ডিজিটাল বাংলাদেশের সিনেমায় প্রযুক্তির ব্যবহার

সুমন দে
Published : 15 Sept 2017, 08:36 AM
Updated : 15 Sept 2017, 08:36 AM

https://www.youtube.com/watch?v=SVCD1ZnYFjk

ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, প্রযুক্তির ব্যবহারে কথা বলছি, কিন্তু সিনেমা সেক্টরে কতটা প্রযু্ক্তির ব্যাবহর হচ্ছে? যারা সিনেমা নিয়ে কাজ করবে তাদের না টাকা আছে, না মেধা আছে !  অন্যদিকে সিনেমা হল মালিকরা বলছে যে, বাংলাদেশে যে ছবিগুলো তৈরি হচ্ছে, তা প্রেক্ষাগৃহে চলছে না। যার জন্য প্রেক্ষাগৃহ গুলো বিলুপ্তির পথে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নেই কোনো সরকারি নিয়মনীতি। তথ্য মন্ত্রণালয় সহ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তব রুপের জন্য এবং চলচ্চিত্র উত্তরণের জন্য একটা কমিটি দরকার। প্রযুক্তির ব্যবহার সিনেমা হলে সরকারের বাধ্যতামুলক করে দেওয়া দরকার নয় কী? সম্প্রতি দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী 'আয়নাবাজি' ছবিটি সর্বস্তরের দর্শকের জন্য বাংলাদেশের সিনেমায় একটি মাইল ফলক। এ রকম ভিন্ন ভিন্ন গল্পের ও রুচির ছবি যখন আসবে তখন অাগামি ১ থেকে ২ বছরের মধ্যেই আমাদের অবহেলিত সিনেমা শিল্পে সম্ভাবনা দেখা দেবে।

 

[ডিজিটাল সিনেমার পেছনের ইতিহাস:

১৯৯৮ সালের ২৩ অক্টোবর 'ডিএলপি সিনেমা প্রজেক্টর' প্রথম জনসম্মুখে পরীক্ষামূলকভাবে প্রদর্শন করা হয়। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের পাঁচটি সিনেমা হলে পরীক্ষাটি করা হয়। এটা ছিল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র; যা ডিজিটালি শুট, সম্পাদনা ও প্রদর্শন করা হয়েছিল।১৯৯৯ সালের ১৮ জুন Star Wars: Episode I: The Phantom Menace চলচ্চিত্রটি লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্কে ডিএলপি প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। ২০০০ সালের ১৯ জানুয়ারি এসে Society of Motion Picture and Television Engineers নামের সংগঠনটি ডিজিটাল সিনেমার একটি স্ট্যান্ডার্ড রূপ নির্ণয় করার কাজ শুরু করে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় ১৫টি, পশ্চিম ইউরোপে ১১টি, এশিয়ায় চারটি এবং দক্ষিণ আমেরিকায় একটি ডিজিটাল চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ সময় বিশ্বের জায়ান্ট সব মোশন পিকচার কোম্পানি একটু নড়েচড়ে বসে। তারা ২০০২-এর মার্চে Digital Cinema Initiatives (DCI) গড়ে তোলে। ২০০৪ সালের এপ্রিলে 'আমেরিকান সোসাইটি ফর সিনেমাটোগ্রাফারস' সেই 'ডিজিটাল সিনেমা ইনিশিয়েটিভস'-এর সঙ্গে এক হয়ে টু কে ও ফোর কে রেজুলেশনের ব্যাপারে একটি মান নির্ণয়ে (the ASC/DCI StEM material) সম্মত হয়। তারা ঠিক করে ছবিগুলো হবে JPEG2000 কম্প্রেশনে নির্ধারিত। এদিকে চীনে ই-সিনেমা সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালের জুনে। ২০০৯ সালের মধ্যে তারা ৪০ হাজার সিনেমা হলে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৪০০ সিনেমা হল টু কে প্রজেক্টর দিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু করে। কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার তত দিনে স্টেরিও থ্রিডি ছবি বানানোর কাজে হাত দিয়েছেন। ভারতে ২০০৬ সালের আগস্টে মালায়ালাম ভাষায় নির্মিত মুন্নামাথরাল ওই দেশের প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র হিসেবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সিনেমা হলগুলোয় প্রদর্শিত হয়। ২০০৭ সালে ডিসিআই অনুযায়ী Jpeg2000 কম্প্রেশনে প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে 'গুরু' প্রদর্শিত হয়। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যে ডিসিআই অনুযায়ী মাল্টিপ্লেক্সগুলো নিজেদের মানিয়ে নেয়। একই বছর সিঙ্গাপুরে 'সনি ফোর কে ডিজিটাল প্রজেক্টর' দিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। ২০০৯ সাল থেকে সনি বিভিন্ন হল থেকে টু কে প্রজেক্টর উঠিয়ে নিয়ে ফোর কে প্রজেক্টর প্রতিস্থাপন করে, যার প্রক্রিয়া ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ২০১০ সালের জুনের মধ্যে দেখা গেল, ১৬ হাজার ডিজিটাল সিনেমা হল তৈরি হয়ে গেছে, যার মধ্যে ৫০০০ আবার থ্রিডি দেখার মতো স্টেরিওসকোপিক সুবিধাযুক্ত। যার প্রবৃদ্ধি হার ছিল ১২১.৮ শতাংশ। ২০১২ সালের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যের ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ সিনেমা হল ডিজিটাল সিনেমা প্রদর্শনে তৈরি হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অন্য দেশগুলোয়ও এমন পরিবর্তন আসতে থাকে। ডিজিটাল সিনেমা মূলত ডিসিআই অনুযায়ী ডিজিটাল সিনেমা প্রজেক্টর এবং ডেডিকেটেড সার্ভারের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়ে থাকে।

