সিলেট নগরীর সিনেমা হলগুলোর উত্থান-পতন এবং ভবিষ্যৎ

সুমন দে
Published : 3 Sept 2017, 07:20 PM
Updated : 3 Sept 2017, 07:20 PM

সিলেটে সিনেমা ব্যবসাঃ

ব্রিটিশ আমলেই সিলেটে সিনেমা ব্যবসা চালু হয়। সিলেট নগরির বর্তমান পৌর পাঠাগার সারদাহল ও কিন ব্রিজ সংলগ্ন ১৯১৮-১৯২২ সালে প্রথম নির্বাক ছায়াছবি প্রদর্শিত হত। সেইসময় এই প্রদর্শিত হলের নাম ছিল সিলেট টকিজ। পরবর্তীতে ইউএসআইএস মিউনিসিপাল পাঠাগারে রূপান্তর করে। ১৯৩৬ সালের পূর্বে লালকুটির নাম ছিলো ছায়াবানি। ১৯৩৬ সালে  একই সাথে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজ, সারদাহল, লালকুঠি  সিনেমাহল এবং রংমহল সিনেমা হলের তৈরীর কাজ শুরু হয়। তৎকালীন ছায়াবানির সিনেমা প্রদর্শণের মেশিন বিখ্যাত বঙ্গ বিহারী দাশ (বঙ্কু বাবু) এর চার পুত্র ১) বনওয়ারি লাল দাশ ২) বিরেন্ড্র লাল দাশ ৩) বনবীর লাল দাশ ও ৪) বিনদ লাল দাশ, ক্রয় করেন।

উল্লেখ্য, তৎকালীন আসাম রাজ্যের শ্রীহট্ট (সিলেট) মহকুমার ২৫ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন, বঙ্গ বিহারী দাশ (বঙ্কু বাবু) এর পুত্র বনওয়ারি লাল দাশ ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। এরপর দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত ১৯৪৬-১৯৪৭ সাল চেয়ারম্যান হিসেবে অনুজ বনবীর লাল দাশ ছিলেন। সিলেট অঞ্চলে কথিত রয়েছে আমজাদ আলী'র ঘড়ি, জিতু মিয়ার বাড়ী আর বঙ্কু বাবুর গাড়ী বৃটিশ আমলের।

১৯৩৬ সালে রংমহললালকুঠি সিনেমা হলের ম্যনেজিং ডাইরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন বিদিত লাল দাশের (পটলবাবু)। ১৯৩৬ সাল হতে শুরু করে, পূর্ব-পাকিস্থান আমলেও লালকুঠি ও রংমহলে কোন অঘটন ঘটেনি। প্রথম বার, ১৯৭১ সালে হিন্দু বিদ্বেষী রাজাকারদের অসৎ উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি হানাদাররা অগ্নিসংযোগ করে লালকুঠি সিনেমা হলে। ৭১'র স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে লালকুঠি সিনেমাহল। দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচার এরশাদ ঘোষিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পর একদল জঙ্গি উগ্রপন্থি মৌলবাদ জনগুষ্ঠি মিছিল করে দিনের বেলায় অগ্নিসংযোগ করে লালকুঠি হল। প্রায় বছর দিন বন্ধের পর আবারো শুরু হয় সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজারে লালকুঠি সিনেমা হল। ২০০২/৩ সালের দিকে বিএনপি সরকার দেশ পরিচালনার সময়; রংমহলে সরকারদলীয় রাজনৈতিক মদদে জঙ্গি উগ্রপন্থি মৌলবাদ জনগোষ্ঠী অগ্নিসংযোগ করে। তখন থেকেই রংমহল বন্ধ হয়ে যায় বলে জানা যায়।

