, ঝকঝকে আকাশ, সোনালী রোদে চারদিক ঝিকমিক করছে, বৃষ্টি ধোয়া গাছের রঙ বেরঙের তৈলাক্ত কচি পাতাগুলো এমন চিকচিক করছে যেন এইমাত্র ওদের মা'রা ওদের গায়ে তৈল মেখে দিয়েছে, যেমন করে আমাদের গ্রাম্য মা'রা তাদের কিশোরী মেয়েদের চুলে তৈল মেখে দেয়। বাতাসটা এত হালকা যে নিঃশ্বাস নিয়েই বুঝলাম এখানে অক্সিজেন অনেক বেশী। এক নিঃশ্বাসেই অনেক বেশি বাতাস ফুসফুসে ঢুকছে যা ঢাকায় চেষ্টা করলেও পারা যাবে না। হাতের ছাতাটাকে বোঝা মনে হলো। হোটেল সিকিউরিটি গার্ডের হাতে ছাতাটা ফেরত দিয়ে, ডানদিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

হাঁটছি আর দেখছি, দোকানগুলো কিসের, তাতে কতটুকু বিক্রয়যোগ্য পণ্য আছে, কি কি পণ্য বিক্রি হয়, সেলস-ম্যান কারা, দোকানের ডেকোরেশনই বা কেমন, কাদের কাছে ওরা বিক্রি করছে, যারা বিক্রি করছে তাদের ড্রেস-আপ কেমন, খাবার দোকান গুলোতে কি কি খাবার বিক্রি হচ্ছে, মানুষ কি খাচ্ছে, কোনটা বেশি খাচ্ছে, ক্রেতারা কি ধরনের পোশাক পড়েছে, তা সস্তা না দামি। এইসব ছোট খাট তথ্যই আমাকে আমার মূল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবে।

মাঝে মাঝে পছন্দমত কোন কোন দোকানে ক্রেতা সেজে ঢুকে পড়ছি আর আমার টার্গেট প্রোডাক্টের খোঁজ করছি, পেলে দাম কত এবং তার মূল উপাদান গুলো কি কি, তা জানতে চেষ্টা করছি। আমার পণ্যের কাছাকাছি বা সমগোত্রীয় পণ্যগুলোই মূলত আমার প্রধান টার্গেট, কারণ আমাকে Price Comparison Statement বানাতে হবে।

আমি সাথে কোন নোটবুক নিয়ে আসিনি, সেক্ষেত্রে দোকানিদের কাছে আমি সন্দেহজনক মানুষ হিসেবে গণ্য হতাম এবং এত সহজে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতাম না, এই ব্যাপারে আমার অনেক ভাল, মন্দ ও মজার অভিজ্ঞতা আছে, তাই যতদূর সম্ভব সংগ্রহীত তথ্য গুলো মনে রাখার চেষ্টা করছি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, এতক্ষণ দুরের এক বড় প্যাগোডার চূড়াকে সামনে রেখে হাঁটছিলাম এবার ওটাকে পিছনে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তা ক্রস করতে যেয়ে দুইবার সাক্ষাৎ মৃত্যুদ্যুতরুপী গাড়িগুলোকে দেখতে দেখতে হোটেল ফিরে আসলাম। এই দুইবার আমি ভুল করে আমার অভ্যাস মত বামদিকে তাকিয়ে ছোট গলি রাস্তা ক্রস করতে শুরু করেছিলাম কিন্তু এই দেশে গাড়ী আমাদের চিন্তার উল্টো চলে অর্থাৎ ডানদিকে।

অচেনা দেশে যদি আপনি রাস্তা হারিয়ে ফেলেন আর সে দেশে যদি কেউ ইংরেজি না বোজে, তাহলে টের পাবেন ঠ্যালা কারে কয়! এরসাথে যদি হোটেলের কার্ডটি হারিয়ে ফেলেন এবং এর নামটিও যদি ভুলে যেয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হবে আপনার কপাল আসলেই মন্দ, আপনার কান্না শুধুই লোক হাসাবে কিন্তু কোন উপকারে আসবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ হবে আপনার প্রধান সহায়ক।

