প্রধান বিচারপতি, আওয়ামী লীগ ও নেতৃত্বের দ্বিমুখীতা

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 13 August 2017, 07:32 AM
Updated : 13 August 2017, 07:32 AM

একঃ

আমাদের দুর্ভাগ্য হলো নেতাদের দ্বিমুখীতার স্বভাব। আজ যারা সংবিধানের "ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়" বহালের রায়ের সমালোচনা করছেন, তারাই একদিন ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে আজ যারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন, তারা কিন্তু এখনো পর্যন্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে মেনে নেন নি। আবার দেখুন না, যে বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় দিলেন, তিনিই আবার ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণার রায়ে প্রধান বিচারপতির লেখা পর্যবেক্ষণের বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে নেমেছেন।

আমি পত্রপত্রিকায় এই বিষয়ে যতটুকু পড়েছি, তাতে কোথাও দেখিনি, প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, "একজন ব্যক্তি দ্বারা এদেশ স্বাধীন হয়নি।" এটা বলে তিনি ভুলটা কী করেছেন? এদেশ কি একজনের দ্বারা স্বাধীন হয়েছে? যতদূর জানি- আমাদের সংবিধানেও লেখা আছে, "একটা গণযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয়েছে।" তাহলে তিনি ভুলটা কোথায় করলেন? আসলে ভুল তিনি করেন নাই। এটা আমরা যেমন জানি, যারা প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করছেন, তারাও সেটা জানেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুও কোনদিন বলেননি বা কোথাও লেখেননি যে, তিনি একাই এদেশ স্বাধীন করেছেন!

তাহলে হটাৎ করেই এই কথা বলছে কারা? উত্তরে আমিই বলি, বলছে আওয়ামীলীগের নব্য চামুচেরা আর কাউয়ার দল। সাথে আছে- সবসময় হাঙ্গামা বাঁধানোর কিছু নেতা। এদের মধ্যে কারো কারো বাবা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, আওয়ামীলীগের সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারসহ তাদের এলাকায় বসবাসরত হিন্দুদের বাড়ী-ঘর লুট করেছে, হত্যা-ধর্ষণ করেছে। এমনকি এদের অনেকেই আত্মীয়ের সূত্রে দলে বড় পদ ও মন্ত্রীত্ব লাভ করলেও, এদের নামেও যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগ আছে। আজ ক্ষমতায় থাকার কারণে এরা আইনের হাত থেকে বেঁচে বড় বড় লম্ফঝম্ফ দিচ্ছে। আশাকরি, কোন নিকট ভবিষ্যতে এদেরও ট্রাইব্যুনালে আনা হবে। কার্যকর করা হবে 'পেন্ডিং' বিচার। আমরা এও দেখেছি- কীভাবে এদের কোন একজন মন্ত্রীর পদ বাগাতে, ছেলের বউকে বিদেশ থেকে ডেকে এনে, তাকে ব্যবহার করে সরকার তথা দলীয়প্রধানকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী সংবাদপত্র আর টিভির খবরের ভিডিও ঘাটলেই সেই সত্য পাওয়া যাবে। আবার এদেরই মেয়ের জামাই শিবিরের সাবেক নেতা হওয়া সত্যেও আওয়ামীলীগের এমপিও হয়েছেন।

আমরা যারা ছোটবেলা থেকে একটা "আওয়ামীলীগ ও বঙ্গবন্ধু ভাবাদর্শের" পরিবারে বড় হয়েছি- তাদের হয়েছে বিপদ। দেশকে, দলকে আর বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে আছি বিপদে। তাই সুবোধদের এখন পালিয়ে যাওয়ার সময় কারণ দেশটা আর তাদেরকে চায় না!

এদেশে থাকবে শুধু হাইব্রিড কাউয়ারা! এরাই যে এখন মুক্তিযোদ্ধা? আর প্রধান বিচারপতিরা হচ্ছে- এদের ভাষায় 'রাজাকার'!

দুইঃ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগের কিছু অসুবিধাজনক ফ্যাক্টর আছে, আছে কিছু সুবিধাজনক ফ্যাক্টরও। বলা যায়, আওয়ামীলীগের অসুবিধাগুলোই, কখনো কখনো দলটির জন্য সুবিধা বয়ে নিয়ে আসে। এই যেমন, "ষড়যন্ত্র ফ্যাক্টর"। হ্যাঁ! জন্মলগ্ন থেকেই এই দলকে বড় বড় ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন আছে- ১৯৭১ সালে আলোচনায় থাকা সত্যেও ২৫ শে মার্চের পাকিস্তানী সেনাদের হামলে পড়া, আছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, আছে ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট, আছে ২০১৩ সালের ৫ই মের হেফাজতের অবস্থান ও তত পরবর্তী নানাধরণের রিউমার। এছাড়াও আছে বিএনপি'র হাওয়া ভবনের নানা উৎপাত। দেশী-বিদেশী নানা চাপ তো আছেই।

