নিউটনীয় ঈর্ষা

দীপেন ভট্টাচার্য
Published : 5 Dec 2014, 12:18 PM
Updated : 5 Dec 2014, 12:18 PM

যে কোন "শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী" প্রতিযোগিতায় আইজাক নিউটন সর্বোচ্চ আসনটি পান, অনেক সময় আইনস্টাইনকেও সেটি দেওয়া হয়। তবে একথা বলা যায় যে নিউটনের বলবিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ইউরোপে ও পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে শিল্প ও কারিগরী বিপ্লব নিয়ে আসে। আমরা এখনো নিউটনের গতিসূত্র পড়ি সেভাবেই যেভাবে নিউটন সেগুলো ১৬৮৭ সনে তাঁর Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica বইয়ে লিখে গিয়েছিলেন। নিউটন তাঁর সৃষ্টির জন্য অন্য কারুর ওপর নির্ভর করেন নি, তিনি একাই মানব সভ্যতার জন্য বিজ্ঞানের কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন। নিউটনের ক্ষণজন্মা প্রতিভা ইতিহাসে হয়তো অদ্বিতীয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না নিউটন তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের বেশীরভাগ অংশই ব্যবহার করেন নি পদার্থবিদ্যার ভিত্তিভূমি রচনা করতে, বরং সেটি গেছে আলকেমি বিদ্যার পরশপাথর তৈরি করার অথবা যিশুর পৃথিবীতে দ্বিতীয় আগমনের দিনটি নির্ধারণ করার মত ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। এটা আমাদের অনেকের পক্ষেই বোঝা মুশকিল যে নিউটন তাঁর অসাধারণ যুক্তি-ক্ষমতা দিয়ে আমাদের গাণিতিক হিসাব নিকাশকে সহজ করে দিয়েছেন ক্যালকুলাসের উদ্ভাবনের মাধ্যমে, আকাশ পর্যবেক্ষণকে আধুনিক যুগে নিয়ে এসেছেন প্রতিফলক দূরবীন আবিষ্কারের মাধ্যমে, পৃথিবী থেকে অন্য সৌরীয় গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতুতে মহাকাশযান পাঠাবার পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাঁর মাধ্যাকর্ষণের নীতির মাধ্যমে, সর্বোপরি বিজ্ঞানের আধুনিক যুগ সৃষ্টি করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রতিটি রাশির নিয়মনিষ্ঠ সংজ্ঞা প্রণয়ন করে, সেই নিউটনই আবার কেমন করে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন তাঁর পরীক্ষাগারে পারদ থেকে সোনা সৃষ্টি করার প্রয়াসে, কিংবা বাইবেলের পুরাতন ও নতুন টেস্টামেন্টের চুল-চেরা বিশ্লেষণে যে কখন পৃথিবীর ঈশ্বর-প্রদত্ত যবনিকা নেমে আসবে।

প্রতিটি মানুষেরই এক এক ধরণের ideosyncrasy বা তাঁর নিজস্ব প্রকৃতি-বিশিষ্টতা থাকে। নিউটন সেই বিশিষ্টতার ব্যতিক্রম নন, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় প্রতিভার চেয়ে তাঁর ইডিওসিনক্র্যা সি অনেক বেশী। এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেটা হল এক ধরণের আত্মগরিমা ও প্যারানোয়া যার প্রকাশভঙ্গী ছিল দুটিভাবে – (১) তিনি সবসময় ভীত ছিলেন যে তাঁর সৃষ্টি কেউ চুরি করবে, তাই অনেক সময় সেই সৃষ্টিকে তিনি এক ধরণের সংকেতের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করতেন। আর (২) কেউ যদি দাবী করত যে নিউটনের উদ্ভাবনে তার কোন ভূমিকা আছে নিউটন তার প্রতি এক ক্ষমাহীন মনোভাব পোষণ করতেন। এই দ্বিতীয় ব্যাপারটির উদাহরণ নিউটনের জীবনময় ছড়িয়ে আছে। আমি তিনজনের নাম করব যাদের দুর্ভাগ্য যে তাঁরা নিউটনের সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও নিউটনের রোষের শিকার হয়েছিলেন। এই লেখাটি সেই তিনজনকে নিয়েই, কিন্তু প্রথমেই আমি একটা ঘোষণা দিয়ে রাখি যে এই আলোচনা কোন ভাবেই নিউটনের প্রতিভা, মনীষা বা অবদানকে ক্ষুন্ন করার চেষ্টা নয়, বরং একটি মানুষের মধ্যে কত ভিন্ন ভিন্ন বিশিষ্টতা থাকতে পারে তার ওপর আলোকপাত করা।