সিনেমাঃ

স্বাধীনতার পূর্বে ভারতীয় বাংলা, তৎকালীন ঢাকা, বাংলাদেশের তৈরী সিনেমা, হিন্দি ও উর্দু সিনেমা জনগণ পছন্দ করত। ৭১ পরবর্তীতে ভারতীয় সিনেমা ব্যান্ড হয়ে যায় বাংলাদেশের তৈরী বাংলা সিনেমার প্রচার ও প্রসারের জন্যে। কিস্তু একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে বাণিজ্যিক সিনেমাগুলো কোয়ালিটি খারাপ হতে থাকে; সেই সাথে কোয়ান্টিটি বাড়ে বাংলা সিনেমার। প্রযুক্তিগত ভাবে যেমন, সাউন্ড, পিকচার, কালার, চিত্রগ্রহণ এর যন্ত্রাংশ পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় নিম্নমানের হতে থাকে। ৮০'র দশকের শেষের দিকে V.C.R (Video Cassette Recorder) এবং V.C.P (Video Cassette Player) সহজলভ্য ও প্রাপ্তিতে বিশাল প্রভাব পড়ে বাংলা সিনেমার ওপর। সেই সময়টার আগেও সিলেটে সিনেমাহলের স্বর্ণযুগ ছিলো, মানুষের ঢলের সামনে ঝুলতো 'হাউজ ফুল' লেখা সাইনবোর্ড। আজ আর সেই সোনালি সময় নেই। ৯০ দশকের শেষভাগে এসে নানা অবক্ষয়ের কারণে সিনেমা হলের এই রমরমা অবস্থার ধস নামে। কালের পরিবর্তনে সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিপ্লব ঘটে ৯০ দশকের শেষে।

সিলেটে সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক শুরু হয় ২০১০ সালের দিকে। ঘরে বসেই এখন দর্শকরা দেশি-বিদেশি চ্যানেলগুলোতে বাংলাসহ বিভিন্ন রকমের সিনেমা দেখতে পারছেন। (সিলেট ক্যাবল সিস্টেমস্)  SCS নিজস্ব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের কত টাকা সরকার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা ধোঁয়ায় অন্ধকার। বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত তথ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত প্রাইভেট চ্যানেলের ন্যায় ৬/৭ টি চ্যানেল SCS এর নিজস্ব হিসেবে চলছে বিগত প্রায় ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে, তারা বিজ্ঞাপন সহকারে সিলেটে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তা বিগত বছরে কোন সরকার বন্ধ বা অনুমোদন চেয়ে দেখেন নি! বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়সহ কোন মন্ত্রণালয়, এফডিসি, সেন্সরবোর্ড কেনো ডিস ক্যাবল ব্যাবসার নীতিমালা প্রণয়ন করেননি! দেশের আর্থনৈতিক ও সর্বাত্মক ডিজিটাল উন্নয়নে তথ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপই পারে SCS-কে নিয়ন্ত্রণ করতে দেশি-বিদেশি সিনেমা, বিজ্ঞাপন, সিনেমার গানের চ্যানেল ইত্যাদি।

সিটিং ব্যবস্থাঃ

সিলেটের সিনেমা হলে সিটিং বা দর্শকের বসার জায়গা ছিলো ৪/৫ স্তরের। পর্দার সামনে বসা খেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে তৃতীয় শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেনী, প্রথম শ্রেণী দু'তলায় ডিসি এবং ভিইপি কেবিন ছিলো ৩৫ হতে ৪০ টি সিট শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত। এগুলো সিলেটের লালকুঠি ও রংমহলে প্রথম থেকেই ছিলো।

.

আজ থেকে মাত্র প্রায় এক যুগ আগেও দর্শকদের পদচারণায় মুখর ছিল নন্দিতা হল, (ব্যবসায়ী বাদশা মিয়া লস্কর ১৯৮৬ সালে এই হলের যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে ঢাকার এক মালিক সিনেমা হলটি লিজে নিয়ে ব্যবসা করছেন)। দিলশাদ, অবকাশ, লালকুঠি, রঙমহল, মণিকা ও কাকলী (সিনেমা হলের স্বত্বাধিকারী তৌফিক বকস লিপন জানান, আমরা ১৯৮৬ সালে হলটি নির্মাণ করা হয়)। এছাড়াও আখালিয়ায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) মিলনায়তন এবং জালালাবাদ সেনানিবাসে 'সৈনিক' নামে দুটি সিনেমা হল রয়েছে। বিজিবি ও সৈনিক অডিটোরিয়াম সিনেমা হল বাদ দিলে নগরীতে এখন চালু আছে শুধু 'নন্দিতা'। নন্দিতার পাশেই ছিল আরেকটি সিনেমা হল 'অবকাশ'। এটিকে ভেঙে স্থাপন করা হয়েছে জননী মার্কেট। হলগুলো এক সময় দাপটের সাথে ব্যবসা চালিয়ে গেছে একযুগ আগেও। অথচ কালের ধারায় নিম্নমানের ছবি এবং অাভ্যন্তরীণ খারাপ পরিবেশের কারণে ধীরে ধীরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শকরা হল বিমুখ হয়ে পড়ায় ইতোমধ্যে নন্দিতা ছাড়া ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে সিলেট নগরের সকল হল।

