কর্মহীনতার হাহাকার ও অন্তহীন হতাশার শেষ কোথায়?

সুমিত বণিক
Published : 7 April 2016, 04:56 AM
Updated : 7 April 2016, 04:56 AM

আমরা অনেকেই ভাবি, আমরা সবাই বাবু/মেম সাহেব হয়ে গেছি! নব্য সংস্কৃতির ধারক কর্পোরেট জগতের বাসিন্দা কিংবা বিদেশের নামিদামী বাহারী ডিগ্রী আর উচ্চপদস্থ পদের অধিকারী হয়ে বেশ ভালোই আছি। মোটা অংকের বেতন আর বিলাসবহুল অট্টালিকায় আয়েশী জীবন! নিজেকে ও নিজের অট্টালিকাকে বিলাসবহুল আধুনিক উপকরণে সজ্জিত করতেই অনেকে ব্যস্ত। সমাজ জীবনের ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা, তাদের জীবনে কোন প্রভাব ফেলে না, ফেলার কথাও না!

কিন্তু এ কথা সত্য একটা সভ্য মানব সমাজ অধিকাংশ আত্মকেন্দ্রিক মানুষের দ্বারা সুশৃংঙ্খলভাবে চলতে পারে না।কিন্তু নিরবে-নিভৃতে ধনী-গরীবের এই বৈষম্যের প্রভাব আমাদের সমাজ জীবনেও পড়ছে। কিন্তু কে কার খোঁজ নিতে চায়? তবে এই খোঁজ নেয়ার মাঝেই যে সমাজ ও সামাজিকতার প্রাণ ভ্রমরার বসবাস, সে কথা সহজেই কেউ উপলব্ধি করতে চায় না। কিন্তু যখন সমস্যা ঘনীভূত হয়ে বিরাট আকার ধারণ করে, তখন আমাদের টনক নড়ে।

মানুষের ভিতরের একটু কষ্ট শোনার চেষ্টা করলেই দেখা যায়, মানুষ কতই না কষ্টে আছে! বেকারত্বের বিষবাষ্প ছড়িয়ে আছে দেশের আনাচে-কানাচে। কষ্ট-আর হতাশার মালা গলায় নিয়ে অন্তহীন দিনগুলো পাড়ি দিচ্ছে অগণিত তরুণ।এই তরুণদের চোখের সামনে নেই কোন স্বপ্ন, নেই জীবনের অনাগত দিনগুলো সাজানোর কোন সুন্দর পরিকল্পনা। জীবনের অনাগত দিনগুলো তাদের কাছে এখন অভিশপ্ত মনে হয়। কিন্তু এই ক্রান্তিকাল শুরুর আগে, কারো মনেই এমন প্রত্যাশাও ছিল না। সবার মনেই ছিল একটা সুন্দর স্বপ্ন! সমাজের মানুষের কাছে দিন দিন নিজেদের নেতিবাচক অবস্থান দেখে তাদের অনেকেই আজ বিপর্যস্থ। সমাজের ও একান্ত প্রিয় মানুষগুলোর প্রতিনিয়ত অবমূল্যায়ন, অপদস্থমূলক উক্তিগুলো তাদের কে করে তুলছে অপ্রকৃতস্থ। কিন্তু কেউ এমন নয়, কাজের অপর্যাপ্ত সুযোগ তাদের কে ধীরে ধীরে অগ্রহণযোগ্য করে তুলছে সবার কাছে। কিন্তু এই কষ্টের কথা কেউ জানতেও চায় না,শুনতেও চায় না। দেখে মনে হয় এই সমস্যা উত্তরণে এই সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন ভাবনা নেই! এই ধরণের ছোট্ট ছোট্ট ঘুণ পোকাগুলোই কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজ দেহে ক্যান্সারের মতো বিরাট আকার ধারণ করছে।তিনটি উদাহারণ দিয়ে প্রেক্ষাপটগুলো একটু ব্যাখ্যা করছি-

