প্রশ্নবিদ্ধ ভাষাপ্রেম ও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা!

সুমিত বণিক
Published : 4 Feb 2016, 04:56 AM
Updated : 4 Feb 2016, 04:56 AM

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবীতে আমাদের প্রচেষ্টার যেন কোন অন্ত নেই। এমনকি বর্তমান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজনে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের বর্ণিল ও ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখে, হৃদয়ের মাঝে থেকে স্বপ্ন বুনতে ইচ্ছে করে। প্রতিটি স্পন্দনে অনুভূত হয় ভাষা শহীদদের মহান আত্মত্যাগের স্বার্থকতা। নিজের ভেতরেও যেন বাংলাভাষাকে বিশ্বের দরবারে সমুন্নত রাখার প্রত্যাশা আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। মনে হয় বর্তমান প্রজন্মের ভাষা প্রেমিকদের সাথে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যুক্ত হলো আগামী প্রজন্মের নতুন সাহসী দৃপ্ত প্রত্যয়। আমার এ প্রত্যাশা কোন আকাশ কুসুম কল্পনা নয়। কারণ ভাষার দাবীতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস যেমন আমাদের জন্য চির গৌরবের, তেমনি বাংলা ভাষার বর্তমান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের জন্য তেমনি সম্মানের। আর আমাদের ভাষার এ সম্মান ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে নতুন প্রজন্ম আগামী দিনে সঠিক ভাবে দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার চর্চাকে আরো গতিশীল ও শুদ্ধ রূপে প্রয়োগের স্পৃহাকে অনুপ্রাণিত করবে।

কিন্তু বর্তমান কালে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আমি আমার প্রত্যাশার ভংঙ্গের কষ্টে ভুগছি। আর মনে হচ্ছে আমরাই আমাদের ভাষার প্রতি মমত্ববোধ হ্রাসে প্রশ্নবিদ্ধ সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছি। বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব ভাষাগত দক্ষতাকে বিদেশে যাবার জন্য বিশেষ ও আবশ্যিক যোগ্যতা হিসেবে মূল্যায়ন করছে। যেখানে টাকা হলেই বিদেশে যাওয়া সম্ভবপর হতো, সেখানেও শুধুমাত্র ভাষাগত সুনির্দিষ্ট স্কোর বা ফলাফল অর্জনের ভিত্তিতেই একজনকে বিদেশে যাবার জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ব্যাপক চাহিদা আর আবশ্যিকতার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশেই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে তথা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন বিদেশী ভাষা শিক্ষার বহু কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আর এসকল কেন্দ্রের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই হলো আমাদের দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন প্রত্যাশাকারী। তারা নিজের মাতৃভাষাকে পর করে শুধুমাত্র আর্থিক ও সামাজিক দিক বিবেচনা করে বহু কষ্ট করে পরদেশী ভাষাকে আয়ত্ত করছে। পরদেশী ভাষা হৃদয়াঙ্গমে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে হলেও তারা সমর্থ হচ্ছে ন্যূনতম ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে। কারণ এটিই বিদেশে যাবার জন্য তার আবশ্যিক যোগ্যতা। এটি ছাড়া সে অন্য কোন ভাবে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারবে না। এমনকি অনেক দেশ তার নিজ দেশের ভাষায় দক্ষতা অর্জনকারীদের কে বিশেষ সুবিধায় সে দেশে নিয়ে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের নিজ দেশের কর্মক্ষেত্রে আমাদের ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া মাতৃভাষাকে ব্যবহারের কতটুকু উপযুক্ত ক্ষেত্র বা সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছি? অথবা বাংলা ভাষায় দক্ষদের জন্য আলাদা ভাবে কোন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছি কি?

