গুরুদাসপুরের আলম ভাইয়ের কথা বলছি…!

সুমিত বণিক
Published : 15 August 2017, 07:39 PM
Updated : 15 August 2017, 07:39 PM

মানুষ চাইলেই তাঁর সীমাবদ্ধতার মাঝেও অন্যের কল্যাণের জন্য নিজের হাতটুকু প্রসারিত করতে পারেন। করতে পারেন মনের অতৃপ্ত তৃষ্ণার নিবারণ। অবগাহন করতে পারেন মানব প্রেমের অমৃত সাগরে। অনুভব করতে পারেন স্বর্গীয় সুখের স্পর্শ। কিন্তু তার জন্য চাই একটি সুন্দর মন। আমি যাকে উপলক্ষ্য করে কথাগুলো বলছিলাম তিনি হলেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার আলম শেখ। নাটোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেটের ঠিক বিপরীত পার্শ্বেই আলম ভাইযের ছোট্ট একটি চা-পানের দোকান। শরীরটা হঠাৎ অসুস্থ্য হওয়ার কারণে তরল কিছু খাওয়ার প্রতি একটু গুরুত্ব দিচ্ছিলাম, কিন্তু গুরুত্বটা মনে মনে দিলে কি হবে! এখানে তো কোন আমার কোন আয়োজনই নেই।

উপায়ন্তর না দেখে একদিন সকালে আলম ভাইয়ের চায়ের দোকানে হরলিকস্ এর প্যাকেট নিয়ে গিয়ে বললাম, ভাই একটা কাপ ধুয়ে কাপে একটু গরম পানি দেন, তারপর তিনি দিলেন। আমি সাথে এক চামচ চিনি নিয়ে সেটি তৈরি করে দোকানিকে অল্প দিলাম আর বাকীটুকু আমি খেলাম। উনার কষ্ট বা আনুষাঙ্গিক জিনিসের খরচ হিসেবে উনি আমার কাছে কিছুই চাইলেন না। খাওয়া শেষে আমি উনাকে বললাম, যে ক'দিন আছি আপনাকে একটু কষ্ট দিব। তিনি হেসে বললেনে এটা কষ্ট নয়, হাসপাতালের কত রোগীর লোকজন এসে কতকিছু নেয়, এখন মানিয়ে নিছি। আপনি এসে নিজ হাতে বানিয়ে খাইয়েন কোন সমস্যা নাই।

তাঁর কথাটুকু উপলব্ধি করে মনে এক ধরণের প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। তাঁর ব্যবহারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ঘটনাটুকু জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে দেই, সেখানে বেশ সাড়া পাই, সবার মন্তব্য দেখে নিজেই খুব অনুপ্রাণিত হলাম। উনাকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবার বিষয়টি অন্য একদিন আলম ভাইয়ের কাছে বলছিলাম। তাকে বলছিলাম আপনি কি স্ট্যাটাসটি পড়তে পারবেন? তিনি বললেন, না ভাই আমি লেখাপড়া জানি না, আমার ছোট ছেলেটা পড়াশোনা জানে আর ও ফেসবুক চালায়, ওরে পাঠাইলে ও পইড়া শুনাতে পারবো।

আমি বললাম, ঠিক আছে তাহলে আমিই পড়ে শোনাচ্ছি। তাকে পড়ে শোনানোর পড় সে বললো, ভাই এটি কোন বিষয়ই না। আমার দোকানে আগে দুধ চা বিক্রি করতাম কিন্তু এখন আর করি না। তখন কত রোগীর আত্মীয় স্বজন রোগীর জন্য, একদিনের-দুইদিনের বাচ্চাদের জন্য পর্যন্ত দুধ চাইতো, আমি দিতাম! কিন্তু কোন দিন আমি টাকা রাখিনি। ঘটনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে তিনি বললেন- 'আমার একটি গরু ছিল। গরুটি দৈনিক ১০-১২ লিটার দুধ দিত। আর এই গরু দিয়া আমি এই সংসারের অনেক কিছু করছি। এই গরুটির থেকে বাচ্চা নেয়া এখনো একটা গরু আছে। আর পরে ঐ প্রথম গরুটিকে আল্লাহর নামে কোরবানী দিছি।'