বাংলাদেশী, যারা এই দেশে ব্যবসা করার চিন্তা করছেন বা অলরেডি কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন তাদের জন্য ছোট একটা কথা বলি, যা আপনি বা আপনারা মনে রাখতে পারেন বা নাও রাখতে পারেন, এই ব্যাপারে আপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কথাটা হল, যদি আপনার মনে মানুষ ঠকানোর কোন ধান্দা থেকে থাকে, যা আপনি নিজ দেশে হরদম বিনা বাধায় প্রাকটিস করছেন, তাহলে এটা আপনার মন থেকে বাদ দেন। আবার যদি আপনি বেঈমানিটাকে রক্তের সাথে মেশাতে মেশাতে একেবারে DNA তে ঢুকিয়ে ফেলেছেন, তাহলে আপনাকে বলবো, ব্যবসার জন্য বাংলাদেশই আপনার জন্য স্বর্গ আর এদেশ হবে নরক।

চীন-থাইল্যান্ড ব্যতীত বিদেশীদের জন্য এদেশের ব্যবসা কেবলমাত্র উন্মুক্ত করতে শুরু করেছে এই দেশের সরকার, গত প্রায় ৪৪-৪৫ বছরের সামরিক শাসনে এই দেশের ব্যাক্তি উদ্যোগে ব্যবসা খুব বেশি অগ্রসর হয়নি, হয়নি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার তেমন কোন উন্নয়ন, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ফলে ব্যবসায় চিনাদের একছত্র আধিপত্য, সামান্য কিছু ভাগ পাচ্ছে থাইল্যান্ডের ও ভারতীয় ব্যবসায়ীগণ।

শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের পারমিশন এখনো হয়নি, আপনাকে ব্যবসা করার জন্য এদেশের কোন নাগরিককে ব্যবসার পার্টনার হিসেবে নিতে হবে বা অন্য কোন স্বীকৃত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, এই ব্যাপারটা এখনো আমি সম্পূর্ণ জানি না। তবে যেটুকু জেনেছি বা বুঝেছি, পার্টনার বা ক্রেতা ঠকানোর শাস্তি অনেক কঠোর, অপরাধ করে ধরা পড়ার পর আপনার কপাল খুব বেশী ভাল হলে আপনি হয়ত বড়জোর ঘণ্টা খানেকের নোটিশ বা সময় পাবেন এক কাপড়ে এই দেশ ত্যাগ করার জন্য। আর কিভাবে এটা করবেন তা নির্ভর করছে সম্পূর্ণই আপনার উপর।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যদি আপনি দোকানে কোন ক্রেতা নিয়ে যান এবং সেই ক্রেতা যদি কিছু কেনে তাহলে বিক্রিত মূল্য থেকে আপনি একটা ভাগ পাবেন, যদি সামনা-সামনি নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন বা ইশারা করেন, তাহলে দোকানি আপনাকে তা পৌঁছে দিবে। পণ্যটি বাকিতে বিক্রি হলেও আপনার প্রাপ্য আপনি পাবেন। সেক্ষেত্রে দোকানি বাকী টাকা পেল কি পেল না তা বিবেচ্য না। আমি নিচ্ছিত, আমরা, বাংলাদেশি'রা এখানেই ভুলটা করবো, ফলে একটা কম্পপ্লেইন জমা হবে, তারপর যা ঘটার তাই ঘটবে। স্বার্থপরতা আমাদের এমন ভাবে গ্রাস করেছে যে ভাগ করে খেতে আমরা একেবারেই ভুলে গেছি।

বিকালে কাজ শেষে হোটেলে ফিরে বিছানায় শুয়ে আছি। হটাৎ ইন্টার-কম সেটটি বেজে উঠলো, হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে পরিচিত গলায় ভেসে আসলো "মিংলাবা", সুকান্ত রুমে আসো! বললাম, আসছি স্যার! "মিংলাবা" শব্দের অর্থ হল স্বাগতম বা হ্যালো। আমার সিনিয়র কলিগের রুমে যেতেই দেখলাম উনিসহ আর এক জুনিয়র কলিগ ইফতার সাজিয়ে বসে আছেন। রুমে ঢুকতেই মজা করে বললেন, ভাবী তোমার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করে পাঠিয়েছেন, আসো এক সাথে ইফতার করি। একটু রুম থেকে ঘুরে আসি, বলেই রুমে চলে এলাম। আসার সময় ট্রলি ব্যাগটা অনেকটুকু খালি ছিল বলে, তা বোঝাই করে চানাচুর, মুড়ি নিয়ে এসেছিলাম। এবার ওগুলো ব্যবহারের সঠিক জায়গা পাওয়া গেছে ভেবে প্যাকেটগুলো নিয়ে এসে ইফতার পার্টিতে জয়েন করলাম। টেবিলে বসেই দেখলাম, প্রচুর ইফতার আইটেমের আয়োজন, জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, এই বিদেশ ভুঁইয়ে এই আয়োজন কে করলো, স্যার বললেন, পলাশ ভাইয়ের বাসা থেকে এসেছে, ভাবী বানিয়েছে। বললাম আহা! মনে হচ্ছে দেশে আছি। প্লাস্টিকের বাটি বোঝাই ভাজা ইলিশ মাছের বড় বড় টুকরোগুলো দেখে চোখ চকচক করে উঠলো।
আসার সময়ই জেনে এসেছিলাম ইরাবতী নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে, এর মধ্যে বড় সাইজেরই বেশী, দুই কেজি ওজনেরও বেশী ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে এই নদীতে! আসার পর মামুন ভাইকে জিজ্ঞাসা করে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলাম। এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

