অগ্নিযুগের বিপ্লবী : তাঁকে যেমন দেখেছি

মুশতারি শফি
Published : 9 March 2011, 02:49 PM
Updated : 12 April 2013, 07:07 PM

চলে গেলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। তিনি আমাদের কালের বিপ্লবী, আমাদের সময়ের মহানায়ক। আমাদের সময়ের বলতে পারি এ জন্যই যে, বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ত্রিশ বছরের বড় হলেও উনার সঙ্গে একযোগে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। একাত্তর আমার জীবনে গভীর ক্ষত রেখে গেলেও এই বিপ্লবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সূত্রে আমি মানুষের জন্য কাজ করতে মহৎ অনুপ্রেরণা পেয়েছি এ কথা মানতে দ্বিধা নেই।

এ বিপ্লবীর কাছ থেকে আমি জেনেছি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনেক অজানা কথা। সময়ে সময়ে তিনি গল্পচ্ছলে জানিয়েছেন সেসব কথা। সুযোগ হলেই আমি শুনতে চাইতাম। আগ্রহভরে বলতেন তিনিও। আমাদের সেই আপন মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন গত বুধবার রাত সোয়া ১০ টার দিকে। অসুস্থতার জন্য কয়েক মাস আগে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। এখানে আসলে তাঁর কেউ ছিল না। তাই কলকাতায় স্বজনদের কাছেই চলে গেলেন। ওখানে দক্ষিণ কলকাতার ফর্টিস হাসপাতালে ১০৩ বছর বয়সে মারা গেলেন চট্টগ্রামের এই মহান বিপ্লবী।

তাঁর সম্পর্কে তাই একটি কথা এক বাক্যে বলা যায়- সারাজীবন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য লড়াই করেছেন তিনি। ভেবেছেন সবসময় তাদের নিয়ে। তাই মৃত্যুর একেবারে আগ পর্যন্ত তিনি দেশেই থেকে গেছেন। এখানে স্বজনরা কেউ তেমন না থাকলেও চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে চাননি। ছিলেন শুভবুদ্ধি, উন্নতি ও প্রগতির এক প্রতীক হয়ে। শেকড় তাঁকে টানত। এই মাটিকে ভালোবেসে এখানেই চিরসমাহিত হলেন তিনি।

তাঁর জীবনের মহত্তম ঘটনা নিঃসন্দেহে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়া। তাঁর কাছ থেকে জেনেছি, ওই বিপ্লবীদের মধ্যে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে ব্রিটিশবিরোধী এক যুদ্ধে অনেক বিপ্লবী নিহত হন। এ যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন বিনোদ বিহারী। পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে গোপনে চিকিৎসা নিয়ে আবার আন্দোলনে যোগ দেন। এরপরই তিনি ব্রিটিশ সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন। কারাভোগ করেছেন দীর্ঘদিন।

ষাটের দশকে কলকাতা থেকে দেশে ফিরে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে বিনোদ বিহারী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তাঁর ছেলেরা কলকাতায় থেকে যান।

ষাটের দশকের শেষদিকেই উনার সঙ্গে আমার পরিচয়। আর এ পরিচয় হয়েছে তার স্ত্রী বিভা দাশের মাধ্যমে। বিভা দাশ অপর্ণাচরণ স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। এ স্কুলে আমার মেয়েরা পড়াশোনা করত। তাঁর বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াতেন। আমার মেয়েদেরও তিনি একসময় পড়াতে শুরু করেন। খুব যত্ন করে বাচ্চাদের গণিত ও ইংরেজি পড়াতেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী। তাঁর পাণ্ডিত্য ও ধৈর্য ছিল অসাধারণ। এরপর থেকেই বিনোদ বিহারী চৌধুরী নামের এ মহান বিপ্লবীর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক ও পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।

১৯৭৩ সালে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, গণেষ ঘোষ, অনন্ত সেন চট্টগ্রামে এসে বিনোদ বিহারীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তা আমি দেখেছি। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে আমি অংশ নিয়েছি। সবসময় তিনি সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার পরামর্শ দিতেন আমাদের।

আজীবন থেকেছেন সক্রিয়, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। তাই নব্বইয়ের দশকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন হওয়ার পর এতে যুক্ত হন বিনোদ বিহারী। তখন তাঁর বয়স আশির ওপরে। কিন্তু ভালো কাজের ব্যাপারে তাঁর নিষ্ঠা ছিল অসাধারণ, তাই তিনি চুপচাপ বসে থাকতে চাননি। আমিও একজন কর্মী হয়ে কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলাম। পরে জাহানারা ইমাম মারা যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। এসব আন্দোলনে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী আমাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে মাস দুয়েক আগেও তিনি সভা করেছেন, আলোচনা করেছেন নানা বিষয় নিয়ে।

ব্যক্তি হিসেবে বিনোদ বিহারী অত্যন্ত মিষ্টভাষী, অমায়িক ছিলেন। মানুষকে সহজে আপন করে নিতে পারতেন। নিজে যেমন সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করতেন, অন্যদেরও তেমন করার পরামর্শ দিতেন। অসাধারণ লাগত তাঁর এই গুণটি।

জীবনের শেষসময় পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অন্যায়, অবিচার ও অপরাধের বিরুদ্ধে মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন তিনি। দেশ স্বাধীন হলেও দেশে যে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি এ কথাই বারবার বলে গেছেন তাঁর এ সব বক্তৃতায়। বিশেষ করে চট্ট্রগামের তরুণদের কাছে তিনি বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে ছিলেন। কারণ তারাই তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখতে পেত, তাঁর স্নেহের ছোঁয়া নিতে পারত। তাদের মাথার ওপর ছায়া হযে রইতেন তিনি।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, চট্টগ্রাম বিপ্লব ও আধ্যাত্মিকতার স্থান। আর তাই তো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গোটা বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রামের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু একটু অতৃপ্তি রয়ে গেছে আমার মনে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিরাট অবদান রাখার জন্য বিনোদ বিহারীকে আলাদাভাবে সম্মানিত করা উচিত ছিল। এটা ছিল রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেটা হয়নি। জাতি হিসেবে এটা আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, বা আরও সুস্পষ্টভাবে বললে, আমাদের সংকীর্ণতা।

বিনোদ বিহারীর সাধের স্বদেশে আজ শকুনদের আনাগোনা। এসব দেখলে কষ্ট পেতেন তিনি। বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে বিনোদ বিহারীর মতো বিপ্লবীদের স্বপ্ন সার্থক হবে। চলুন আমরা সবাই মিলে দেশটাকে সেদিকেই নিয়ে যাই। বিনোদ বিহারী যে বাংলাদেশকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও উন্নত একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন- তার জন্য কাজ করি। বিপ্লবীকে এর চেয়ে ভালো আর কী বা উপহার দিতে পারব আমরা!

সদ্যপ্রয়াত মহান বিপ্লবী ও কর্মনিষ্ঠ এই মানুষটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

বেগম মুশতারি শফি : শহীদজায়া ও চট্টগ্রাম উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি।