খিদের ‘সাধারণ ছুটি’ হয় না জনাব…

হাসান ইমাম
Published : 12 Jan 2012, 05:57 PM
Updated : 16 April 2020, 10:29 AM

আমাদের যেন জানাই ছিল না, সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে বহু মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রা আর 'সাধারণ' থাকবে না। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে খাবারের জন্য রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরবেন তারা, ত্রাণের গাড়ি দেখলে হামলে পড়বেন। এই ম্লান মানুষদের কথা যেন আমাদের জানাই ছিল না।

'পেট ও পরান পুরাণ'

এক ঢাকা শহরেই কমবেশি অর্ধশত বস্তি। নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মার কত শত মানুষকে না উদ্বাস্তু বানিয়ে ছেড়েছে। তাদের মাথা গোঁজার জায়গা বস্তি। ভিটেহীন, জমিহারা শত শত মানুষ হররোজ সেঁধিয়ে পড়ছে 'কর্মস্থল' ঢাকায়। রিকশাচালক, ভ্যানওয়ালা, ফেরিওয়ালা, কুলি-মজুর, ফুটপাতের দোকানি, সবজি বিক্রেতা—এমন কত না পেশায় তাদের বেঁচে থাকার প্রাণান্ত লড়াই। কিন্তু এসব কাজের অধিকাংশেরই শর্ত 'দৈনিক হাজিরা'। হাজির আছো তো খাবার আছে, গরহাজির তো উপোসী দিন।

গৃহকর্মে নিয়োজিত কত শত নারী যে তাদের পরিবারের একমাত্র ভরসা, তার কোনও খবর নেই কেন রাষ্ট্রের কাছে? তাদের কারোর কাজ নেই এখন। ড্রাইভার, মালি, ক্লিনাররা আজ 'চাকরিহারা'। সময় স্বাভাবিক হোক, চাকরি ফিরে পাবে। কিন্তু এখন? কাজে যেতে হচ্ছে না, তাই পয়সাও পাচ্ছে না। পেটের কী হবে?

মানুষের প্রধান দুই 'শক্র'—পেট ও পরান। এবং এদের কেউই কথা শোনে না! কথায় চিড়ে ভিজলেও ভিজতে পারে, কিন্তু খিদে মেটে না, স্বপ্ন দেখেও পরান ভরে না। সুতরাং ত্রাণ বিরতণের নানা পরিকল্পনা, আশ্বাসে তাদের অনাহারী দিন-রাতে কোনও তারতম্য ঘটে না।

আমরা তো তিন-চার মাসের খাবার-দাবার হামলে পড়ে কিনে মজুত করেছি, এরপর ফ্ল্যাটের দরজা দিয়েছি সটান বন্ধ করে। দিন আনি দিন খাই মানুষেরা তাদের কষ্টেসৃষ্টে জমানো পাঁচ-দশ টাকায় যে দু-চার দিন চলবেন, তারও তো উপায় রাখিনি। আমাদের আগ্রাসী কেনাকাটায় দুই টাকার জিনিস হয়ে পড়েছে চার টাকা। এর ওপর তৈরি হয়েছে পরিবহন সংকট। সুতরাং বাজারে আগুন।

চার চোখের বালি!

রাস্তাঘাটে হাত পাতা মানুষ দেখলে আমাদের কতজনেরই না ভ্রু কুঁচকে ওঠে। এরা কি কাজ করতে খেতে পারে না? রাষ্ট্র তাদের দিক থেকে নিয়েছে চোখ ফিরিয়ে, আর আমরা চোখ পাকাই!

ওরা যাবে কোথায়? গ্রামের মাঠের জমি হারিয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে, মাছ ধরা বন্ধ হয়েছে নদীগুলো বিষাক্ত পয়ঃনালায় পরিণত হওয়ায়। ফসলের মাঠে কামলা দেবে? মানুষের জায়গা দখল করেছে ট্রাক্টর, মাড়াই যন্ত্র। তাই ওদের অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য হয়ে ওঠে ঢাকা। কিন্তু এই শহর জানে, এই ম্লান মানুষগুলোকে কীভাবে আরও 'ম্লান' করে রাখা যায়। গাঁও-গেরামে তবু ওরা কারো ভাই-বোন, কাকা-কাকি বা দাদা-দাদি; শহরবাসীর কাছে ওরা দারোয়ান, মালি, বুয়া, ড্রাইভার। 'সিএনজি' ও 'রিকশা'ও এখানে সম্বোধন! সিএনজিওয়ালা বা রিকশাওয়ালা নয়। কখনও-সখনও 'মামা'। এই মামারা, বুয়ারা আজ কী খাবে, আমরা গতকাল ভাবিনি, তার আগের দিনও না, এমনকী আগামীকালও হয়তো ভাববো না।

