আসামের বাঁশ দই ও রাস্তা দর্শন

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 15 Jan 2015, 06:42 PM
Updated : 15 Jan 2015, 06:42 PM

এশিয়ান হাইওয়ের নব নির্মিত রাস্তা দিয়ে আমি, ওয়াইস আর নিজাম ভাই আমাদের ভাড়া করা মেরুন রঙা বলেরো জিপ নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছি গোহাটি থেকে নওগাঁও'র দিকে। উদ্দেশ্য খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছে বাজার সার্ভে করা। আমাদের তাড়াহুড়া করার একটা কারণ ছিল; আর সেটা হল- আমরা আমাদের কাজ দ্রুত শেষ করে আজ রাতের মধ্যেই নেমে যাবো বরাক ভ্যালির দিকে। আমাকে যে দেশে ফেরার তাড়ায় পেয়েছে; প্রায় দশদিন ধরে আমি ভারতের এই অঞ্চলে ঘুরছি। অফিসের জন্য টেনশন হচ্ছে।

ওয়াইস আর নিজাম ভাই যদিও এই এলাকারই মানুষ; তবুও ওয়াইস খুবই বিচলিত ছিল আমাদের এই যাত্রাপথ নিয়ে কারণ কিছুদিন আগেই বড়োল্যান্ডের বড়োরা একটা বড় ধরনের দাঙ্গা করেছিল তাদের এলাকা থেকে বাঙ্গালী হটাতে; বয়েছিল রক্ত গঙ্গা! আর আমাদের যাত্রাপথও সেই জঙ্গলময় পথ দিয়েই। ওয়াইস বারবার বলছিল, দাদা চলেন আজ রাতটা কাজিরাঙ্গা থেকে যাই; তাতে করে আপনার বনটাও দেখা হবে আবার রাতে চলাচলের ঝুঁকি থেকেও বাঁচবো। কিন্তু আমি মত দিলাম না; ওরা চিন্তিত হলে কি হবে আমি আছি ভ্রমণের মেজাজে- কলা বেচার সাথে সাথে রথ দেখাও যে হচ্ছে আমার।

ছুটছি! দুই পাশে প্রায় ছয় লেন করে রাস্তা তৈরি হচ্ছে মাঝখানে আছে চওড়া আইল্যান্ড। সেখানে বসেছে বিল থেকে শেষ বেলায় মেরে আনা মাছের বাজার। চিতল আর কাতল মাছের চেহারা দেখে পরিচিত মনে হলো, মনে মনে বলে উঠলাম, আরে! এ যে দেখি আমাদের দেশি মাছ?
পট করে ড্রাইভারকে ব্রেক কষতে বলেই নেমে পড়লাম গাড়ী থেকে। আমার দামাদামি প্রিয় বাঙ্গালী চরিত্রটা জেগে উঠলো।
 


ওয়াইসও আমার সাথে শুরু করলো ছবি তুলতে-


পটাপট আদিবাসী ছোট দোকানীটা সহ মাছের কয়েকটা ছবি তুললাম।


ফিরবো বলে যেই গাড়ির দরজায় হাত দিয়েছি, অমনি ছেলেটা অহমিয়া ভাষায় বলে উঠলো টাকা দাও! আমি বললাম, কেন? সে বললো, দাম জিজ্ঞাসা করেছো তাই তোমাকে টাকা দিতে হবে; বলেই ছেলেটি তার আশেপাশের বড়দের ডাকতে চেষ্টা করলো। ওয়াইস দ্রুত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, আচ্ছা আমি টাকা দিচ্ছি; বলেই সে তার মানিব্যাগে হাত দিলো আর আমাকে চোখ টিপে ইশারা করলো গাড়িতে দ্রুত উঠে পড়তে। আমাদের ড্রাইভার বিষয়টা আগেই বুঝতে পেরে সে ইতিমধ্যেই গাড়ীতে স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। আমি সামনের সীটে বসে যাওয়ার সাথে নিজাম ভাইও গাড়িতে উঠে পড়েছে ড্রাইভারের পিছনে ডান দিকের দরজা খুলে। ওয়াইস 'টাকা দিচ্ছি' ভাব নিতে নিতে গাড়ীতে আমার পিছনে বসতেই ড্রাইভার গাড়ীর ছুটাতে শুরু করলো; আমরা প্রায় চম্পট দিলাম। ওয়াইস কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দাদা পড়েছিলাম আজ বিপদে আর একটু হলেই! ওরা বাঙালীদের একদম পছন্দ করে না! আমাদের সাথে একটা ক্যাচাল বাঁধাতো আজ নিশ্চিত!

