নিরাপদ মাতৃত্ব কি শুধু সিজারিয়ান অপারেশনের শেকলেই বন্দি হয়ে থাকবে?

সুমিত বণিক
Published : 7 March 2017, 02:38 AM
Updated : 7 March 2017, 02:38 AM

গর্ভস্থ শিশুর সাবলীল রূপ দেখার জন্য প্রয়োজন একটি নিরাপদ প্রসব প্রক্রিয়ার। শুধু তাই নয় এটি একটি স্বাভাবিক জৈবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াও বটে। কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিও মাঝে মাঝে নানা কারণে বাধাগ্রস্থ হয়। এজন্যই চিকিৎসকগণ আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতির অবতারণা করেছেন এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকেই সহজ করার জন্য। আধুনিক বিশ্বের কথা বাদই দিলাম, স্বাধীন এই ভূ-খন্ডের মাঝেই কত যে বিচিত্র প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে একজন নারীকে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে হয়, তা একমাত্র ভূক্তভোগীরাই জানেন। তারা কিছুটা বিধাতার হাতে জীবনকে সঁপে দিয়েই মা হন। আমি দুটি এলাকার প্রেক্ষাপট তুলে ধরছি।

এক.

বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার উত্তর বংশীকুন্ডা এলাকার কথাই যদি বলি বা কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার খাটখাল এলাকার কথাই যদি বলি, তাহলে হয়তো শহুরে একজন বিবেকবান নারী তাঁর চোখের জল ধরে রাখতে পারবেন না। কারণ বর্ষায় এই এলাকাগুলো পানিতে একাকার থাকে, দু'চোখের সবটুকু সীমানা জুড়েই শুধু জল আর জল। সেখানকার মানুষকে উপজেলা সদর হাসপাতাল আসতেই চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। তথাকথিত ধাত্রী বা অপ্রশিক্ষিত দাই মহিলারাই তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। তাদের কাছে মা হওয়ার সময় প্রসবে সহযোগিতার জন্য পাঁচশত টাকা দিয়ে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ধাত্রীর সেবা নেওয়াকেই কষ্টকর মনে হয়। চিহ্নিত এসকল এলাকার উপজেলা হাসপাতালে আসা-যাওয়ার জন্য বরাদ্দকৃত নৌ-এ্যাম্বুলেন্সও কাজের সময় নানা কারণেই সারা বছর বিকল থাকে।

দুই.

কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। প্রসূতি সেবার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দের মাধ্যমে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য অবকাঠামোসহ তৈরি হয় জরুরী প্রসূতি সেবা (ইওসি) ইউনিট। কিন্তু অবকাঠামোসহ উপকরণ থাকলেও নানা জটিলতায় সেটি আজো পর্যন্ত চালু করা যায়নি। কেন চালু করা যায় নি, সেই উত্তর হয়তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভালো জানেন। একাধিক প্রসব জটিলতায় কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবিকাদের দায়িত্ব-কর্তব্য হিসেবে দেখেছি, তারা রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেই রোগীর পরিজন কে বেশ জটিলতার কথা বলেন এবং একাধিক প্রসূতি মায়ের পরিবারকে বলতে দেখেছি, অবস্থা অস্বাভাবিক নয়! জরুরী ভিত্তিতে সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে। অবাক হয়েছি তখন, যখন জেলা সদরের দামী ক্লিনিকে নেয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য নেয়া হলে, পরবর্তীতে একটি সুস্থ্য ভূমিষ্ট শিশু রোগীর পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়। অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বলা জটিলতর অবস্থার কথা বিষয়ে ঐ ক্লিনিকের শল্যবিদ কিছুই কর্ণপাত করলেন না!

সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগ স্থানীয় ওয়ার্ড পর্যায় থেকে বাড়িতে প্রসবের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করছেন। এমনকি সরকারের অনন্য উদ্যোগ কমিউনিটি ক্লিনিকেও প্রসবের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্ধুদ্ধ করানো হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হলো, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ চিকিৎসক থাকা স্বত্ত্বেও একটু জটিল অবস্থাতেই প্রসূতি মাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য রেফার্ড করা হচ্ছে জেলা সদর বা ক্লিনিকে, সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো অপর্যাপ্ত উপকরণ বিশিষ্ট কক্ষে একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের এই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন কি কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ নয়?

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে সিজারিয়ান অপারেশনের বা সিজারিয়ান সেকশন (সি-সেকশন)এর হার অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে চলেছে। এই উর্ধ্বগতি দেশের মাতৃস্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতির জন্যও সুখকর নয়। প্রতিবেদনের সূত্র অনুয়ায়ী- ২০০৪ সালে এই হার ছিলো বছরে মোট ডেলিভারীর ৫ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৯ শতাংশ, ২০১১ তে ১৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২৩ শতাংশ।  এই হার বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশী তো বটেই, এশিয়া ও ইউরোপের গড়ের চাইতেও বেশী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একটি দেশের সি-সেকশনের হার ১০-১৫ শতাংশের আশেপাশে থাকা উচিৎ। শুধু তাই নয়, অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের ফলে একজন নারীর দীর্ঘমেয়াদী নানা জটিলতা হতে পারে, যেমন সি-সেকশন পরবর্তীকালে প্রসূতি মানসিক চাপ, অতৃপ্তি, বাচ্চার সাথে দুর্বল সম্পর্ক ইত্যাদি সমস্যায় ভোগেন। অপারেশনের ক্ষত থেকে বন্ধ্যাত্ব এবং পরবর্তী গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত, গর্ভফুলের অবস্থান সংক্রান্ত নানান জটিলতা এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে বেশী অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের সাথে, বেশী নবজাতক ও শিশু মৃত্যু এবং বেশী প্রি-টার্ম (সময়ের আগে জন্মানো) ডেলিভারী সম্পর্কযুক্ত। এ ছাড়াও প্রসূতি ও পরিবারের সদস্যদের পারিবারিক, কর্মক্ষেত্রের ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

সবশেষে, আমি বাড়িতে প্রসব বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বা সিজারিয়ান অপারেশন, কোনটিরই বিরোধিতা করছি না। আমি বিস্মিত একটি উপজেলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিতের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা না থাকা, তথা একটি সাংঘর্ষিক অব্যবস্থাপনা অবস্থা দেখে! একজন জনস্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে উদ্বুদ্ধ করছি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ধাত্রীর কাছ থেকে সেবা নেওয়ার জন্য, সেই সাথে স্বাস্থ্যকর্মীকে বলা হচ্ছে, ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব করানোর জন্য, সেখানে উপজেলা সদরে একাধিক অভিজ্ঞ চিকিৎসক থাকা স্বত্ত্বেও উদ্ভূত একটু জটিল সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে একজন নারীর স্বাভাবিক প্রসব নিশ্চিত সম্ভব হয় না। সেখানেই আবার প্রত্যন্ত এলাকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ধাত্রী বা স্বাস্থ্যকর্মীর পক্ষে সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে একজন নারীর স্বাভাবিক প্রসব নিশ্চিত করা কতটুকু বাস্তব সম্মত উদ্যোগ? আর এসবের ভিড়েই এখন দেশব্যাপী অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনের শেকলে দিন দিন বন্দি হয়ে পড়ছে নিরাপদ মাতৃত্ব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন?

সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী
ঢাকা।
sumitbanikktd.guc@gmail.com