এসব কারণে আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব যেমন এক ধরণের আতংকের মধ্যে থাকে, তেমনি আওয়ামীলীগের বিরোধী জোটগুলো এগুলোকে ব্যবহার করে তাদেরকে ভয়ও দেখায়! এই যেমন, আপনি যদি ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্টের ঘটনা ঘটার আগের কয়েক মাসের পত্রিকাগুলো পড়তে থাকেন, তাহলে সেগুলিতে দেখতে পাবেন বিএনপি-জামাতের বড় বড় নেতা-মন্ত্রীরা "আরও একটা ১৫ আগস্ট ঘটানো হবে"- বলে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। শুধু মুখে নয় তারা কিন্তু ২১শে আগস্টে সেটা করেও দেখিয়েছিল! স্রেফ ভাগ্যের জোরে সেদিন শেখ হাসিনা এবং আওয়ালীগের মূল নেতৃত্ব বেঁচে গিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তো প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, "আওয়ামীলীগকে আগামী ৫০ বছরেও ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না!"

আবার এগুলিকেই আমি আওয়ামীলীগের 'সুবিধা' বলছি! এই কারণে যে, এই দল যখনই নিজেদের ভুলে বিপদে পরে, তখনই এরা সমস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে, "ষড়যন্ত্র! সব ষড়যন্ত্র!" এই এখন যেমন বলা হচ্ছে, "আদালত তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।" এটা বলে তারা মাননীয় প্রধান বিচারপতির দিকে আঙ্গুলও তুলছেন।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এই দল, সব সময় তাদের বন্ধু বাছতে ভুল করে। এরা একদিকে যেমন শত্রু মোশতাককে অন্দরমহলে আদর করে পান বানিয়ে খাওয়ায়, অপরদিকে তেমনি তাজউদ্দীন সাহেবের মত ত্যাগী ও বিশ্বস্ত নেতাকে বিনা অপরাধে দল থেকে বের করে দেয়। একদিকে এরা যেমন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, আপনার সৈন্য কবে ফেরত আনবেন? অপরদিকে, কুখ্যাত ভুটোকে 'ভাই' বলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আবার এরাই মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যকে অবজ্ঞা করে হেনরি কিসিঞ্জারকে ডেকে এনে সেধে "তলাবিহীন ঝুড়ির" অপবাদও নেয়!

তিনঃ

আমার ছোট জ্ঞানে যতটুকু জানি। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন, এই ভূমির সবচেয়ে যোগ্য ও জনদরদী এক মহান নেতা। তিনি তার সবথেকে বেশী সমালোচনাকারী নেতাদেরও আশেপাশে রাখতেন। কারও কথায় তিনি কোনদিন কিছু মনে করেছেন বলে এখনও শুনিনি। অথচ তার দলের নেতা দূরের থাক, সামান্য গ্রামের এক নেতার ছেলের সমালোচনা করতেও মানুষ এখন দুইবার ভাবে। আর আমরা যারা অনলাইনে টুকটাক লিখি- তারা থাকি ৫৭ ধারায় লাল দালানে ঢোকার আতংকে। এই রকম ভয়ের পরিবেশ যেমন দেশের জন্য ভাল না, তেমনি ভাল না আওয়ামীলীগের জন্যও। এই দলকে বুঝতে হবে, প্রতিটা মানুষেরই ভুলত্রুটি থাকবে, থাকবে সেসবের সমালোচনাও। আর সেইভাবেই এগিয়ে নিতে হবে দলকে; নইলে সামনে ঘোর দুর্দিন।

আওয়ামীলীগের মূল নেতৃত্বকে বুঝতে হবে। শুধু শুধু নিজের আপন লোকদের ক্ষতি করে বা তাদের মন ভেঙ্গে দিয়ে দলের কোন লাভ হবে না। এতে লাভ হবে তাদের, যারা চামুচগিরি করতে দলে এসেছে, কাউয়া হয়ে দলে ঢুকে আখের গোছাচ্ছে। আবারও যদি দল বিপদে পরে, তাহলে দেখা যাবে- এই চামুচ আর কাউয়ারাই সবার আগে পগার পার হয়েছে। আর মাইর খেয়ে তক্তা হচ্ছে তারাই, যারা এই দলকে সত্যিকার অর্থে ভালবেসেছে।

সবশেষে বলবো, এখন সরকারের কাজ হলো- মাননীয় আদালত কেন এত কড়া কড়া কথা বললেন, তার উৎস খুঁজে বের করে সেগুলোর প্রতিকার করা। বিশ্বাস করতে হবে, প্রধান বিচারপতি রায়ে যা লিখেছেন, তা এদেশের কোটি কোটি মানুষের মনের কথা। এটা বুঝলে ভাল, না বুঝলে এর ফল ভবিষ্যতের হাতে তোলা থাকলো। বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, তিনিও রাজনীতিতে ভুল করেছিলেন।

তাই নিজেদের নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য লম্ফ-ঝম্ফ সবসময় ভাল ফল দেয় না! কখনো কখনো উল্টো ফলও আনয়ন করে, ভাইয়েরা।

১২/০৮/২০১৭