ভৌগোলিকভাবে সিলেট প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য

সুমন দে
Published : 10 Sept 2016, 06:56 AM
Updated : 10 Sept 2016, 06:56 AM

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকাই মূলত সিলেট শহর হিসেবে পরিচিত। সিলেট ২০০৯ সালের মার্চ মাসে একটি মেট্রোপলিটন শহরের মর্যাদা লাভ করে। এ জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৮২টি হাওর-বিল রয়েছে। চীন দেশীয় পর্যটক হিউয়েন সাং বলেছেন, "শ্রীহট্ট একটা প্রাচীন ও গৌরবশবলী দেশ"। সিলেটে বেশ কিছু ছোট ছোট পাহাড় ও টিলা রয়েছে, যার মধ্যে জৈন্তাপুর টিলা (৫৪ মিটার), শারি টিলা (৯২ মি), লালাখাল টিলা (১৩৫ মি)। সুরমা নদীর দক্ষিন পার্শ্বে সিলেট রেলস্টেশন অবস্থিত। পুর্বে স্টেশন্টির ভগ্নদশা থাকলেও কয়েক বছর পূর্বে স্টেশন্টির নতুন ভবন তৈরির পর তা অনবদ্য রুপ পরিগ্রহ করে।

সিলেট জেলার আয়তন ৩,৪৯০.৪০ বর্গ কি:মি:। উত্তরে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে ভারতের কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা। সিলেট বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত পাহাড়ী, সমতল ও হাওর ঘেরা এক অঞ্চল। সুরমা নদীর তীরবর্তী এই শহরটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপুর্ণ শহর। বিশ্ব বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেছেন, "শ্রীহট্ট পরিক্রমা না হওয়া পর্যন্ত আমার ভারত পরিক্রমা শেষ হলো বলে আমি মনে করি না"।বাংলাদেশের যে কয়টি অঞ্চলে চা বাগান পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে সিলেট অন্যতম। সিলেটের চায়ের রঙ, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান সিলেট শহরে অবস্থিত। নাম মালনীছড়া। ১৮৪৯ সালে এই চা বাগান প্রতিষ্ঠিত। চা বাগানের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারের চাষ করা হয়। রেলপথে যারা সিলেটে যাওয়া-আসা করেন তাদের সবারই টার্গেট থাকে রেল লাইনের দুধারে থাকা চা বাগান দেখার। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে প্রায় ১৩৫টি বাগানই রয়েছে সিলেটজুড়ে। সিলেটের সবচেয়ে বড় চা বাগান শায়েস্তা গঞ্জের 'ডানকান' নামে খ্যাত।

পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের ভাষায়, "সিলেট একটি কবিত্বময় পরিবেশের আদি নিবাস, এখানে বাস করে কবি না হয়ে পারা যায় না"। এ শহরের বিশাল সংখ্যক লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে । মাধবকুন্ডের ঝর্ণা হচ্ছে পর্যটকদের জন্য সিলেট বিভাগের মধ্যে একমাত্র আকর্ষণীয় স্থান।শ্রীমঙ্গলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চা বাগান আছে যা সবুজ কার্পেট নামে খ্যাত। এখানে চা গবেষণা কেন্দ্র ও একটি চা উৎপাদনের কারখানা আছে। শ্রী চৈতন্য দেবের মন্দির সিলেট শহর হতে ৪৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত। প্রায় ৫০০ বছরের পুরাতন এ শ্রী চৈতন্যের মন্দিরটি। ১৭ শতাব্দীতে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব একটি পাহাড়ের উপরে সার্কিট হাউজের দক্ষিণ পূর্বে তিন কিলোমিটার দূরে শাহী ঈদগাঁহ নির্মাণ করেছিলেন। জৈন্তাপুর সিলেট শহর হতে ৪৮ কিলোমিটার দূরে সিলেট শিলং রোডের অবস্থিত। প্রাচীন রাজার রাজধানী নামে খ্যাত এ জৈন্তাপুর। জৈন্তাপুর রাজবাড়ি জাফলং হতে ১১ কিলোমিটার দূরে, এখানে একটি সুন্দর চা বাগান আছে । শ্রীপুর হচ্ছে অন্য একটি পর্যটন স্থান যেখানে আপনি পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাবেন। রয়েছে চা-বাগানও।

হযরত শাহজালাল (রাঃ) ও হযরত শাহ পরান (রাঃ) এর পবিত্র মাজার শরীফ এ জেলায় অবস্থিত। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ লোক মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে। ১৩০৩ সালে কালৈতিহাসিক মুসলিম সাধু হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর আবির্ভাব ঘটে এই সময়ে। তিনি মক্কা থেকে দিল্লি ও ঢাকা হয়ে এই এলাকায় আসেন। বাংলাদেশের একমাত্র মোয়াম্পফরেস্ট সিলেট শহর হতে ২৪ কিলোমিটার দূরে দেশ বিদেশের পর্যটকরা এখানে সব সময়ই আসেন। "লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট" বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন। পর্যটকরা এখানে বানরের গাছে চড়ার দৃশ্য, পাখি যেমন- পেঁচা, টিয়া ইত্যাদি দেখতে পাবেন। এখানে হরিণের ঘোরাফেরা, চিতাবাঘ, বন্যমোরগ, কাঠবিড়ালী এবং অজগর সাপ দেখতে পাবেন। সারি নদী ও খাশিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং অবস্থিত। সারি নদীর উৎপত্তি হিমালয় থেকে। এর স্রোতে লক্ষ লক্ষ টন পাথর চলে আসে বাংলাদেশে। সারি নদীতে ভ্রমণের মাধ্যমে পর্যটকরা দেশের নীলনদ খ্যাত লালাখাল ভ্রমনে সারি নদীর নীল জল ও পাথর সংগ্রহের দৃশ্য আপনাকে সত্যিই আনন্দ দিবে। সিলেট শহর হতে তামাবিল সীমানা ৫৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ এলাকার দর্শনীয় স্থান ও ঝর্ণার উৎস দেখতে হলে তামাবিল দিয়ে বর্ডার পার হতে হবে ।