দেশের গুটি কয়েক মানুষ শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার ব্যাপারে আওয়াজ তুললেও যেখানে দেশের অভ্যন্তরে সর্বত্র সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেখানে আমরা আমাদের দেশের অভ্যন্তরে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বহু ভাষার প্রচলন কে সমুন্নত রেখে, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘের মতো উঁচু মানের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবী বা তার কার্যকারিতা আশা করা কতটুকু যৌক্তিক? শুধু বিদেশে নয়, দেশেও আজ ভাল চাকুরি পাওয়া ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিদেশী ভাষাজ্ঞান বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা কেই বিবেচনা করা হচ্ছে। তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারী এলেই আবাল-বৃদ্ধ মিলে শহীদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে মিনারে যে জন¯্রােতের সৃষ্টি হয়, তা কি শুধুই দিবস উদ্যাপনের তাগিদ বা কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক সংস্কৃতির অংশ? শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে যাওয়ার সময় গাওয়া, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি', গানটি কি তাহলে অনুভব ছাড়া শুধুই অভিনয় করে গাওয়া হয়? আর অন্য ভাষা শিখবেই বা না কেন! শুধুমাত্র শুদ্ধ বাংলা ভাষার জ্ঞান সম্বলিত দক্ষতা চেয়ে কয়টা বিজ্ঞাপন দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের? অথচ ইংরেজি ভাষায় লিখা ও বলার সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা চেয়ে চাকুরির বহু বিজ্ঞাপন প্রতিদিনই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর বিদেশী উন্নয়ন ও কর্পোরেট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গুলো আমাদের দেশে এই ইংরেজি ভাষা চর্চার মূল পৃষ্ঠপোষক।  দুঃখ হয়, এই বিদেশী ও কর্পোরেট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের পিছিয়ে পড়া হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য নানা কর্মসূচী বা প্রকল্প বাস্তবায়ন অথবা গবেষণা কর্মকান্ড গ্রহণ করলেও, সেই কর্মকান্ড পরিচালনায় ব্যবহার করা হয় ইংরেজি ভাষা। আরো দুঃখ হয়, যখন এসব কাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরেও দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা হয় ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় লিখিত মাঠ পর্যায়ের উন্নয়নের কর্মসূচী বা প্রকল্প বাস্তবায়নের যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়, তা অনুধাবনে আমাদের সরকারি অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের অবগতির জন্য কতটুকু প্রযোজ্য, সে কথা কি ভাবা হয়? আর সরকারি দপ্তরগুলোতে কেনইবা দেশের অভ্যন্তরে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করবে?

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগেও বাংলা ভাষা জয় করে নিয়েছে বহু মানুষের হৃদয়। দিন দিন দেশে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উৎকর্ষতা ও সংখ্যা বাড়ছে। সমান তালে বাড়ছে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসার। বর্তমানে মানুষের ভাব প্রকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ মোবাইল ও কম্পিউটারে ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা লেখার অভিনব সুযোগ সৃষ্টি  হয়েছে, বিশ্বের জনপ্রিয় ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগল ও তাদের ই-মেইল ও ওয়েব সাইটে, এমন কি সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকও তাদের সাইটে বাংলা লেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এর আগে যখন মানুষ তার ভাব প্রকাশে বাংলা শব্দকে ইংরেজি অক্ষরে প্রকাশ করতো, তখন মনের মাঝে একটা অতৃপ্তি কাজ করতো। তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এখন ফেসবুক খুললেই প্রমাণ মেলে দেশের সমকালীন সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে সকল বয়সী মানুষের বহুমাত্রিক চিন্তা-ভাবনার বর্ণাঢ্য ঝড় আর অভাবনীয় অংশগ্রহণ।

তাই এখনই সূবর্ণ সুযোগ বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করার। আর সেই সময়টাকেই যদি আমরা আমাদের সদিচ্ছার কারণে সুযোগটির কার্যকর ব্যবহার না করতে পারি, তাহেলে এর দায় কার? তাই বিশ্বাস করি, দেশের সর্বত্র সকল পর্যায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার কে শতভাগ সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আরো পরিমার্জিত আর গ্রহণযোগ্য অবস্থানে নেয়া সম্ভব। তবে প্রয়োজনের তাগিদে অবশ্যই বিদেশি ভাষার চর্চা ও প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাক্তিগত স্মার্টনেস আর আধুনিকতা প্রকাশের অভিব্যক্তি হিসেবে বিদেশী ভাষার আবশ্যিক প্রয়োগ, আমাদের দীঘদিনের লালিত প্রত্যাশার সাথে কতটুকু সংঙ্গতিপূর্ণ, তা আমাদের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ মহল একটু ভেবে দেখবেন কি?

সুমিত বণিক
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী ।

sumitbanikktd.guc@gmail.com