আলোচনার প্রথম ব্যাক্তি হচ্ছেন রবার্ট হুক। তিনি নিউটন থেকে কয়েক বছর মাত্র বড় ছিলেন। আমরা প্রাথমিক পদার্থবিদ্যায় স্প্রিংয়ের স্থিতিস্থাপকতার বর্ণনায় হুকের সূত্র (F = -kX) ব্যবহার করি, কিন্তু হুকের কাজ এর থেকে বহুগুণ বিস্তৃত ছিল। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে পর্যবেক্ষণ করে তাঁর আঁকা পোকা-মাকড়ের ছবি নিয়ে ১৬৬৫ সনে মাইক্রোগ্রাফিয়া নামে একটি বই রয়্যাল সোসাইটি বের করে। এখানে বলা যেতে পারে রয়্যাল সোসাইটির পত্তনই হয় ১৬৬০ সনে রাজা চার্লস দ্বিতীয়ের মাধ্যমে, সোসাইটির কাজ হল প্রাকৃতিক জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়ানো। মাইক্রোগ্রাফিয়ায় রবার্ট হুক জীববিজ্ঞান বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে দৃশ্যময় করার এক নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। হুকের এই বইটিকে পাঠক এখানে দেখে নিতে পারেন। http://archive.nlm.nih.gov/proj/ttp/flash/hooke/hooke.html রবার্ট হুক ও এডমন্ড হ্যালী – এদের সবারই কিছু ধারণা ছিল যে মহাকর্ষের শক্তি দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক বর্গ (F ~ 1/r^2) হিসেবে কাজ করে। কিন্তু নিউটন এটিকে প্রিন্সিপিয়ায় জ্যামিতিক উপায়ে প্রমাণ করলেন। হুক যখন দাবী করলেন যে এতে তাঁর অবদান আছে নিউটন পরবর্তীকালে প্রিন্সিপিয়ার নতুন সংস্করণগুলো থেকে রবার্ট হুকের নামের উল্লেখ মুছে দিলেন।

প্রিন্সিপিয়ার তিন খণ্ডের বিশালাকার কাজের পরে নিউটনের আর একটি বড় বই আছে যার নাম হল অপটিক্স। আলোকবিজ্ঞানের ওপর এই বইটিতে নিউটন প্রতিফলন, প্রতিসরণ, আলোর সাদা রং ও ত্রিশারা কাঁচের মাধ্যমে তার বিচ্ছুরণ, চশমা কেমন করে কাজ করে ও আলোর ব্যতিচার (বা interference) পরীক্ষা বর্ণনা করেন। নিউটন ছিলেন আলোকে কণা হিসেবে দেখার পক্ষপাতী, কিন্তু ব্যতিচারের ঘটনাটি খুব সহজেই আলোকে তরঙ্গ কল্পনা করে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। ঐ সময়ে বিখ্যাত ওলন্দাজ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চান হাইগেনস ব্যতিচারকে আলোকতরঙ্গ দিয়ে বর্ণনা করেছেন এবং রবার্ট হুকও আলোকে তরঙ্গ হিসেবে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন। নিউটন হুককে তখন এতই অপছন্দ করতেন যে তিনি হুকের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন অপটিক্স প্রকাশ করার জন্য। হুক মারা গেলেন ১৭০৩ সনে, অপটিক্স বের হল ১৭০৪ সনে। আমরা এখন জানি আলোকে কণা হিসেবেও বর্ণনা করা যায় – কণা ও তরঙ্গ, এই হচ্ছে আলোর দ্বৈত বৈশিষ্ট্য। কণা হিসেবে আলোকে দেখলে তাকে তরঙ্গ রূপে ব্যাখ্যা করা যাবে না, আবার তরঙ্গ হিসেবে দেখলে তাকে কণা বলা যাবে