রোহিঙ্গা সঙ্কটে ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ কারা?

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 4 March 2018, 01:35 AM
Updated : 4 March 2018, 01:35 AM

২০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ- ৮ পর্বে নীচের লাইনগুলো লিখেছিলাম! এই লাইনগুলো এই তারিখের পোস্টে দিয়ে রাখলেও- মূলত লিখেছিলাম আরও আগে আমাদের এই ব্লগেরই কোন একজন ব্লগারের পোস্টে কমেন্ট আকারে। যেহেতু আমি প্রচুর কমেন্ট করি, তাই ঠিক করে বলতে পারছি না সেটা কার পোস্টে লিখেছিলাম এবং কত তারিখে?

হোয়াইট হাউসে বসেছে পুতিনের নোমিনি
যেমন করে গর্ভাচেভ বসেছিলো একদা ক্রেমলিনে!
এরদোগান বুঝতে পারছেনা কে তার বন্ধু, কোনদিকে যাবে সে?
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে, বাংলা-বার্মা সীমান্তে নতুন উপদ্রপ।
বাংলার একদা সংখ্যাগুরুরা বিলুপ্তির আশংকায় ভুগছে!
এসব ভেবে বললাম, হাইবারনেশনে যাবো!
তুমি বললে, কেন, কেন?
আমি বললাম, তোমার এই কেন কেনই, আমার উত্তর!

তখনো মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের এভাবে তাড়াতে শুরু করেনি বা ঘটনা এমন হবে সেটা কেউই ধারণা করেনি। কিন্তু আমার অবচেতন মন বলছিল- কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কেন মনে হয়েছিল- তা আমি জানি না! হয়ত সেটা প্রচুর খবর পড়ার কারণে হতে পারে। অথবা এই অঞ্চলে যেহেতু আমি বিজনেস ডেভেলপ নিয়ে কাজ করি তাই কিছু কিছু তখ্য আমি পাই- যা একটার সাথে অন্যটা মিলিয়ে দেখেছিলাম; ফলে মনে এর একটা চিত্র দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

আমি ২০১১ সালে মন্ডু দিয়ে মিয়ানমার যেতে চেয়েছিলাম। তারই পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমি টেকনাফ ল্যান্ডপোর্টে আমার বস ও আমাদের সেই সময়ের সিএন্ডএফ এজেন্টকে নিয়ে একটা সার্ভেও করেছিলাম। লক্ষ্য ছিল বাই-ল্যান্ডে আমরা পণ্য মিয়ানমারে পাঠাবো। ইয়াঙ্গুন দিয়ে পাঠানোর পাশাপাশি এই পোর্ট দিয়ে পাঠানোরও ইচ্ছে ছিল। সেই সময়ে আমাকে সর্বাত্মক সাহায্য করেছিলেন আমাদের সেই এজেন্ট, যিনি চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও ছিলেন রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত, সে আমার কাছে একান্ত গোপনে এই কথা স্বীকার করেছিলেন। তার আগে তিনি বলতেন, তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ রোহিঙ্গাদের সাথে আত্মীয়তা করেছেন। তবে তিনি মাঝে মধ্যেই মিয়ানমার যেতেন মন্ডু ও সিট্যুতে থাকতেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ভাষায় অনর্গল কথা বলতেও পারতেন। তার মাধ্যমেই আমি সাম্পানের একজন সওদাগরের সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম- টেকনাফ থেকে সিট্যু পর্যন্ত একটা সাম্পানের ভাড়া কত হবে এবং তাতে কত টন পণ্য ধরবে? পরবর্তীতে তার সাথে আমার কাজের-অকাজের অনেক কথা হতো। আমি মন্ডু যেতে চাইলাম। কিন্তু আমার অফিস তাতে 'নরাজি' দিলেন। আমার প্রতি নির্দেশ জারি হলো- "এক্সপোর্ট ইয়াঙ্গুন সি-পোর্ট দিয়েই করো? তোমার ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই!"