এক. শিমুল (ছদ্মনাম) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার আগে ভেবেছিল, পড়াশোনাটা শেষ করেই চাকুরি করবে! এর আগে অযথা কিছু করে সময় নষ্ট করতে চায় না।স্বপ্ন ছিল ফাস্ট ক্লাস না হোক, একটা সেকেন্ড ক্লাস চাকুরি তো অবশ্যই জুটবে! কিন্তু বাস্তবে পাশের দুই বছরের মধ্যেও কিছুই জুটছিল না,অনেক চেষ্টা করে অবশেষে একটা এনজিওতে মাঠ পরিদর্শক হিসেবে তিন বছর চাকুরি করলো, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় অবশেষে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ! তারপর আবার নতুন করে কর্মের অন্বেষণ শুরু! দেখতে দেখতে ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও কোন ব্যবস্থা হয়নি। অবশেষে আবার হতাশার প্রহর গুণা !

দুই. স্বপ্নীল (ছদ্মনাম) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কর্ম বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। ছোট ভাই পড়াশোনায় দূর্বল থাকায় অনেক আগেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।কিন্তু বড় ভাই হিসেবে স্বপ্ন ছিল ফাস্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার হবে। দুর্নীতি ও আত্মীয়করণের সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে যোগ্য মনে করতে পারেন নি স্বপ্নীল! অবশেষে বেছে নিল তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে টাকা দিয়ে সোনালী ব্যাংকের চাকুরি বাগিয়ে নেয়ার। কিন্তু বিধি বাম! চাকুরি তো হলোই না বরং চাকুরির জন্য চুক্তির টাকাটাও হাতছাড়া হলো। সবকিছু হারিয়ে কিছুটা আশাহীন এক মানুষ স্বপ্নীল! পরিবারের বড় ছেলে হয়ে, সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার মানুষের উদ্ভট প্রশ্নের ভয়ে এখন ঢাকায়! এখনও তার চোখে সরকারি চাকুরির স্বপ্ন! তবে চুন খেয়ে মুখ পোড়ায়, দই দেখেও এখন তার বড্ড ভয়!

তিন.আকাশ (ছদ্মনাম) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ (পাস) পাশ করেই একটি সোলার কোম্পানীতে মার্কেটিং কাজে মাঠ কর্মকর্তা হিসেবে হাওরের দুর্গম এলাকায় কাজ শুরু করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। কাজ করতে করতে দুই বছর পার করে ফেললেন। কিন্তু চাকুরির ন্যূনতম আর্থিক সুবিধা আর অমানুষিক পরিশ্রমের কারণে দুই বছর পর চাকরিটি ছাড়তে বাধ্য হন। আট মাস পার হয়ে গেলেও এখনো কোন ব্যবস্থা হয়নি। বাড়িতে বসে সুযোগের অপেক্ষায় দিন পার করছেন আকাশ।

আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য শিমুল, স্বপ্নীল, আকাশ রয়েছে। যারা তাদের সুন্দর সোনালী স্বপ্নগুলো নিজেরাই ফিকে হতে দেখে দেখে, কেউ হতাশাগ্রস্থ, কেউ মাদকাসক্ত, কেউ বা অনৈতিক কাজে লিপ্ত! এরই বহিঃপ্রকাশ আজকের অস্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থা ও মানবিকতার অধঃপতিত অবস্থা।

শিক্ষিত তরুণরাই যেখানে মূল্যবোধের পাঠ পড়েও পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে, সেখানে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত তরুণদের অবস্থা কতটুকু করুণ শুধু একবার ভাবুন!

তাই যা করি না, কেন বেকারত্বের হাত থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হবে। যদি এই সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা না করা যায়, তা হলে তা হলে এটি সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য এক দূরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে দেখা দিবে!

সুমিত বণিক

উন্নয়নকর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক,ঢাকা ।