না। কিন্তু নিউটনের আলোক কণিকা বর্তমানের কোয়ান্টাম ভরহীন কণিকা ছিল না। নিউটন আলোকবিজ্ঞানের সমস্ত প্রক্রিয়াকে ভরসম্পন্ন কণিকার সাথে বস্তুসমূহের কণিকাদের মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। নিউটনের নামের প্রতিপত্তি এমনই ছিল যে নিউটনের মৃত্যুর পরও প্রায় একশো বছর আলোর তরঙ্গ (এবং সঠিক) ব্যাখ্যা পরিত্যাজ্য ছিল। এতে আলোকবিজ্ঞানের যে কিছু ক্ষতি হয়েছে সেটা অনস্বীকার্য। হুকের মৃত্যুর পরে নিউটন রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হলেন, এতদিন হুকের জন্য নিউটন সোসাইটির কোন মিটিংয়ে যেতেন না। ১৭১০ সনে নিউটন সিদ্ধান্ত নিলেন রয়্যাল সোসাইটির নতুন বাসভবন দরকার যদিও এর জন্য অন্য সদস্যদের কাছে থেকে অনুমতি নিলেন না। যাইহোক এই স্থানান্তরণের সময় সোসাইটির দেয়ালে ঝোলানো রবার্ট হুকের একমাত্র ছবিটি হারিয়ে গেল, ইতিহাসবিদরা মনে করেন নিউটনই এই কাজটা করেছেন।

আধুনিক কালে নিউটনকে নিয়ে বৃটেন প্রচুর ডাকটিকিট বের করেছে, এমন কি তার টাকার নোটে নিউটনকে স্থান দিয়েছে। বৃটেন বহু বিজ্ঞানীর ছবিসহ ডাকটিকিট বের করেছে, কিন্তু হুকের দুর্ভাগ্য তাঁর সৃষ্ট অণুবীক্ষণ যন্ত্র ডাকটিকিটে স্থান পেয়েছে, কিন্তু তাঁর ছবি স্থান পায় নি। কি করে পাবে? কারণ হুকের একমাত্র ছবি নিউটন যে কোথায় ফেলে দিয়েছে কে জানে।

আমাদের পরবর্তী মানুষটি হচ্ছেন জন ফ্লামস্টীড। ইনি হচ্ছেন প্রথম রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমার বা রাজকীয় জ্যোতির্বিদ যিনি বলতে গেলে একাই জগৎ-বিখ্যাত গ্রীনীচ মানমন্দির তৈরি করেন। এনারও দুর্ভাগ্য হয়েছিল নিউটনের সময়ে বাস করার। রাজা চার্লস ১৬৭৫ সনে রাজকীয় জ্যোতির্বিদের পদটি সৃষ্টি করেন এবং একই বছর বিখ্যাত স্থপতি ক্রিস্টোফার রেনকে গ্রীনীচ মানমন্দিরের নক্সা প্রণয়ন করতে বলেন। কিন্তু মানমন্দিরের ভবন ইত্যাদি নির্মাণ করতে গিয়েই নির্ধারিত রাজকীয় তহবিল খালি হয়ে যায়। অগত্যা ফ্লামস্টীড নিজের পকেট থেকে পয়সা খরচ করে মানমন্দিরের দূরবীন থেকে আরম্ভ করে সহ্কারী নিয়োগ এসব করলেন। ফ্লামস্টীড বিখ্যাত হয়েছিলেন ১৬৬৬ ও ১৬৬৮ সনের দুটি সূর্যগ্রহণের ভাবীকথন করে। ১৬৮০ সালের নভেম্বর ও তারপরে ডিসেম্বরে আর একটি ধূমকেতু দেখা যায়। ফ্লামস্টীড সঠিকভাবে অনুমান করেন যে এই দুটি ধূমকেতু আসলে একই, নভেম্বরে সূর্যের দিকে যাচ্ছিল আর সূর্য পরিক্রমা করে ডিসেম্বরে ফিরে আসছিল। নিউটন ফ্লামস্টীডের অনুমানটি গ্রহণ করে বললেন, আমি দেখাতে পারি যে সূর্যের মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ ক্ষমতা আছে যা কিনা গ্রহদের তাদের পরিক্রমা পথের স্পর্শকের দিকে চলে যেতে বাধা দেয়। এই প্রথম গ্রহদের ওপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব নিয়ে নিউটনের যে একটা ধারণা ছিল সেটা জানা যায়।

