মফস্বল সাংবাদিকতা ও কিছু অসঙ্গতি!

সুমিত বণিক
Published : 27 Nov 2015, 02:03 PM
Updated : 27 Nov 2015, 02:03 PM

এক. আমার সাংবাদিকতার পরিচয় পত্র দেখে আমার এক পরিচিত ভাই বললেন, 'দাদা আমারে একটা কার্ড লইয়া দেন না?' আমি বললাম ভাই, আগে কিছু পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে বা পাঠক কলামে লিখে নিজের হাতটাকে পাঁকা করেন আর স্থানীয় কিছু বিষয়ে রিপোর্ট লেখার আগে, প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর প্রকাশিত সংবাদগুলো একটু দেখেন। আর এর মধ্যে স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে আপনার কিছু প্রতিবেদন তৈরি করুন, তারপর আপনাকে নিয়ে আমি অফিসে যাবো। সেই ভাই আমায় বললো,'আপনি তো জানেনই আমি কেমন লিখি, তাই আপাতত শুধু একটা কার্ড লইয়া দেন'।

দুই. আমার বাবা বললো, 'সাংবাদিকতা তো করো, তো সাংবাদিকতা করার আগে গাজীউল হক'র বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন ও বিধিমালা বইটি পড়ো'। আমি বললাম রিপোর্ট লিখেই কুল পাই না। আইন পড়বো কখন? বাবা বললো,' বলে কি, আইন না জানলে কেমন করে হবে? তাহলে তো বিপদে পড়তে হবে।' বাবার কথা থেকে সেই প্রথম জানলাম যে বাংলাদেশেও গণমাধ্যম আইন ও বিধিমালা বলে কিছু একটা আছে। যা আমার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে কোনদিন আমায় প্রশ্ন তোলেন নি।

তিন. পরিচিত একজন উদিয়মান তরুণ স্নাতক পাশ করেও ভাল কিছু করতে পারছিলেন না, হঠাৎ তার এলাকার আলোচিত সাংবাদিককে দেখে, তার সমকক্ষ হওয়ার বাসনায় শুরু করলেন সাংবাদিকতা। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকায় অল্পদিনেই সাংবাদিক বনে যাওয়া। উপজেলার সকলের কাছেই ইতিমধ্যেই তিনি সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত হয়ে পড়েছেন। এলাকার বিভিন্ন সরকারি অফিস, আমলা, বিশেষ থানায় তার মিষ্ট সখ্যতা সচেতন মহলের দৃষ্টি কেড়েছে। অনেকেই তাকে সাংঘাতিক হিসেবে অখ্যিায়িত করে। তিনি নাকি, অযথাই মানুষকে হয়রানি করেন। আমি শুনে তো রীতিমতো অবাক, এ কেমন সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা? সমস্যা তুলে ধরার দায়িত্ব কাধে নিয়ে, তিনিই স্বয়ং সমস্যার সৃষ্টির অনুঘটক বনে গেলেন?

চার. একজন দীর্ঘদিন ধরেই স্বনামধন্য প্রিন্ট মিডিয়ায় স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন, কিন্তু তার সহকর্মীদের কাছে ইতিমধ্যে তিনি কাজের প্রতিভার চেয়ে তেলবাজ হিসেবে বেশী সুপরিচিত হয়ে গেছেন। তিনি স্বনামধন্য সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততার কারনে স্থানীয় বিত্তশালীদের থেকে ভালোই উপটৌকন পেয়ে থাকেন। কিন্তু তার তত্ত্বীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে অফিস থেকে বলা এ্যাসাইনমেন্টের প্রতিবেদন করতে গিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েন। এক পর্যায়ে ভার সইতে না পারায় ও অথনৈতিক অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগে তাকে ছাঁটাই করা হয়।

পাঁচ. এলাকার কিছু মানুষের সাংবাদিকতা দেখে, পরিচিত একজনের সখ জাগলো সাংবাদিক হওয়ার। আমাকে সে তার আগ্রহের কথা জানালে, আমি বললাম তুমি তো ভাল কম্পিউটার জানো না, বাংলা বানান, সংবাদ তৈরির কৌশল সম্পর্কেও ধারণা নেই, তো কিভাবে করবে? সে বললো, 'সমস্যা নেই, আমার এক বন্ধুর কম্পিউটারের দোকান আছে, ঐ জায়গা থেকেই এলাকার সবাই নিউজ পাঠায়, তো আমার সংবাদ লেখা বা পাঠানোর কোন ঝামেলাই হবে না। সে আমায় বলেছে, তুই শুধু প্রতিনিধিডা আন, নিউজ পাঠানোর দায়িত্ব আমার'।