অন্য আর একদিন সকাল বেলায় হররিকস্ খাওয়ার সময় তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম যেন কি? অতএব কথাটা দাঁড়ালো উনি আমার নামটাই জানেন না! হয়তো উনার সেটা জানারও প্রয়োজনবোধ হয়নি। তারপর বললাম, আমার নাম সুমিত বণিক, দেশের বাড়ী কিশোরগঞ্জ, ঢাকার কলেরা হাসপাতালের একটা প্রজেক্টে কাজ করি। তখন নাম শুনে তিনি কিছুটা আঁচ করতে পারলেন যে আমি হিন্দু ধর্মালম্বী। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন খাওয়া দাওয়া করেন কোথায়, আমি বললাম হোটেলে! তিনি বললেন হোটেলে খাওয়াতো খুব কষ্ট! আমি বললাম কি করা ভাই! সবদিকে তো আর সুখ খুঁজে পাওয়া যাবে না, মেনে নিয়েই চলতে হয়। তিনি বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, আজকে দুপুরে আমার সাথে খাবেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ করেই রইলাম। ভাবছিলাম উনার আন্তরিকতাটুকু! চেনা নেই জানা নেই একটা মানুষকে দুপুরে তার সাথে খাবারের নিমন্ত্রণ! বাড়িতে ফোন করে বউকে বললেন, আজকে ভাত আর তরকারী একটু বেশি দিও, একজন আমার সাথে খাবে।

আমি বললাম, ভাই একটু রুমে গিয়ে ফ্রেশ হই, আপনি সময় হলে কল দিয়েন। যথারীতি আমার রেডি হওয়ার আগেই আলম ভাইয়ের কল! বললাম, আসছি আলম ভাই, ফ্রেশ হতে একটু সময় লেগে গেছে। বললেন, আসেন সমস্যা নাই! তারপর গেলাম। গিয়ে দেখলাম উনি আমার অপেক্ষায় বাড়ি থেকে পাঠানো খাবারের পুটলিটা টেবিলের উপর রেখে আমার জন্য দোকানের সামনে বসে আছেন! আমি দোকোনে পৌঁছানোর সাথে সাথে ছেলেকে বললেন, গ্লাস ও প্লেট ধুয়ে দিতে। আর ছেলেটিকে দেখিয়ে বললেন এটিই আমার ছোট ছেলে, কলেজে পড়ে।

তারপর আমি আর আলম ভাই খেতে বসলাম। আলম ভাই পুটলার গিঁট খুললেন! বের করলেন ভাত আর মাছের তরকারি। আমার প্লেটে উনিই ভাত আর মাছের তরকারি তুলে দিলেন। বললেন ভাই এক তরকারির খাওয়া। আমি বললাম সমস্যা নেই, আমার তো এটিই পছন্দ। তরকারিটা বেশ ঝাল হয়েছিল! কিন্তু জ্বরের কারণে তোতো জিহ্বায় বেশ তৃপ্তি লাগছিল। খেয়ে যেন তৃপ্তির স্বাদ খুঁজে পেলাম।

এতকথা বলার কারণ, আমি আলম ভাই বা কাউকে ছোট-বড় করতে চাই না! করার চেষ্টাও কখনো করি না। শুধু ভাবি মানুষের মানুষের প্রতি মানুষের নির্মল ভালবাসার শক্তির প্রভাব। পাশাপাশি ভাবি, আমি হয়তো একটা এজেন্ডা নিয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করছি, কিন্তু সেখানে আমার ক্যারিয়ার বা আর্থিক প্রণোদনার স্বার্থটিও জড়িত, কিন্তু আলম ভাইয়ের মতো মানুষেরা বিনা প্রণোদনাতেই সীমাবদ্ধতার মাঝেও কত মানুষের কল্যাণের জন্যই না নিরবে-নিভৃতে কাজ চলেছেন।

আলম ভাই ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক। বড় ছেলে বিয়ে ভ্যান চালায় এবং ছোট ছেলে কলেজে পড়ে। বড় ছেলে বিয়ের পর আলাদা থাকে। বর্তমানে তাঁর জীবনে সকল স্বপ্ন এখন কলেজ পড়ুয়া ছোট ছেলেকে ঘিরে। ছোট ছেলেটির জীবনের একটা সেটেলম্যান্টই তাঁর একমাত্র স্বপ্ন! তারপর নাকি কবরে গিয়েও শান্তি পাবেন তিনি।

আমি যেমন আমার জীবন চলার পথে আমার স্বজনদের সহযোগীতার জন্য চির কৃতজ্ঞ, তেমনি আলম ভাইয়ের মতো অসংখ্য মানুষের কাছেও আমি বড্ড ঋণী। ভাল থাকুক আলম ভাইয়ের মতো নির্মল মনের পরোপকারী মানুষগুলো। যারা অন্ততঃ কোন স্বীকৃতির আশায় কারো মানুষের উপকার করে না।

অনুভব করলাম আলম ভাইদের মতো বিত্ত-বৈভবহীন মানুষদের মধ্যে যেটুকু মানবিকতার ছোঁয়া আছে আমাদের বর্তমান সমাজের তথাকথিত বিত্তবান মানুষদের মাঝে তার অনেকটাই যেন অনুপস্থিত।

আলম ভাইয়ের জন্য রইল নিরন্তর শুভকামনা…।

সুমিত বণিক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

গুরুদাসপুর (নাটোর) থেকে।