১৬৯৪ সনে নিউটন প্রিন্সিপিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তিনি চান চাঁদের কক্ষপথকে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব দিয়ে পুরোপুরিভাবে বর্ণনা করতে। কিন্তু এর জন্য চাই চাঁদের অবস্থানের নিঁখুত পর্যবেক্ষণ। কে তাকে দিতে পারে সেটি? অবশ্যই ফ্লামস্টীড। কিন্তু ফ্লামস্টীড নিজে যাচাই না করে তথ্য দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, তাছাড়া তিনি নিজের খরচেই বলতে গেলে এই সব পর্যবেক্ষণ করেছেন। তবু চাপে পড়ে অপরীক্ষিত ডাটা দিলেন, তার মধ্যে কিছু ভুল-ভ্রান্তি ছিল। নিউটন মহা ক্ষেপে গেলেন, ফ্লামস্টীড তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। নিউটনের সাথে তখন ইংল্যান্ডের রাণী অ্যান ও তাঁর স্বামী প্রিন্স জর্জের খুব দহরম-মহরম। প্রিন্স জর্জ নিউটনের তদবিরে ফ্লামস্টীডকে একটা তারার ক্যাটালগ প্রস্তুত করতে বললেন। ফ্লামস্টীড যতটা সম্ভব দেরী করলেন, কিন্তু ১৭১১ সনে নিউটন তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির মিটিংয়ে ডেকে মহা গালমন্দ করলেন। অবশেষে ১৭১২ সনে সেই তারার ক্যাটালগ বের হল – Historia Coelistis Britannica (বৃটেনের খগোল ইতিহাস)। ১৭১৩ সনে নিউটন প্রিন্সিপিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণ বার করলেন তাঁর চন্দ্রীয় তত্ত্ব সহ। ফ্লামস্টীডের নামের সমস্ত উল্লেখ নিউটন সেই সংস্করণ থেকে মুছে দিলেন। আপনার যদি কখনও লন্ডন যান তাহলে গ্রীনীচ মানমন্দিরে যেতে ভুলবেন না। Prime Merdian বা পৃথিবীর মূল দ্রাঘিমা রেখা এই মানমন্দিরের মধ্যে দিয়ে গেছে।

আমাদের তালিকার শেষ ব্যক্তি হচ্ছেন গটফ্রিড লাইবনিৎজ। ইনি ইংরেজ নন, জার্মান। আমরা এনাকে চিনি ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা হিসেবে। নিউটনের সমসাময়িক লাইবনিৎজ একাধারে গণিতবিদ, দার্শনিক, প্রকৌশলী। প্যারিসে এই জার্মান বিজ্ঞানী ক্রিশ্চান হায়গেন্সের সান্নিধ্যে কিছুদিন ছিলেন, পরে লন্ডন যান ১৬৭৩ সনে। লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটিকে তিনি তাঁর তৈরি একটি গণনাযন্ত্র প্রদর্শন করলেন। এর পরে জার্মানীতে ফিরে যান। ১৬৭৪ সন থেকে লাইবনিৎজ ক্যালকুলাসের ওপর কাজ শুরু করেন, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে করতে আরো দশটি বছর কেটে যায়। তাঁর বেশীর ভাগ কাজই তিনি Acta Eruditorum নামে একটি বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশ করেন। Acta Eruditorum হল জার্মান ভাষায় প্রথম বিজ্ঞান পত্রিকা। এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে সেই সময়ে, আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর আগেও, এইরকম বিজ্ঞান জার্নালের কথা ভাবা যেত এবং সেই সব জার্নালে ছাপার জন্য প্রচুর লেখাও পাওয়া যেতে। বাংলায় তখন মোগল সুবাদার, সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা, শায়েস্তা খাঁর সময়। শায়েস্তা খাঁ লালাবাগ কেল্লাকে বর্ধন করেন, চট্টগ্রামকে আরাকানদের যুদ্ধে পরাজিত করেন। কবি আলাওলের সময় ছিল এটা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই সময়ই কলকাতায় তাদের কুঠি পত্তন করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দীর্ঘ হাত ইউরোপের বিশাল বিজ্ঞান ও শিল্প বিপ্লবের এক ধরণের ফসল। অথচ এই সময়ে, কিছু সাহিত্যিককে বাদ দিলে, বাঙ্গালী কোন বড় ব্যক্তিত্বের নাম পাওয়া যায় না যাকে কিনা ইতিহাস মনে রেখেছে। ভারতে তখন কেরালা গণিত স্কুলের তিনশো