ছয়. এক ভাই বয়সে কিছুটা প্রবীণ হওয়ার পথে। সত্যিকার সাহিত্য চর্চার একজন সৃজনশীল মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই সাংবাদিকতা করছেন। কিন্তু তার আচরণ ও স্বভাবেও একজন সাদামাটা মানুষ। এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরতে এক আপোসহীন সংবাদকর্মী। তার সংবাদ কর্মের প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে জুটেছে একাধিক সম্মাননা।

সাত. আমায় এক বন্ধু বললো, বন্ধু আমিও রিপোর্ট বা লেখালেখি করতে চাই। আমি বললাম, এ সুযোগ তো এখন খুব অবারিত। চাইলে তুমি সামাজিক যোগাযোগের বা সিটিজেন জার্নালিজম এর সাইটগুলোতে যেকোন বিষয়ে লেখা প্রকাশ করতে পারো। অথবা তুমি তোমার লেখাগুলো নিয়ে একটি ব্লগ সাইটও খুলতে পারো। বন্ধুটি আমায় বললো, 'বন্ধু তুমি তো আমায় জটিল পরামর্শ দিতেছো, মিয়া কেমনে একটা পত্রিকার রিপোর্টারের কার্ড পাওয়া যাইবো, হেই কথা কও'।
যে কারনে এই উদাহারণগুলোর অবতারণা, সেটা হলো আমি আমার জীবিকার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংবাদকর্মী বা গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে মেশা ও কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সঞ্চিত হয়েছে সাংবাদিকতা বিষয়ক কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাদের অনেকেই লিখতে লিখতে সাংবাদিক বনে যাওয়া। সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি-নৈতিকতা, আইন-বিধিমালা তাদের কাছে উচ্চমার্গের বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে, এগুলো থেকে বলা যায় অনেক দূরেই তাদের অবস্থান। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায়ও যে ভালো করার জন্য নিজেদের জ্ঞান-দক্ষতার বিকাশ বা পেশাদারিত্ব বজায় রাখার জন্য সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার প্রকাশ ঘটানোর প্রয়োজন, সেটা তারা চিন্তাও করেনা। চাইলে কিন্তু সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের দক্ষতাকে আরো শাণিত করতে পারে। নিজেদের লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন এলাকার সমস্যা, সম্ভবনা, বঞ্চনার করুণ চিত্র। কিন্তু অধিকাংশই এ দিকে কর্ণপাতই করেন না। তবুও তিনি সাংবাদিক। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রেস ইন্সস্টিটিউট (পিআইবি), জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউট (নিমকো), বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব জার্নালিজম ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম) মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এর মাঝে বিজেম-এ ১ বছর মেয়াদী সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা (অনলাইন) যে প্রশিক্ষণ কোর্সটি চালু আছে। সেটি বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তের মানুষ খুব সহজেই নিজ এলাকায় অবস্থান করেই দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে কোর্সটি সম্পন্ন করতে পারবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রয়োজনীয় শিক্ষা, যোগ্যতা, নৈতিকতা ব্যতিরেকে কোন পেশাতেই সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।
আমার সীমিত পরিচিত পরিসরেও একাধিকবার সুযোগ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের। সেই সময় সাংবাদিকতার দিকপালদের কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেই মাপকাঠিতে আমাদের অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকেরই মৌলিক যোগ্যতার অভাব রয়েছে। তবে আশাহত হলে হবে না, মফস্বল সাংবাদিকরাই সাংবাদিকতার মূল প্রাণ। তাদের প্রচেষ্টার প্রতিফলনই আজকের সোচ্চার গণমাধ্যম। এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক নিষ্ঠাবান ও যোগ্য সাংবাদিক অছেন। যারা তাদের লেখনির মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও সংবাদ পাঠিয়ে এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনার লক্ষ্যে উন্নয়ন কর্মকান্ডকে গতিশীল করেন। একথা সবাই জানি যে, সর্ষের মাঝেও ভূত থাকে।
গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীরা মৃত্যু ঝুকি উপেক্ষা করে, তৎকালীন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সংবাদ দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশ করে সমর্থন জুগিয়েছিল। এ স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের পাথেয় হোক। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, গণমাধ্যমকে কুলষতার হাত থেকে রক্ষা করুন। সঠিক সাংবাদিকতার চর্চা ও শিক্ষার পথকে প্রসারিত করুন।
সুমিত বণিক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

sumitbanikktd.guc@gmail.com