রাঙ্গামাটিতে রিইউজেবল স্যানিটারি প্যাড তৈরির প্রশিক্ষণ

সুমিত বণিক
Published : 7 Nov 2021, 05:20 PM
Updated : 7 Nov 2021, 05:20 PM

মাসিক নিয়ে বাংলাদেশেও একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সচেতন জনগোষ্ঠীর একটা ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছে, নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ  এই শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ে সব রকম কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে।

ইতিবাচক দিক হচ্ছে, মাসিক নিয়ে যুগের পর যুগ নারী ও কিশোরীরা যে  কুসংস্কারের সংস্কৃতি ও ভুল ধ্যান-ধারণা বয়ে বেড়াচ্ছে, সেটিকে ঘিরে মানুষের মধ্যে এখন একটা ব্যাপক উন্নয়ন ও গবেষণামূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী মাসিক নিয়ে যে সকল কুসংস্কার, বদ্ধমূল ধারণা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেগুলো  পাল্টে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। কুসংস্কার আমাদের দেশেও আছে; সেটা স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে আমাদের জীবনের নানা বিষয়ের সাথে জড়িয়ে আছে। পুরুষের জীবনেও তার প্রজনন স্বাস্থ্যের কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় কিন্তু যেটি পার্থক্যের বিষয়, সেটি হলো, পুরুষকে কোথাও তার প্রজনন স্বাস্থ্যের এই স্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য খুব একটা নিগৃহীত হতে দেখা যায় না।

কষ্টদায়ক বিষয় হচ্ছে, নারীকে তার মাসিক চলাকালীন সময়ে অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়, প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। এখানেই শেষ নয়, মাসিক একটি নারীর জীবনের সামগ্রিক প্রজনন স্বাস্থ্যের সাথে খুব ঘনিষ্টভাবে জড়িত। সুতরাং নারীর সার্বিক জীবনের সুস্থতায় মাসিক বাদ দিয়ে চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই।

মাসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।

মাসিক নিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা খুব জরুরি। সেই সাথে যাদের জীবনের প্রথম মাসিক এখনো শুরু হয়নি বা যাদের মাসিক চলমান আছে তারা যেন মাসিকের সময় সঠিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পায়, সে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে।

এছাড়া মাসিক হওয়ার কারণে একজন মেয়ে বা নারী যেন তার কোনো ধরনের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, মাসিক হওয়ার কারণে সে যেন সমাজে তার স্বাভাবিক জীবন-যাপনে কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার না হয়, সেটিও গুরুত্বসহকারে চিন্তা করতে হবে।

সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর সূত্রে জানতে পারলাম, নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে ও নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে দলের সদর দফতরে স্যানিটারি প্যাড বিতরণের জন্য যন্ত্র বসানো হয়েছে। ঐ যন্ত্র থেকে নারী ও কিশোরীরা মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাবেন।  নির্বাচনী এক জনসভায় দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হিসেবে ৬ হাজার জনঔষধি কেন্দ্রের মাধ্যমে ভারতের প্রায় ৫ কোটি মহিলার হাতে মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে স্যানিটারি প্যাড তুলে দেয়া হবে।

আমরা যদি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের প্রান্তিক এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা ভাবি, তাহলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদ ও গবেষণা তথ্যে দেখতে পাই, সেখানকার অবস্থাটা এখনও অনেক নাজুক। শহরাঞ্চলের নারী ও কিশোরীরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মাসিক চলাকালীন সময়ে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে সেটি মাসিক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর এবং আরামদায়ক একটি সহজ সমাধান। কিন্তু আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের সেই সকল দুর্গম অঞ্চলগুলোর প্রান্তিক এলাকার নারী ও কিশোরীদের নিজ এলাকায় স্যানিটারি প্যাড সহজলভ্য নয়, সেই সাথে ঐ প্যাডের ক্রয়ক্ষমতাও অনেকেরই নেই।

আশার কথা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলে 'আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ' শীর্ষক একটি উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় পার্বত্য এলাকায় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক মানকে উন্নীত করতে সমন্বিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলমান রয়েছে।

প্রকল্পটি মাসিক স্বাস্থ্যের উপকরণ বিতরণের মধ্য দিয়ে সমস্যাটির সাময়িক সমাধান ঘটাতে পারতো, কিন্তু প্রকল্পটি একটু ভিন্নভাবে এই সমস্যাটি স্বমন্বিতভাবে একটি স্থায়িত্বশীল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করছে।

এরই অংশ হিসেবে তারা চিন্তা করেছে, এই সকল প্রান্তিক এলাকার যুব নারী ও কিশোরীদের জন্য এমন একটি স্বাস্থ্যকর উপকরণ তৈরির দক্ষতা বিনিময় করা, যার মাধ্যমে তারা তাদের এলাকায় সহজলভ্য এবং স্বল্পমূল্যের উপকরণ ব্যবহার করার মাধ্যমে বাড়িতে বসেই তাদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত রি-ইউজেবল স্যনিটারি প্যাড তৈরির জন্য দক্ষতা অর্জন করবে। যার জন্যে ইতোমধ্যে প্রকল্পটির দীর্ঘদিনের একটা স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

সম্প্রতি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় প্রকল্পটির রিইউজেবল স্যানিটারি প্যাড তৈরি বিষয়ে একদিনের প্রশিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মূলত এই চিন্তা এবং কর্মযজ্ঞটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সম্পৃক্ত ছিলেন।

যিনি এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি হলেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)'র রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার মাস্টার ট্রেইনার রিমি চাকমা।

তার একনিষ্ঠ আন্তরিকতা, চিন্তা এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সহায়তা পার্বত্য অঞ্চলের নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বাস্তব সমস্যার আলোকে সাময়িকভাবে একটি মান সম্মত মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যেটি বর্তমানে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং পরবর্তীতে এর আরো আধুনিকায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমান রূপরেখা অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় আলাদাভাবে রিইউজেবল স্যানিটারি তৈরির জন্য কিশোরী ক্লাব পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মেন্টরদের দক্ষতা তৈরির কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

এতে করে প্রত্যক্ষভাবে এর সুফল ভোগ করবে কিশোরী ক্লাবের সাথে সরাসরি যুক্ত ৩ পার্বত্য জেলার প্রায় ১২ হাজার যুব নারী ও কিশোরী।

এভাবে মাসিককে ঘিরে থাকা ভুল স্বাস্থ্য পরিচর্যা আর সঠিক তথ্য প্রাপ্তির সংকটের অবসান ঘটুক।