বছরের দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ সময়ের ইতি হয়েছে। কেরেলা স্কুল অনেক অসীম সিরিজের সম্প্রসারণ আবিষ্কার করে। বাংলায় এরকম উন্নত কোন বিদ্যার চর্চা পাওয়া যায় না। তবে এই সময়ে বাংলায় যে তাঁত ও মসলিনের ভাল কাজ হত সেটা আমরা জানি। যাইহোক ফিরে আসি লাইবনিৎজের কথায়। ১৭০৮ সনে জন কিল নামে একজন স্কট গণিতবিদ রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞান জার্নালে লিখলেন যে লাইবনিৎজের ক্যালকুলাস আবিষ্কার আসলে নিউটনের থেকে নকল। ইংরেজীতে কথাটা plagiarism, বাংলাতে এটাকে কুম্ভিলতা বলে। ব্যস, শুরু হল বিতর্ক ক্যালকুলাসের কে প্রথম উদ্ভাবক তাই নিয়ে। ১৭১২ সনে লাইবনিৎজ রয়্যাল সোসাইটিকে ব্যাপারটাকে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করতে বললেন। নিউটন নিজেই তদন্তের জন্য একটা কমিটি গঠন করে একতরফা রায় লিখলেন যে তিনিই ক্যালকুলাসের প্রথম আবিষ্কারের দাবী রাখেন। ১৭১৫ সনে জার্মানীর হ্যানোভারের প্রিন্স জর্জ প্রথম ব্রিটেনের রাজা হলেন। কি করে একজন জার্মানের পক্ষে ব্রিটেনের রাজা হওয়া সম্ভব হয়েছিল সেটা আর এক ইতিহাস, আমাদের এই কাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওদিকে লাইবনিৎজ তখন হ্যানোভারে জর্জ প্রথমের কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু জর্জ প্রথম লাইবনিৎজকে লন্ডনে নিয়ে এলেন না। এর দুটি কারণ ছিল। একটি হল লাইবনিৎজকে জর্জ প্রথমের পারিবারিক ইতিহাস লেখার একটা কমিশন দেওয়া হয়েছিল বহু বছর আগে, কিন্তু লাইবনিৎজ তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের জন্য সেদিকে ভাল করে খেয়াল করতে পারেন নি। জর্জ বললেন, লন্ডনে যেতে হলে আগে অন্ততঃ এক খণ্ড ইতিহাস তাঁকে লিখতে হবে। দ্বিতীয় কারণটি হল জর্জ ভাবলেন লন্ডনে লাইবনিৎজকে তাঁর সাথে নিয়ে গেলে নিউটনকে অসম্মান জানানো হবে। আজকে এটা ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে ক্যালকুলাস কেমন করে কূটনৈতিক সমস্যার উৎস হতে পারে, কিন্তু এমনই ছিল নিউটনের প্রতাপ। তবু জর্জ প্রথম নিউটনকে লাইবনিৎজকে একটা ত্রুটিস্বীকার করে চিঠি দিতে বলেছিলেন। নিউটন প্রত্যুত্তরে বললেন লাইবনিৎজ নিউটনের নামে কুৎসা ছড়াচ্ছে। ভগ্নহৃদয় লাইবনিৎজ মারা গেলেন ১৭১৬ সনে। তাঁর মৃত্যুসংবাদে রয়্যাল সোসাইটি, এমন কি বার্লিনের একাডেমী অফ সায়েন্সেস শোক প্রকাশ করল না। কিন্তু নিউটনের প্রতিহিংসা শেষ হল না, ১৭২৬ সনে লাইবনিৎজের নামের সকল উল্লেখ প্রিন্সিপিয়ার তৃতীয় সংস্করণ থেকে তিনি মুছে দিলেন। নিউটন নাকি তাঁর চিকিৎসককে গর্ব করে বলেছিলেন তিনি (নিউটন) নাকি লাইবনিৎজের হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। আর এক জায়গায় বলেছেন বিজ্ঞানে দ্বিতীয় উদ্ভাবকের কোন মূল্য নেই। নিউটন লাইবনিৎজকে plagiariser বা কুম্ভিলক বলেছিলেন। এর পেছনে কি কোন যুক্তি আছে? ১৬৭৩ সনে লাইবনিৎজ যখন লন্ডন যান নিউটনের প্রকাশক কলিন্স তাঁকে নিউটনের চিঠি দেখান যেখানে নিউটন তাঁর অনেক বছর আগে উদ্ভাবিত ফ্লাক্সিওন গণিতকে (ক্যালকুলাস) ব্যাখ্যা করেন। সেখানে কোন গাণিতিক সমাধান ছিল না। এটা হতে পারে এই চিঠি ও প্যারিসে অনেক মনীষীদের সাহচর্য (যেমন হাইগেন্স) লাইবনিৎজকে ক্যালকুলাস উদ্ভাবন করতে উদ্দীপিত করে। লাইবনিৎজের পদ্ধতি নিউটন থেকে আলাদা ছিল এবং আজ আমরা লাইবনিৎজ প্রণীত প্রতীক চিহ্নই ব্যবহার করি। নিউটনের প্রতিপত্তির জন্য বৃটেন প্রায় একশো বছর লাইবনিৎজের সহজ পদ্ধতি ও প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে নি।