সিলেটে দর্শনীয় স্থানের তালিকা:

১। জাফলং (জিরো পয়েন্ট, সারি নদী, চা বাগান, খাসীয়া পল্লী)

২। হযরত শাহজালাল (রা.) ও হযরত শাহ পরাণ(রা.) এর মাজার শরীফ

৩। জৈন্তাপূর (পুরানো রাজবাড়ী)

৪। মাধব কুন্ড ও পরীকুন্ড জলপ্রপাত

৫। শ্রীমঙ্গল (চা বাগান, লাওয়াছরা বন, মাধব পুর লেক)

৬। লালাখাল

৭। তামাবিল

৮। হাকালুকি হাওড়

৯। কীন ব্রিজ

১০। ভোলাগঞ্জ

১১। মহাপ্রভু শ্রী চৈত্যনো দেবের বাড়ি

১২। হাছন রাজা জাদুঘর

১৩। মালনী ছড়া চা বাগান

১৪। ড্রিমল্যান্ড পার্ক

১৫। আলী আমজাদের ঘড়ি

১৬। জিতু মিয়ার বাড়ি

১৭। মুনিপুরী রাজবাড়ি

১৮। মুনিপুরী মিউজিয়াম

১৯। শাহী ঈদগাহ

২০। ওসমানী শিশু পার্ক

২১। হামহাম জলপ্রপাত

২২। সাতছড়ি অভয়ারণ্য

২৩। রেমা উদ্দ্যান

২৪। এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং

২৬। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এর বাড়ি

২৭। মির্জাপুর ইস্পাহানী চা বাগান

২৮। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট

২৯। নীল কন্ঠ ( ৭ রংঙের চা)

আয়নার মত স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেঁয়ে আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। গুড়ি গুড়ি জলকনা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের ১৫০ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের দিকে তার গন্তব্যে। চারিপাশ গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতীর লাত পাতা ও লতা গুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ী শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে।

প্রকৃতির অপরূপ লীলাভুমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় নতুন সন্ধান পাওয়া রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। দীর্ঘ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে অনেক কষ্টে গহীন অরন্যে এই জলপ্রপাতকে দেখতে প্রতিদিন আগমন ঘটছে দিনে দিনে পর্যটকদের ঢল।

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহিন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ী এলাকার এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। স্থানীয় বাসিন্দারা একে হামহাম ঝর্না বা অনেকে হাম্মাম ঝর্না বলে ডাকে। এ জলপ্রপাতে যাবার কোনো রাস্তা না থাকলেও পর্যটকরা দূর্গম পাহাড় ও ছোট ছোট আকাবাকা এবং উচু উচু পাহাড় ডিংগিয়ে অনেক কষ্ট করে এখানে ছুটে যান প্রকৃতির নির্মল বিনোদন লাভের আশায়।

সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগের অভাবে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। এছাড়া প্রচার প্রচারনার অভাবেও বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাতটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলো।

পথের দু পাশের বুনো গাছের সজ্জা যে কোনো পর্যটকের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায় । চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে।

দূর থেকে কানে ভেসে আসবে বিপন্ন বন মানুষের ডাক। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে আপনার দু'চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাটতে হাটতে একসময় পৌঁছে যাবেন আপনার কাঙ্খিত হামহাম জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি। কিছু দূর এগুলেই শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ।

চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে ঝর্নার ঝড়ে পড়ার শব্দ মিলে মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষনিকের জন্য ভূলেই যেতে হবে কোথায় আছি, কিভাবে আছি। উপরে আকাশ, চারিদিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ জল আর সম্মুখে অপরূপ ঝর্না।

কমলগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩৮কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকায় এ জলপ্রপাতের অবস্থান। এ দর্শনীয় স্থানে যেতে হলে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল শহর থেকে স্থানীয় মিনিবাস, জীপ, মাইক্রোবাস ও সিএনজি নিয়ে কমলগঞ্জের-কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫কিঃ পাকা রাস্তা বাকী ১৫/২০ কিঃ মিঃ মাটির রাস্তায় পায়ে হেঁটে চাম্পা রায় চা বাগানের ভেতর দিয়ে কলাবন বস্তি হয়ে মোকামটিলায় গেলে দেখা পাওয়া যায় ১৫০ফুট উচ্চতা ও ৮০ ফুট প্রস্তের এই হাম্মাম জলপ্রপাত।

***

http://jugapath.com/archives/8184 আমারই অনলাইন পোর্টাল Editor in Chief: Sumon Dey.