ক্রিকেট, উন্মাদনা ও হেইট স্পিচ

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 24 March 2016, 01:22 PM
Updated : 24 March 2016, 01:22 PM

বনশ্রীর সেই বাচ্চা দুটো কিন্তু খারাপ ছাত্র ছিল না। বাংলাদেশের সবচেয়ে নামীদামী স্কুলে ভাল রেজাল্টই তারা করছিলো। কিন্তু তাদের মায়ের তা পোষালো না। তার চাই আরও ভাল রেজাল্ট, সবার চেয়ে ভাল, ফার্স্ট হতে হবে; তবেই না তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হবে।  মা অপেক্ষায় থাকলো কিছুদিন খেয়াল রাখলো, যখন বুঝতে পারলো যে তার আদরের বাচ্চাদুটো তার সেই কাঙ্ক্ষিত 'ফার্স্ট ক্লাস' রেজাল্ট করতে পারছে না; তখনই সে তাদের গলাটিপে মেরে ফেললো।

আবাহনী-মোহামেডানের নামে সে কি যাদু! বাংলাদেশের ফুটবল মানেই তাদের খেলা। গ্রামেগঞ্জে এই নামে অনেক ফুটবল ক্লাব গড়ে উঠতে থাকলো। দেশের খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের খেলার মানেও উন্নতি হলো। কিন্তু তাতে আমাদের পোষালো না।  আমরা চাইলাম শুধু নিজের দলের জয়! একদল বললো আমাদের আসলামই শুধু গোল দিবে আর কেউ না।  অন্যদল বলল, কেন আমাদের সাব্বির কি করেছে, সেই শুধু গোল দিবে, আয়! পারলে ঠেকা? শুনেই অন্যদল দিলো সাব্বিরের পা ভেঙ্গে।  অপরদিকে আমরা আমজনতা প্রথম প্রথম খেলা শেষে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়েই দুদলে ভাগ হয়ে মারামারি করলাম।  তারপর খেলা শেষে স্টেডিয়ামেই ইটাইটি করলাম।  তারপর আরও একটু এগিয়ে খেলা চলাকালীন সময়েই করলাম কিলাকিলি।  সবশেষে খেলা শুরুর আগেই রায়ট করে আমরা ফুটবল খেলাটাকেই মেরে কফিনে ভরে কাঁধে নিলাম।

বাংলাদেশে ক্রিকেট মানেই এখন উম্মাদনা।  সেই উন্মাদনা এতই তীব্র যে এখন আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছি।  পান থেকে চুন খসলেই তা নিয়ে চিল্লাপাল্লা, গালাগাল করছি।  শুধু তাই নয়- আমরা খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের সমর্থকদেরও একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিচ্ছি।  মাইরি বলছি- হ্যাভি চার্ম পাচ্ছি এগুলো করে! অথচ ভাবছি না দুই-তিন বছর আগেও আমরা যা খেলেছি, যে কয়টা ম্যাচ জিতেছি- এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচ আমাদের টিম জিতে চলেছে।  অগের চেয়ে অনেক বেশি নতুন নতুন খেলোয়াড় দলে এসে পারফর্ম করছে, টিমকে জেতাচ্ছে।  না, এতেও আমাদের চলছে না! আমাদের প্রতি ম্যচেই জয় চাই! মাশরাফি কেন এটা করলো, মাহমুদুল্লাহ কেন এভাবে খেললো? সৌম্য-শুভাগতকে দলে নিয়েছে কেডা? বলে বলে হেইট স্পিচের বর্ষণ ঘটাচ্ছি।  শুধু কি তাই, এই হেইট স্পিচ এখন এতই মাত্রাছাড়া হয়ে গেছে যে, এখন বাংলাদেশের খেলা হবে শুনলেই মনে মনে আতঙ্কিত থাকি- এই বোধহয় কেউ গালি দিলো! গতরাতে আমার এক বন্ধু হঠাৎ করেই আমার ফেসবুকে কমেন্ট করে সেখান জুড়ে দিল 'দাদা'! কমেন্টটা দেখামাত্র আমি বুঝে গেলাম আমি গালি খেলাম।  অথচ আমি ক্রিকেট থেকে নিজেকে যতদূর সম্ভব দূরে রেখেছি। সেই সময়টাতে রাত জেগে আমরা দুই কলিগ এই দূরদেশ থেকেও নেটে দেশের খেলা দেখছিলাম।

মনে মনে বললাম, হায়রে ক্রিকেট! নিজের ফেবুওয়ালে কিছু না লিখেও যদি আমার মত ফ্যানকে নিজের মানুষের কাছ থেকেই হেইট স্পিচের সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে সত্যিই আমাদের ক্রিকেটের সামনে দুর্গতি আছে!

মায়ের অতি ভালবাসায় তার দুই সন্তান খুন হয়েছে।  সমর্থকদের অতি সমর্থনে আমাদের ফুটবল গেছে।  না জানি আমাদের অতি উন্মাদনায় এবার ক্রিকেট যায়?

২৪/০৩/২০১৬