রংমহল, অবকাশ, মনিকার মত দাপুটে সিনেমা হল মালিকরা হল ভেঙ্গে তৈরি করেছেন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। জানা যায়, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অসৎ উদ্দেশ্যে রংমহল সিনেমা হল ভেঙে সেখানে করা হয়েছে রংমহল টাওয়ার। রংমহল নাম থাকলেও আর সিনেমা হল নেই। আর লালকুঠি ভবন আছে, নেই সিনেমা হল। বন্ধ হওয়া হলগুলোর মধ্যে 'অবকাশ' ও 'রংমহল' সিনেমা হল দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। বন্ধ হওয়া অারো একটি 'দিলশাদ' সিনেমা হলে ঝুলছিলো চলতি বছরের এপ্রিল মাসেও 'বিক্রয় হবে' বিজ্ঞপ্তি। এছাড়াও বন্ধ রয়েছে লালকুঠি, মণিকা ও কাকলী সিনেমা হল।

বর্তমানে সিলেটে সিনেমা হলের সংখ্যা মাত্র ১টি। কালের বিবর্তনে বন্ধ হয়ে গেছে বাকী আটটি সিনেমা হল। বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় আয়ের মাধ্যম বা ক্ষেত্র হল সিনেমা হল। সিনেমা হল নির্ভর করে দর্শক সমাগমে। উপযুক্ত পরিবেশ, নিরাপত্তা, ভালমানের সিট (বসার জায়গা), শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত ব্যবস্থা, উন্নত মানের ছবির মান (HD Resolution), উন্নতমানের সারাউন্ডিং সাউন্ড সিস্টেমস ইত্যাদি সম্পন্ন হলে পূর্ণাঙ্গ সিনেমা হল হিসেবে দর্শকদের চাহিদা তখন থাকবে সিনেমার মান নিয়ে, প্রচার, প্রসার নিয়ে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সহ পরিচালক, হল মালিকদের যৌথ উদ্যোগে সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলার লক্ষ্যে অবদান রাখতে হবে। তাতে বাঁচবে সিনেমা শিল্প, সাথে বেঁচে উঠবে সিনেমা হল ব্যবসা। যে ব্যবসা এদেশে এ সমাজে অনেক সম্মান জনক। বর্তমানে সিলেটে একমাত্র টিকে থাকা নন্দিতা সিনেমা হলের একটি অফিসিয়াল ফেসবুক পেজও রয়েছে।

.

সিলেটের অনেক জায়গার নামও ছিল হলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাসকরণ করা হয়েছে যা আজও বিদ্যমান। হলের সঙ্গে নাম মিলিয়ে এখনো বন্দরবাজারের একটি অংশের নাম রংমহল পয়েন্ট। লাকুঠির সাথে মিল রেখে বন্দর বাজারে মাছের বাজারসহ সংলগ্ন এলাকার নামও লাল বাজার।

অন্যান্য নগরীর মতো কোনো সিনেপ্লেক্সও গড়ে ওঠেনি সিলেটে। "সিনেমাহল মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ কলন্দর আলী বলেন, দিন দিন সিনেমার মান যেমন খারাপ হচ্ছিল একই সঙ্গে হলের পরিবেশও যাচ্ছেতাই প্রযুক্তিগত ভাবে। এসব কারণেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সিনেমা হলগুলোর পারিবারিক পরিবেশ আর থাকেনি। সিনেমার মান আর সিনেমা হলের পরিবেশ ভালো করা গেলে হয়তো টিকিয়ে রাখা যেত সিনেমাহলগুলোকে। আর তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন ডিস্ট্রিবুটারদের সিনেমার ওরিজেনেল কপি সর্বরাহ এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত মান সম্পন্ন HD কোয়ালিটির ধারণকৃত পিকচার ও সাইন্ডের ব্যবহার, ভালো কাহিনি, সুন্দর বাংলাগানের সাথে শালিনতাবোধ সম্পন্ন নৃত্য দৃশ্য, ডিজিটাল মাধ্যমে স্পেশ্যাল এফেক্ট একশন মুভিতে। তবেই বাংলাদেশে সিনেমা শিল্প পরিবর্তনের ডিজিটাল মাইল ফলক হিসেবে উন্নতি সাধন হবে।"

তথ্যসুত্রঃ সিলেটের স্বর্গীয় বনওয়ারি লাল দাশ এর পুত্র ডা. বনদ্বীপ দাশ, লালকুঠি সিনেমাহলের ম্যানেজার পার্থ চক্রবর্তী (২৪ বছর কর্মরত ছিলেন)। সিলেট সিনেমাহল মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ কলন্দর আলী।