নিউটন ও লাইবনিৎজ দুজনেই গভীরভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু এই দুজনের ঈশ্বর ছিল ভিন্ন রকমের। নিউটন বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন ঘড়ির মত করে। ঘড়ি যেমন মাঝে মাঝে দম দিতে তেমনই মাঝে মধ্যে এই জগতকে ঠিক মত চালানোর জন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তাই হয়তো নিউটন তাঁর জীবনের একটা বিরাট অংশ ব্যয় করেছেন বাইবেলের মধ্যে যদি কোন গুপ্ত জ্ঞান থেকে থাকে তার অর্থোদ্ধার করতে, যীশুর দ্বিতীয় আগমনের সময় বের করতে। তাঁর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের কি সংঘাত হয় নি? এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকুক। এখানে বরং লাইবনিৎজের ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে কিছু বলি। লাইবনিৎজ বিশ্বাস করতেন এই বিশ্ব হল ঈশ্বরপ্রণীত সকল বিশ্বের মধ্যে সেরা। অনেকটা যেন এর থেকে আর কিছু ভাল আশা কর না। আমার মনে হয় ইদানীংকালের মহাবিশ্ব-বিজ্ঞানীদের বহুবিশ্ব (multiverse) অনুকল্পে যেমন বলা হয় অনেক মহাবিশ্বের মাঝে শুধুমাত্র আমাদের মহাবিশ্বেই প্রাণ ও চেতনা সৃষ্টির জন্য পদার্থবিদ্যার যা যা নীতি ও ধ্রুবক থাকা দরকার তা আছে লাইবনিৎজের চিন্তার মধ্যে যেন সেই ধ্বনিই পাওয়া যায়। হুক (মৃত্যু ১৭০৩), লাইবনিৎজ (মৃত্যু ১৭১৬) ও ফ্লামস্টীড (মৃত্যু ১৭১৯) – এঁরা সবাই নিউটনের (মৃত্যু ১৭২৬) আগে মারা যান। সেটাও যেন নিউটনের জন্য বিজয়। নিউটন ১৬৪২ সনে বড়দিনের (ক্রিসমাস) দিন জন্মেছিলেন, তাই মনে করতেন তাঁর ওপর ঈশ্বরের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, বিজ্ঞান ও আলকেমীর মাধ্যমে এই জগতের রহস্য উদ্ধার করার। তিনিই একাই সেই রহস্যের অনেকখানি উদ্ধার করে আমাদের দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর এই অভিযান ছিল যেমন দক্ষ (efficient) আবার তেমনই ছিল ক্ষমাহীন এই ক্ষমাহীনতা প্রবলভাবে প্রকাশ পায় যখন নিউটন বৃটেনের টাঁকশালের প্রধান হলেন। হয়তো ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁকে ছেড়ে যে বহুদিন চলে যায় সেই সময়কার মানসিক অসহায়তা তাঁর জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। এই সব কাহিনী আর একদিনের জন্য তোলা থাকুক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যোগাযোগ উপন্যাসে এক জায়গায় লিখছেন, "দৌর্বল্য স্বভাবত অনুদার, দুর্বলের আত্মগরিমা ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতার রূপ ধরে।" কিন্তু সবলও যে অনুদার এবং সবলের আত্মগরিমা যে ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতার রূপ ধরে তার প্রমাণ অঢেল পরিমাণে আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং ইতিহাসে। এ কথাটা বলাই বাহুল্য।