তারপর আমি ইয়াঙ্গুনে গেলাম। সেখানে ব্যবসা শুরু করলাম। অনেক জাতি ধর্মের মানুষের সাথে মিশলাম। একটা ভ্রমণ কাহিনী দিয়ে ব্লগেও লেখা শুরু করলাম। একদিন সেই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকুরিতে গেলাম। সেখানেও 'মিয়ানমার মার্কেট ডেভেলপমেন্ট' আমারই আওতায় এলো। আবারও কাজ শুরু করলাম। এবার আরও নতুন নতুন মানুষ পেলাম। পেয়ে গেলাম রাখাইনের রাখাইন বংশোদ্ভূত মানুষও। তাদের সাথে কথা বলতে বলতেই জানলাম, চীন সেই অঞ্চলে বিশাল বিশাল এলাকা নিয়ে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলছে। কিন্তু তাতে কী ঘটছে, কি কি শিল্পকারখানা স্থাপিত হচ্ছে- তা তারা কেউই বলতে পারেনি। কারণ সেদেশে 'বেশি কিছু জানতে চাওয়াটাকে' অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। চীনের এই শিল্পাঞ্চলের তথ্য আমাকে অবাক করলো! একটা অস্থিতিশীল অঞ্চলে কেন চীন এত বড় বিনিয়োগ করছে? সেটা জানতে পত্রিকা খুঁজতে থাকলাম। ছোট খাট অনেক তথ্য মিলিয়ে একটা ধারণা করে নিলাম।

আমার কাছে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়াটাকে 'ওয়েল প্ল্যান্ড ও সিস্টেমিটিক' বলে মনে হয়। ধাপে ধাপে সেই ঘটনাগুলো এমন ছিল-

১) প্রথম ধাপে রোহিঙ্গাদের নাগরিক আইনের প্যাঁচে ফেলে নাগরিকহীন করা হয়েছে।

২) রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে শত্রুতা তৈরী করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটানো হয়েছে। এই ধাপে কিছু মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। ফলে এলাকা চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়েছে।

৩) রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোকে ক্যাম্পে রূপান্তর করা হয়েছে। তাদের চলাচল ও জীবিকা সীমিত করা হয়েছে। বলতে গেলে বলতে হয়, তাদেরকে বাংলাদেশমুখী বানানো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ক্যাম্পগুলো বাংলাদেশের সীমান্তের আশেপাশে বানানো হয়েছে।

৪) তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা সহ মৌলিক সুবিধা বঞ্চিত করা হয়েছে। করা হয়েছে নানা আইন দিয়ে অত্যাচার, যাতে করে তাদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতা দেখা দেয়। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ তাদেরকে এদিকে প্রলুব্ধও করেছে।

৫) চোরাচালান, মাদক দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে একটা লাভজনক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে বিপদে তারা প্রথম চিন্তায় এই দেশেই আসতে চায়। ঘটনা ঘটেছেও তাই।

হঠাৎ করেই কেন মিয়ানমারে গণতন্ত্র এলো?

টানা চার দশকের পর সেনা শাসকেরা কেন হঠাৎ করেই নিজ উদ্যোগে সে দেশে গণতন্ত্র নিয়ে এলো? এটা হয়ত কারো চিন্তায়ই আসেনি। সবাই ধরে নিয়েছে, সেনাশাসনে তারা হয়ত বিরক্ত হয়ে মিজ সুকীকে ক্ষমতায় বসাচ্ছে। আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাও ছিল সেই বৃহত্তর প্রকল্পনারই একটা অংশ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী মিজ সুকিকে সামনে রেখে তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে রোহিঙ্গাদের উপর গুলি চালাচ্ছে। অর্থাৎ মিজ সুকীকে শিখণ্ডী বানিয়ে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার আসল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এতে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা হয়েছে-

১) রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালিয়ে তাদেরকে সেই দেশ থেকে তাড়াতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সমর্থ হয়েছে।
২) সুকীকে আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত ও তাকে ঘৃণিত মানুষে পরিণত করা হয়েছে।
৩) সুকী যদি এর প্রতিবাদ করেন, তাহলেও সেদেশের মূল জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে বিশ্বাসঘাতক ও রোহিঙ্গাপ্রেমী হিসেবে চিহ্নিত করে সারাজীবনের জন্য তার রাজনীতি শেষ করে ফেলা যাবে।
৪) সুকী যদি এখন সরেও যান, তাহলেও একজন সরকারপ্রধান হিসেবে এই রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার চালানোর জন্যও তার উপর মামলা দেওয়া যাবে।
৫) একজন বিতর্কিত সুকী চীনের জন্যও লাভজনক। কারণ কম্যুনিস্ট চীন গণতন্ত্রকে ঘৃণা করে। তাদের আশেপাশের দেশের কোন নেতা যদি পতিত হন, তাহলে সেই লাভ তাদের ঘরেই যায়।
৬) গণহত্যার জন্য যদি আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা হয়, তাহলে তাতে সবার আগে নাম আসবে সুকীর! এটাও নাটেরগুরুদের বড় লাভ। কারণ এটা করতে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষেরই হাত কাঁপবে! অপরদিকে, তাকে মিয়ানমারের হিরো বানিয়ে বিচার না করার একটা আন্দোলনও চালিয়ে যাওয়া যাবে।

তাহলে নাটের গুরু কে?

যদি প্রশ্ন করি, অনেক আগে থেকেই কেন রাখাইনে এত বড় বড় শিল্পঞ্চল গড়া হচ্ছে? কেন রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে ফেলা গ্রামগুলোতে বুলড্রেজার চালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে? কেন মিজ সুকীকে হঠাৎ করেই ক্ষমতায় আনা হলো? কেন চীন তাদের দেশের অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে? তাহলে সেই হাজার হাজার শিল্প-কারখানা কোথায় যাবে? তার ব্যাকআপ প্ল্যান কি? কেন বাংলাদেশে সরকার চীনের কথা মত- 'রোহিঙ্গারা ফিরে ক্যাম্পে থাকবে'- এমনটা জেনেও চুক্তি করেছে?

তাহলে কী এমন হবে?

১) রোহিঙ্গারা আর ফেরত যাচ্ছে না। বাকি যে কয়জন আছে তারাও চলে আসবে ধীরে ধীরে। একদিন পুরো এলাকাটা হবে চীনের পরিবেশ বিনাশী শিল্পাঞ্চল? হ্যাঁ, কিছু কিছু রোহিঙ্গা সেদেশে ফিরে যাবে যারা হবে কর্মক্ষম। তারা যাবে এসব শিল্প কারখানার দাস শ্রমিক হিসেবে; যাদেরকে রাখা হবে ক্যাম্পে এবং কাজ করবে চীনের কারখানায়!

২) চীন তাদের রাজধানী- 'বেইজিঙের আকাশ সারাবছর নীল দেখাবে' অর্থাৎ তাদের সবচেয়ে দূষিত নগরীটাকে ক্লিন করার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এরই জন্য অলরেডি শতাধিক রিসাইকেল পেপার ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে। আরও একহাজার বড় বড় ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন এইসব ফ্যাক্টরি যাবে কোথায়? উত্তর হলো, এদের বেশির ভাগই স্থাপিত হবে এই রাখাইনে। তাহলে এখন কি এসব শিল্পাঞ্চল চালু হবে?

৩) চীন অন্যের দুই ঘাড়ে 'তিন বন্দুক' রেখে গুলি চালাচ্ছে। তৃতীয়টা অদৃশ্য। হয়ত সেটা বাংলাদেশের ঘাড়ে রেখেছে।

৪) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা 'চিটাগাং পোর্ট'। কোন কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হারালে- সবার আগে আক্রান্ত হবে এটা। ফলাফল হবে আমাদের জন্য ভয়াবহ। এটা মূল প্লেয়াররা জানে। মনে রাখতে হবে মিয়ানমার আছে সুবিধাজনক পজিশনে। ফলে বাংলাদেশকে ঢেঁকি গিলতেই হবে।

ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা কারা?

এই খেলায় ভিকটিম হচ্ছে- রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, মিজ সুকী ও বাংলাদেশ। বেনিফিশিয়ারী হচ্ছে- চীন ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাহলে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা কারা? তারা কি এখনো চিহ্নিত হয়নি? আপনাদের জানার জন্য বলি- সেই তিন নম্বর বাচ্চাটা হচ্ছে- ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন! হ্যাঁ, এই খেলায় আরও একটা গ্রুপ আছে, আর সেটা হলো- 'সুযোগ সন্ধানী গ্রুপ'। তাতে আছে- পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া।

বাকিটা মিলিয়ে নিন। আর মন চাইলে আমাকে আমার ভুল ধরিয়ে দিন!