ব্যবসায় ডিজিটাল চলচ্চিত্র: একসময় দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশের সিনেমা হলে ৩৫ মিমি ফিল্মের ছবি টানাহেঁচড়া, বহন করা ব্যয়সাপেক্ষ ছিল বৈকি। ডিজিটাল চলচ্চিত্র সেই জায়গাটিতে দারুণ পরিবর্তন এনেছে। একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্কে ভরে হাই-রেজুলেশনের ডিজিটাল চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্ব ঘুরে আসা যায়। সার্ভারের মাধ্যমে কোয়ালিটি ঠিক রেখে পৃথক পৃথকভাবে দেশে ও দেশের বাইরের সিনেমা হলে পাঠানো যায় ডিজিটাল ফিল্মটি। অনেকগুলো রিল তৈরি না করে, কোনো ম্যারিড প্রিন্ট তৈরি না করে একসঙ্গে কয়েক হাজার সিনেমা হলে রিলিজ দেয়া যায়। সেক্ষেত্রে শো-অন-ডিমান্ড পদ্ধতিতে সিনেমা হল মালিক দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ছবির অর্ডার দিতে পারেন, যা নির্দিষ্ট সময়ে সার্ভারের মাধ্যমে ওই হলগুলোয় প্রদর্শনযোগ্য হয়ে উঠলেও তা পাইরেসি করার সুযোগ অনেক কম থাকে। তাই ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও নির্মাতা, প্রযোজক ও প্রদর্শকের লাভের অঙ্কটা নেহাত কম নয়।

যেভাবে খরচ কমে যাচ্ছে: ১. বিপণন খরচ হ্রাস পাচ্ছে। ২. ফিল্ম প্রিন্টের খরচ বেঁচে যাচ্ছে। ৩. ফিল্মের দাগ, ধূসর হয়ে যাওয়ার মতো বিষয় আর থাকছে না। ৪. ক্যানভর্তি ফিল্মের দুঃস্বপ্ন হ্রাস পাচ্ছে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহারের কারণে। ডাক খরচও কমে যাচ্ছে। ৫. পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে। ৬. যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো সংখ্যক সিনেমা হলে প্রদর্শন করা যায়। ৭. রেকর্ড পরিমাণ সিনেমা হলে একত্রে মুক্তি দেয়া যায়।

৮. বিনিয়োগের অর্থ ওঠাতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে। ৯. একসঙ্গে অনেক হলে রিলিজ করলে প্রচার ব্যয় তুলনামূলক কম হয়। ১০. পৃথক পৃথক সিনেমা হলে পৃথক পৃথক শোতে চলমান ছবিতে নির্দিষ্ট লুক্কায়িত কোডিং পাইরেসি রোধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। ১১. অনুমতিবিহীন শো প্রটেক্ট করতে পারে।

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক, নির্বাহী প্রধান, মিডিয়াএইড বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখাটি  বিশদ ভাবে প্রকাশ করেছিলেন।]

https://vimeo.com/183857070

আমাদের দেশে ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষনা করা হয় বর্তমান সরকার প্রধান। অথচ ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিজিটাল ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে দেশটির বিভিন্ন খাতের উন্নয়নের ঘোষণা দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ৫ বছর এগিয়ে রয়েছে। ভারত প্রকল্পটির জন্য ১ লাখ কোটি রুপি ব্যয় হবে বলেও ঘোষণা দেন মোদি। বর্তমানে এমন খাত হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না ভারতে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রযুক্তির ব্যবহার এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ডিজিটাল ভারত প্রকল্প দেশটির যুবসমাজকে প্রযুক্তিতে আগ্রহী করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে । এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে অনেক খাতেই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে ভারত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে কত সময়ের প্রয়োজন হবে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে এরই মধ্যে প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ প্রায় শেষ। আর গুগলের মতো আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খবরটি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যম হতে জানা যায়।

বাংলাদেশ বিগত ৮ বছরেও চলচ্চিত্র শিল্পসহ দৃশ্যমান ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার কতটা সহজ লভ্য হয়েছে? দেশের সরকারি দলের মন্ত্রীপরিষদেও যদি ডিজিটাল প্রতিবন্ধকতা থাকে তবে চলচ্চিত্র শিল্পে কতটা আশা করা যায়? ৮ বছরেও ডিজিটাল বাংলাদেশে এম.পি বা মন্ত্রীদের জীবন বৃত্তান্ত সহ কার্য সম্পাদন সহ ইনকাম ট্যাক্স, ইলেকশন কমিশনে জমাকৃত হলফনামা সহ কেনো ডিজিটাল মাধ্যমে জনগনের কাছে উন্মোক্ত নয়? সে সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা চিন্তিত হতে-হত কী?