তিন বছরের ব্যবধানে দু’ভাই-বোন পেলেন একুশে পদক

সুমন দে
Published : 10 May 2017, 06:02 AM
Updated : 10 May 2017, 06:02 AM

.

পণ্ডিত রামকানাই দাশ এর বড় বোন সুষমা দাস বঙ্গাব্দ ১৩৩৬ বাংলা (১লা মে ১৯৩০ সালে) সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রসিক লাল দাস, মাতা দিব্যময়ী দাস। বঙ্গাব্দ ১৩৫২ সালে শাল্লা থানার চাকুয়া গ্রামে প্রাণনাথ দাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর গ্রামীণ মেয়েলি আসরে ধামাইল, কবিগান ও বাউলগানের পাশাপাশি হরি জাগরণের গান, গোপিনী কীর্তন, বিয়ের গানসহ ভাটি অঞ্চলে প্রচলিত লোকজ ধারার সকল অঙ্গনের গান গেয়ে এলাকায় একজন নন্দিত শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। এছাড়াও তিনি গুষট, বাল্যলিলা, রাখালবনের খেলা, বকবধ, কালিদয়, মুক্তালতাবলী, সুবলমিলন ইত্যাদি বিভিন্ন সময় পরিবেশন করেন।

সুষমা দাসের লোকগান সংগ্রহের ছিল এক বিরাট অবদান। তিনি নৌকার মাঝি, পথেঘাটে যখনই কোন গান শুনে তার ভাল লাগত, সেই গান সংগ্রহ করা ছিল তার আরেকটি মহৎ গুণ (নেশার মত)। এইভাবে তিনি প্রায় চারশত লোককবির গান সংগ্রহ করেন। একুশে পদক প্রাপ্ত হওয়াতে তার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, 'আমি খবই খুশি, আমি চাই আমাদের আগামি প্রজন্ম আমাদের হারিয়ে যাওয়া গান, কথা ও সুরগুলো সংরাক্ষণ করবে, আমদের ঐতিহ্য লালন করবে।' লোকসংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ৫ জুন ২০১৬ সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমি হতে গুণীজন সম্মাননা- ২০১৫ লাভ করেন। শিল্পকলায় (সংগীত) বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ৯০ বছর বয়সী সুষমা দাসকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। তিনি চার পুত্র ও এক কন্যার জননী। অবসর সময়ে তিনি পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনি নিয়ে গানে গানে মেতে থাকেন।

.

পণ্ডিত রামকানাই দাশ এর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে। শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের খ্যাতিমান শিল্পী হলেও তাঁর রক্তে মিশে থাকা প্রাচীন লোকসঙ্গীতের শিল্পী হিসেবেও তিনি অন্যতম। সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকে একজন তবলাশিল্পী হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন।

তিনি সত্তরের নির্বাচন ও তার আগে-পরের প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে গনচেতনা উদ্দীপক সাংস্কৃতিক কর্মসূচীগুলোতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। সেই উত্তাল সময়ে কবি দিলোয়ারের কথায় ও তাঁর সুরারোপিত গণসঙ্গীতগুলো উদীচীর শিল্পীদের পরিবেশনায় গণজাগরণ সৃষ্টি করত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরসমূহে জাগানিয়া গান গেয়ে আশাহত শরণার্থীদের মনবল সমুন্নত রাখার কাজে ব্রতী থাকেন।

১৯৮৮ সালে সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'সঙ্গীত পরিষদ' প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে নিউইয়র্কেও এর শাখা রয়েছে এবং সেখানে বাংলা সঙ্গীত-সংস্কৃতির প্রচার প্রসারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রচার ও প্রসারকল্পে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পর্যায়ের সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। শেষ বয়সে তিনি সুবিধাবঞ্চিত প্রতিভাবান শিশুদের জন্য একটি অবৈতনিক সঙ্গীত শিক্ষা কার্যক্রমে নিজে সঙ্গীত শিক্ষাদান করতেন।

২০০৫ সালে তাঁর রচিত দুই খন্ডের সঙ্গীত শিক্ষা বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ 'সরল সঙ্গীত শিক্ষা' প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'সঙ্গীত ও আমার জীবন'। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার ৫টি প্রাচীন লোকসঙ্গীতের অডিও এ্যালবাম ও ১টি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে তাঁর সুরময় সঙ্গীত জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র 'সুরের পথিক' প্রকাশিত হয়।

২০১৩ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও আইটিসি সঙ্গীত রিসার্স একাডেমির যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় প্রথমাবার আয়োজিত 'বাংলা গানের উৎসবে' প্রাচীন লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন।

সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মামনা একুশে পদক-২০১৪, বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশীপ- ২০১২, রবীন্দ্র পদক- ২০০০, মেরিল- প্রথমআলো আজীবন সম্মাননা, ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন স্মৃতিপদক- ১৯৯৭, ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন স্মৃতিপদক- ২০০৭ লাভ করেন। ২০০৫ সালে নিউইয়র্কে হাছনরাজা ফোক ফেস্টিভালে 'লোকসঙ্গীত সম্রাট উপাধী' তে ভূষিত হন। ২০০৯ সালে শিকড়- শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আজীবন সম্মাননা লাভ এবং ২০১১ সালে "সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এওয়্যার্ড" লাভ করেন। এছাড়া দেশে-বিদেশে তিনি বিভিন্ন সময়ে বহু সম্মাননা ও সংবর্ধনা লাভ করেন। বাঙালির অনন্য সংগীত প্রতিভা কিংবদন্তী শিল্পী পণ্ডিত রামকানাই দাশ ৫ সেপ্টেম্বরের ২০১৪ পরলোক গমন করেন।