কিছুক্ষণ পরেই ওয়াইসের ফোনে কেউ একজন ফোন করে জানিয়ে দিলো; আমরা যেন কিছুতেই আজ রাতে আমাদের পরিকল্পিত পথে না যাই। সেখানে বিপদের সবম্ভবনা আছে। শুনে আমিও আর বাগড়া দিলাম না; আজকের মত নওগাঁও হয়ে আবারো গোহাটিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অতএব আজকের জন্য অনেকখানি সময় হাতে পেলাম।

এবার রাস্তার দোকান গুলো দেখায় মন দিলাম। প্রথমেই বাঁশের তৈরী আসামের তৈজসপত্রের দোকানের প্রতি নজর পড়লো আমার; নেমে পড়ালাম আবারো। কথায় আছে কয়লা ধুলে ময়লা যায় না; আমারো বাঙ্গালী চরিত্রের কোন পরিবর্তন হলো না; অথচ একটু আগেই ধাওয়া খেয়ে এসেছি। আবারো দামাদামি শুরু করলাম।


তারপর দেখলাম ডাবের অভিনব ডিসপ্লে। আবারো সেই দরদাম; তবে এবার দল বেঁধে ডাবের জল আর তার নরম শ্বাস খেলায়। দাম বাংলাদেশের মতই। স্বাদও একই!


ডাব খেতে খেতেই আমার নজর পড়লো বাঁশের ঝোলানো চোঙ্গা গুলোর দিকে। আমি দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কি? সে বলল, বাঁশ দই! আমি বললাম, সেটা আবার কি? খাওয়া যায়? কি দুধের? দেখি?

দোকানি দেখাতে শুরু করলো- এটা হলো বাঁশ দই, মহিষের দুধের তৈরী। মাখনে ভরা।


এটা হলো দইয়ের পরিচিতি আর বিজ্ঞাপন; একদম চন্ডী পাঠের স্লোক তুলে ধরেছে। অতএব এর খাঁটিত্ব নিয়ে চিন্তা করাও পাপ!


এটা হলো বাঁশ দইয়ের ডিসপ্লে। ঝুলন্ত! ফাঁসি বলে কারো ভ্রম হতে পারে!


এই হলো বাঁশ দইয়ের খাঁটি রুপ! খাবেন? নাকি না খেয়ে পস্তাবেন?


খাবেন? দোকানী প্রশ্ন করলে আমি ওয়াইসের মুখের দিকে চাইলাম। ও বলল, আমরা এখন এক জায়গায় যাচ্ছি ফিরতি পথে নেমে খাবো। দোকানী আমাদের বিশ্বাস করে মেনে নিলো আর আবারো বাঙালিদের কাছে ঠকলো। বাঙ্গালীদের উপর আদিবাসী অহমীয় ও বোড়োদের রাগের এটা প্রধান কারণ। আমরা বাঙালীরা সৎ ও নিরীহ মানুষ ঠকাতে ওস্তাদ!

নওগাঁও পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। দ্রুত বাজারটা ঘুরে দেখালাম। আমাদের পন্যের পটেনশিয়ালটির খোঁজ খবর নিলাম। কথা বললাম আমাদের ডিলারদের সাথে।


একটু ঘুরেই বুঝলাম, এই শহরে বাংলাদেশের মানুষই বেশী। এমনকি ঢাকাপট্টিও আছে। আমি যাদের সাথে কথা বললাম, তারা অবশেষে আমার কাছে স্বীকার করলো যে তারা বিক্রমপুরের মানুষ।


রাস্তায় শিবের নামে ছেড়ে দেওয়া ষাঁড় গুলো ঘুরছে। যেখানে সেখানে থাকছে। অবাধ বিচরণ সব জায়গায় এদের। হিন্দু সমাজে এরা পূজনীয়।


শহরটা আর দশটা সাধারণ পৌর শহরের মতই। হাউকাউ আর ঘিঞ্জি। বাঙালি যেখানে আছে সেখানে এগুলো থাকবেই!


ঘুরলাম জানুয়ারি ২০১৩ তে আর লিখলাম জানুয়ারি ২০১৫ তে! খারাপ না !!!

১৬/০১/২০১৫ রাতঃ ১২.১৫