খিদের 'লকাডাউন' চাই

করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা চিন্তা করে আমরা ওদের ত্রাণের জন্য হুড়োহুড়ি দেখে আঁতকে উঠি! 'অশিক্ষিত' বলে গালি দেওয়াও জায়েজ জ্ঞান করি। কিন্তু এই অশিক্ষিত মানুষগুলোকে যদি খাবার ছাড়া পেটকে বুঝ দেওয়ার 'শিক্ষা' দিতেন, তাহলে হয়তো আজ আপনাদের মতো 'উন্নত' বাংলাদেশই দেখতেন। কিন্তু ফ্লাইওভারের ওপরের ঝা চকচকে ছবিটা আপনার, ফ্রেমের বাইরে নিচের 'অন্ধকার'টা ওরা।

অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে (পড়ুন: খাবারের সংস্থান কেড়ে নিয়ে) ওদের বলবেন ঘরে থাকতে। কীভাবে থাকবেন? বাইরে না বেরুলে তো পেটের পোড়ানি বন্ধ করার আর দুটি তো পথ নেই। রাষ্ট্রও সেভাবে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে না, আমরাও সেভাবে কেউ এগিয়ে যাচ্ছি না। অবশ্য খাবার যে কেউ ঘরে পৌঁছে দেবে না, এ কথা জীবন দিয়ে ওরাই হয়তো সবচেয়ে ভাল জানেন।

তাই যাদের অন্তত 'দ্যাশের বাড়ি' আছে, তারা ছুটির ঘোষণায় পড়িমড়ি ঢাকা ছেড়েছেন। এদের বেশির ভাগই গার্মেন্টস শ্রমিক, দোকানের কর্মচারী, ফুটপাতের দোকানি বা ছোটখাটো চাকরি করে খাওয়া মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই তাদের যাত্রাপথে তৈরি হয়েছে 'ঈদের ছুটি'র সমান ভিড়। যে উদ্দেশে এই ছুটি ঘোষণা তার সম্ভাব্য এমন দশাও কি আমাদের ভাবনার বাইরে ছিল?

আমার-আপনার ঘরে থাকার জরুরত আছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যাবশ্যকীয়। ওদের বেলায় যেন কথাটা মিথ্যে। আর এই কথাটাই রাষ্ট্রীয়ভাবে এলান করা হলো। গার্মেন্টস খোলার ঘোষণা দিয়ে সেই কথাটিই আরেক দফায় বিশ্বকে জানিয়ে দিলাম আমরা।

হাজারে হাজারে গার্মেন্টস কর্মী ঢাকার পথ ধরলেন। যে যেভাবে পারলেন— পায়ে হেঁটে, সিএনজি, ট্রাক বা ছোট কোনও গাড়িতে বাদুরঝোলা হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। খড়ের গাদার মতো গাদাগাদি হয়ে। অথচ এমন এক অমানবিক যাত্রাশেষে ঢাকায় ফিরে শুনলেন, গার্মেন্টস বন্ধ থাকবে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা শ্রেণির মানুষের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের এমন নজির কোথায় পাওয়া যাবে? অথচ এই মানুষগুলোর শ্রমের ভিতে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনীতি।

করোনার মতো অদৃশ্য আরেক ভয়

এমন নয় যে করোনাভাইরাসের মারণমারের ভয় নেই এই মানুষগুলোর, কিন্তু 'জীবিকা' যে তাদের জীবনের সমার্থক। চাকরি না থাকলে খাবেন কী? করোনার চেয়েও কার্যকর অদৃশ্য এই ভয় ওদের সারাক্ষণ ঘিরে থাকে।

মানুষের ইতিহাস হার না মানার। করোনাকেও পরাস্ত করে দিকে দিকে জয়ী হচ্ছেন বেশির ভাগ মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের গল্পটা 'পরাজয়ের'; অর্জনের সবটা মালিকদের। এখানে শ্রমিকদের অধিকার-মর্যাদা সব লেখা থাকে কাগজে।

যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে, বস্তিগুলোতে উঁকি দিয়ে দেখেছি কি কেউ? সেখানে খড়ের গাদার মতোই গাদাগাদি বাস ওদের। অধিকাংশ শ্রমিকের থাকার জায়গাও ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর। কয়টি গার্মেন্টেসের কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যবিধির মানদণ্ডের পাস করবে?

সুতরাং চাকরির কাছে পেটবাঁধা এই মানুষগুলো, খিদের তাড়নায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়া মানুষগুলো এমনিতেই মরে আছেন, নতুন করে আর মরবে কী?

খিদের 'লকডাউন' হয় না, 'সাধারণ ছুটি' হয় না। তাই আপনাদের সাধারণ ছুটি সাধারণের জন্য 'ছুটি' নয়।