গত কয়েক বছর ধরেই ইরাবতী নদীতে ইলিশ মাছ আসাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং সেটা ক্রমাগত বাড়ছে। আর অন্যদিকে, ওদের আগমনের অভাবে আমাদের এপার-ওপার বাংলায় যে ঘরে ঘরে অশান্তি! জামাই আদরে কমতি দেখা দিয়েছে, আমদানি রফতানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, গঙ্গা-তিস্তায় জলের স্রোত বৃদ্ধির বৈঠক পর্যন্ত ঠিকমত হচ্ছে না।

ওদের না খেতে পেরে আমাদের অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। অন্যসব মাছের দাম গেছে বেড়ে, আর ওদের মৃতদেহের দাম? সে তো ইতিমধ্যেই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে, আঁচিরেই সেটা উচ্চ বিত্তেরও নাগালের বাইরে যাবে, আর এই নিয়ে আমরা আমজনতা মহা চিন্তিত। নিজেদের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের প্রাণপ্রিয় উচ্চবিত্তরাও যদি এটা না খেতে পারে তাহলে, কি হবে?

হটাৎ করেই আমাদের গৃহপালিত মাছগুলো এইদিকে আসার কারণ কি, প্রশ্নটা আমার মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল। পরে নিজে নিজেই এর একটা ব্যাখ্যা দাড় করেছি:

আচ্ছা ধরুন, আপনার স্ত্রী সন্তানপ্রসবভা, স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, আপনাদের সন্তানের জন্ম হবে সুন্দরবনে এবং এর জন্য আপনারা পরিবারের সবাই মিলে একমাস আগেই রয়েল বেঙ্গলের ডেরায় আস্তানা গাড়লেন! এটা করবেন? না আমি নিজে করবো? আমাদের উত্তর হবে একটাই, সেটা হল "না"। কেন ভয় করে? কার ভয়? রয়েল বেঙ্গল টাইগারের? কেন তারা মানুষ খেকো বলে? আপনি কি খেকো? উত্তর দিতে পারছেন না? তাই না? আমি দিচ্ছি।

আমরা কেন ভাবছি প্রতিবছর মা ইলিশগুলো মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাদের প্রিয় সন্তানদের জন্ম দেওয়ার জন্য এদেশে আসবে আর সপরিবারে আত্যহুতি দিবে। কেনই বা তারা মানুষরূপী ইলিশ খেকোদের খাবার হবে?

আমরা কি একবারও ভেবেছি, এই ইলিশ গুলো শুধুমাত্র সন্তান জম্ম দেওয়ার জন্যই হাজার হাজার মাইল বিপদ সংকুল মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমাদের গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় আসছে। আর আমরা এই সুযোগে আঁতুড় ঘরে ওদের হত্যা করে, ঝোলে খাব না ভেজে খাব, শর্ষেতে খাব না সবজিতে খাব এই ভেবে সময় পার করছি।

আমরা কখনই এটা ভাবিনি, ভবিষ্যতেও ভাববোনা নিশ্চিত। তাই বলে কি ওরা নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাববেনা? তারা ভাবতে শুরু করেছে, আর তাইতো ইরবতীতে ওরা ওদের নতুন আঁতুড় ঘর খুঁজে নিয়েছে যা অনেকটাই নিরাপদ। আমাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া অভিজ্ঞ বড় ইলিশ গুলো আর এমুখো হচ্ছে না। কারণ আর যাই হোক, বর্মিরা বাঙ্গালীদের মত ইলিশ খেকো জাতি না।
অসমাপ্ত
ইয়াঙ্গুনে কয়েকদিনঃ ২য় পর্ব